মতামত

সমরেশ মজুমদারের একটি উপন্যাসের প্লট খোঁজা

সম্ভবত আশির দশকের শেষের দিকেই হবে। দিনে কোনো এক সময়ে সুযোগ পেলেই সচিত্র সন্ধানী সম্পাদক গাজী শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের সন্ধানী’র অফিসের আড্ডায় যাই। এমন সময়ে একদিন লাঞ্চের আগে আড্ডা থেকে উঠবো উঠবো করছি, এ সময়ে একটা ফোন পেয়ে গাজী ভাই বললেন, তোমার খুব বেশি তাড়া না থাকলে একটু অপেক্ষা করতে পারো। সমরেশ মজুমদার এসেছে ঢাকায়, ও আমার এখানে আসতে চায়। এখন তো লাঞ্চ টাইম। শুধু দুজনে লাঞ্চ করবো এটা ভালো লাগবে না।

Advertisement

এর কিছুক্ষণ পরেই সমরেশ মজুমদার এলেন। দুজনের ভেতর কোনো পরিচয় আগের থেকে ছিল না। সমরেশ মজুমদারের কথা থেকে বুঝতে পারি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ই তাঁকে গাজী ভাইয়ের কথা বলেছেন। তাছাড়া সেই স্বাধীনতার পর থেকে সাগরময় ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নবনীতা দেব সেন, সলীল চৌধুরি প্রমুখের ঢাকার ঠিকানা বলতে গাজী শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের বাসাই বুঝাতো।

সুনীলদা ও বৌদির পরিচয় ধরে অনেকেই আসতেন, এবং তাঁরা সবাই গাজী ভাইয়ের আথিতেয়তা পেতেন। সেদিন সমরেশ মজুমদারকে নিয়ে আমরা কাছে পিঠে কোনো একটা রেস্টুরেন্টে খেয়েছিলাম। রেস্তোরাঁর নাম মনে নেই, তবে এটা মনে আছে প্লেটে পাঙাশ মাছের পেটির সাইজ দেখে সমরেশ মজুমদার বলেছিলেন, এটুকু সব তাকে খেতে হবে? তখনও ঢাকার পাঙাশ বলতে পদ্মার পাঙাশ। থাই পাঙাশের নামও কেউ জানতো না। খাবার সময় সমরেশ মজুমদার যতটা না মনোযোগী ছিলেন খাবারের দিকে তার থেকে বেশি মনোযোগী ছিলেন, ঢাকার নানা কিছু জানার দিকে। তাঁর কথায় মনে হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের স্মার্টনেস তাঁকে মুগ্ধ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে তাঁর ধারণা একটু ভিন্ন ছিল বলে মনে হচ্ছিল। না বললেও বোঝা যাচ্ছিল, তার দেখা সেই মুসলিম কনজারভেটিভ কোনো বিষয়ই সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের মধ্যে খুঁজে পায়নি।

তখনও আমার সঙ্গে বা গাজী ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর ওইভাবে ঘনিষ্ঠতা হয়ে ওঠেনি, অথচ ওই খেতে খেতে তিনি হঠাৎ আমাকে প্রশ্ন করে, স্বদেশ, তোমার মেয়ে বন্ধু কতজন?

Advertisement

যতদূর মনে পড়ে উত্তর দিয়েছিলাম, আমার বন্ধু ভাগ্যের বৃহস্পতিটা একটু তুঙ্গে- তবে মেয়ে বন্ধু বা ছেলে বন্ধু এভাবে কখনও ভাবেনি। গাজী ভাইও কিছুটা বিস্ময়ের সঙ্গে সমরেশ মজুমদারের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এবং তিনি ঠিক বুঝতে পারেননি সমরেশ মজুমদার কেন এমন একটা প্রশ্ন করলেন? আমিও গাজী ভাইকে কোনোদিন আমার উপলব্ধি বলিনি যে আসলে সমরেশ মজুমদার ওই প্রশ্নের ভেতর দিয়ে জানতে চাচ্ছিলেন, বাংলাদেশের মুসলমান মেয়েরা ছেলেদের কতটা বন্ধু হয়।

আজ এ বাংলাদেশ দেখে সত্যি অর্থে সত্তর বা আশির দশকের বাংলাদেশ, ঢাকা শহরের চরিত্র বিচার করার কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া তখনও গাজী শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের সার্কেল ও তাঁর পারিবারিক পরিবেশ সমরেশ মজুমদার দেখেননি- তাই সত্যি অর্থে ঢাকার সমাজ তখনও তাঁর বুঝে ওঠার কথা নয়। এবং এ ভুল অনেককেই করতে দেখেছি। যেমন ’৯১তে নির্বাচনী অবজারভার হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের একজন নামকরা অভিনেত্রী এসে বললেন, তিনি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছেন, ঢাকার মেয়েরা বোরকা পরে না দেখে। তাঁর কথা শুনে সেদিন সাংবাদিক হিসেবে অবাক হয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, তিনি নিজেও জানেন না, তিনি ঢাকায় কত জনপ্রিয়। এবং তার মতো করে শাড়ি পরে, একটু জড়ানো স্টাইলে কথা বলতে চায় ঢাকার কত মেয়ে।

যা হোক, সেদিন লাঞ্চে আরও অনেক কথার মাঝে সমরেশ মজুমদার জানতে চাইলেন, ঢাকার বিউটি বোর্ডিংয়ের কথা। তাঁর কথায় বুঝতে পারলাম এও তিনি জেনেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে।

যা হোক, তখনও আমি আমার প্রিয় পুরান ঢাকার বাসিন্দা। সকাল ১০টারও আগে বাসা থেকে বের হচ্ছি। গলির মোড়ে এসে রিকশা নেব। আর এটাও ছিল তখনকার দিনে একটা বড় কঠিন কাজ। কারণ, মহল্লার সব রিকশাওয়ালা পরিচিত। তাই হুট করে কারও রিকশায় ওঠা যেতো না। এসে ওদের সঙ্গে গল্প করতে হতো। আর গল্পের ভেতর দিয়ে বলতে হতো, আজ কার রিকশায় যাবো। ওরাই ঠিক করে দিতেন।

Advertisement

ঢাকার ওই সব রিকশাওয়ালারা কখনও প্যাসেঞ্জার সিটে বসতেন না। সামনের পাদানিতে বসে একে অপরের সঙ্গে গল্প করতেন। আমি রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে গল্প করছি সে সময়ে কখন যে সমরেশ মজুমদার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, জানি না। তিনি অনেক আপনজনের মতো পেছন থেকে কাঁধে হাত রাখতেই মনে করেছিলাম, মহল্লার কেউ। তাকিয়ে দেখি সমরেশ মজুমদার।

তার কথায় জানতে পারি গাজী ভাই তাকে ঠিকানা দিয়ে দিয়েছেন আমার বাসার। এবং এও বলে দিয়েছেন সকাল দশটার ভেতর বাসায় ধরতে না পারলে আমাকে নাকি রাত তিনটের আগে বাসায় পাওয়া যাবে না। যা হোক, তাঁর উদ্দেশ্য জানতে পারি, দুপুরে বিউটি বোর্ডিংয়ে খাওয়া ও বিউটি বোর্ডিং এলাকা ঘুরে দেখা। ততক্ষণে রিকশাওয়ালারাও নিজেদের মধ্যে একটা রফা করে আমার জন্যে একজনকে ঠিক করে দিয়েছেন। তাঁকে বললাম চলেন, বিউটি বোর্ডিংয়ে যেতে হবে। বিদেশি অতিথি কিন্তু।

আর যাই হোক তখনো পুরান ঢাকার মানুষেরা সাদা চামড়া না হলে তাকে বিদেশি মনে করতেন না। এমনকি সাদা চামাড়ার পাদ্রী বা ড্রাই ক্লিনারের মালিক অনেকটা গোলাপি রঙের চাইনিজরা তখনও তাদের কাছে কেন যেন বিদেশি নয়। তাই আমি বিদেশি অতিথি বলতে রিকশাওয়লা যথারীতি ধরে নিলেন, ভাগ্যকূলের বা মানিকগঞ্জের ঝিটকার কেউ হবে। তাই তিনি রিকশায় উঠেই ভাগ্যকূলের পদ্মার মাছের আর ঝিটকার গুড় ও ঘি’র গল্প শুরু করে দিলেন। ততক্ষণে সমরেশ মজুমদারও সমরেশ দা হয়ে গেছেন। আমি তাকে বললাম, আপনি যতই কলকাতা থেকে আসুন না কেন, উনি কিন্তু মনে করছেন, ভাগ্যকূল বা ঝিটকার কেউ হবেন।

ছোটবেলা থেকে একটা বেরিয়ে পড়ার জীবন থাকার কারণে পূর্ববঙ্গ থেকে যাওয়া ভারতের রিফিউজিদের জীবন আমার কাছে অনেক পরিচিত। আবার সপ্তাহে অন্তত একবার আটকে পড়া বিহারিদের ওপর একটা স্টোরি লেখার কারণে মোহাম্মদপুর ও খুলনার জেনেভা ক্যাম্পের বিহারিদের অনেকের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব। তারপরেও দেশভাগের সুদুর প্রসারী ফল তখনও বুঝিনি। এমনকি তখন রাজনীতির ওপর এত ভক্তি ছিল তাই সাধারণ মানুষের ওপর সব ভক্তি নিয়ে আসতে পারেনি। যে কারণে বুঝতে পারতাম না মানুষ দাঙ্গা করেনি। মানুষ দেশভাগ করেনি। এসবই করেছে ক্ষমতালোভী কিছু কৌশলী রাজনীতিক। সেই আদি কালের কৌশলী রাজাদের চরিত্রের থেকে এদের চরিত্রে কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য তারা লাঠির জোরে প্রতারণা করতেন এরা কথার জোরে প্রতারণা করে। তাই দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া একের পর এক রক্ত স্রোত মাড়িয়েও সাধারণ মানুষের কাছে একজন বাঙালি আর যাই হোক বিদেশি নন।

বিউটি বোর্ডিংয়ের নানান পদের খাওয়ার থেকে সমরেশ মজুমদারকে দেখলাম হোটেলটি সম্পর্কে সেখানে যত বয়স্ক মানুষ আছেন তাদের কাছে জানতে চাচ্ছেন। দুপুর গড়িয়ে যখন আমরা বের হলাম তখন সেই একই রিকশাওয়ালাকে দেখে সমরেশ মজুমদার একটু চমকে গেলেন। বললেন, ইনি কি সেই থেকে এখানে বসে আছেন? তার চোখ দেখে বুঝতে পারলাম, তিনি মনে করছেন অহেতুক অনেকগুলো বাড়তি পয়সা যাবে আমার। সারাদিন আরও কয়েক জায়গায় ঘোরার পরে সন্ধ্যার দিকে গাজী ভাইয়ের আড্ডায় ঢোকার আগে রিকশাওয়ালা চাচাকে যা দেই তার থেকে তিনি আরও কিছু আমাকে ফেরত দিতে সমরেশ মজুমদার চমকে যান।

তিনি আমার মুখের দিকে তাকাতেই বলি, উনি আমার সব জানেন। সাংবাদিকতায় খুব বেশি পয়সা পাই না। তারপরে বন্ধু-বান্ধব অনেক। রেস্টুরেন্ট ও বই ছাড়া নানান শখের খরচ আছে। তাই সত্যি অর্থে এখনও বাপের টাকায় চলি। উনি চাচা হয়ে বেশি পয়সা তো আর নিতে পারেন না। আসলে তখনকার পুরান ঢাকার মহল্লার মানুষের কলিজা বোঝানোর ক্ষমতা ওই সময়ে যেমন আমার ছিল না এখনও পারবো বলে মনে হয় না।

এরপরে তিন চারদিন নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। ঢাকার বাইরেও গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ফিরে বেলা বারোটার দিকে গাজী ভাইয়ের ওখানে ঢুকতেই, তিনি কোনো মতেই বসতে দিলেন না। তাঁর কথায় বের হয়ে তাঁর পিছে পিছে গ্যারাজে গিয়ে গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি ঢাকা ক্লাবে ঢুকতেই মনে করলাম হয়তো এখানে লাঞ্চ করতে হবে। কিন্তু দেখি গাজী ভাই গাড়ি থেকে না নেমে ড্রাইভারকে পাঠালেন। ড্রাইভার খাবার নিয়ে গাড়িতে উঠতেই আবার গাড়ি যখন ঘুরছে সে সময়ে গাজী ভাই বললেন, সমরেশ আমার গ্রামের বাড়ি দেখতে চাচ্ছে, চল কালিগঞ্জে যাচ্ছি।

নিজের শত কাজ থাকলেও গাজী ভাই যতদিন বেঁচে ছিলেন তাঁর কোনো কথায় না বলার ক্ষমতা আমার ছিল না। গাজী ভাই ও সমরেশ মজুমদার গাড়ির পেছন দিকে বসে আমি সামনের সিটে। গাজী ভাই মাঝে মাঝেই বিয়ারের ক্যান আর কিছুটা ফিস ফিংগার বা চিকেন উইংস দিচ্ছেন। তখন কালিগঞ্জে যেতে সম্ভবত দুটো ফেরি ও একটি সেতু পার হতে হতো। তাই দুপুর গড়িয়ে গেলে দেখি এক পর্যায়ে সমরেশ মজুমদার গাড়িতে ঘুমিয়ে গেছেন। আর গাড়ি ছোট রাস্তা ধরে এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলছে।

পুরো রাস্তাই হিজলের শান্ত ছায়ায় ঢাকা। আবার পুবাইল বিলের বুকে গলা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হিজল গাছগুলো। গাজী ভাই সমরেশ মজুমদারকে ঘুম থেকে উঠিয়ে স্বাধীনতার পরে কীভাবে তাঁর কাকা প্রখ্যাত আওয়ামী লীগ নেতা ও স্বাধীনতা সংগ্রামী গাজী গোলাম মোস্তফা এই রাস্তা তৈরি করেছিলেন সে কাহিনি তাকে শোনাতে থাকেন। প্রথম দিকে সমরেশ মজুমদার ওই কাহিনিতে যে খুব বেশি মনোযোগ দিতে পারছিলেন- তা মনে হচ্ছিল না। তবে কাহিনি যখন ঢাকা শহরে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতির সঙ্গে গাজী গোলাম মোস্তফার ত্যাগের পর্বে চলে এলো ততক্ষণে সমরেশ মজুমদার নড়ে চড়ে বসলেন। তারপরে বঙ্গবন্ধু হত্যা, গাজী গোলাম মোস্তফার গ্রেফতার। তার নামে বদনাম। মার্শাল কোর্টে বিচার এমনি ভাবে এগোতে এগোতে আমরা কালীগঞ্জে গাজী ভাইয়ের গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে যাই।

সেখানে গিয়ে দেখি জেলেরা বসে আছে। এই জেলেদের বসে থাকা। তাদের পুকুরে জাল ফেলা। সেই তাজা মাছ পুকুরের পাড়ে বসে ভাজা ও তার সঙ্গে স্বর্গীয় সোমরস। এসব আমাদের কাছে অনেক পুরোনো হলেও সমরেশ মজুমদারের কাছে কেমন যেন একটা খটকা লাগতে থাকে। মুখে না বললেও তার চোখের ভাষা বলছে, একজন ক্ষয়িষ্ণু ধনীর একজন অতিথির জন্যে এত অর্থ ব্যয়! কিন্তু কীভাবে তাঁকে বলবো, একদিকে দেওয়ান গাজীর রক্ত অন্যদিকে পুরোনো ঢাকার রক্ত দুই মিলে তো গাজী শাহাবুদ্দিন।

যা হোক, ভাগ্যক্রমে সেদিন আকাশে চাঁদও ছিল। ওই চাঁদের আলো আর কেরোসিনের আলোতে পুকুরের তাজা মাছ ভাজি আর সোমরস শেষে গাজী ভাইদের বাড়িতে মাটির ঘরে খেতে বসে সমরেশ মজুমদার চমকে গেলেন, মাটির ঘরের মধ্যে নবাবী মখমলের ওপর খাবার পরিবেশন দেখে। গাজী ভাই হেসে বললেন, ওরা এখনও নবাবী নজরানা পায়।

এর কিছুদিন পরেই ছিল কলকাতার পূজো সংখ্যার মৌসুম। আনন্দ বাজার গ্রুপের কোনো একটা ম্যাগাজিনে গাজী ভাইকে নায়ক করে সমরেশ মজুমদার একটা উপন্যাস লেখেন। ওই সংখ্যা বের হলেই গাজী ভাই বায়তুল মোকাররম থেকে সেটা নিয়ে আসেন। অল্প কয়েক পাতা পড়েই আমার হাতে ধরিয়ে দেন। তিনি সন্ধানী প্রকাশনী থেকে সেটা বই আকারে বের করবেন। কম্পোজ হয়ে গেছে। প্রুফ দেখা চলছে সে সময়ে হঠাৎ একদিন কয়েক পাতা পড়তে গিয়ে চোখ আটকে যায় একটা জায়গায়- তিনি যা লিখেছিলেন তা অনেকটা এমন, গাজী'র মা নিয়মমাফিক ধর্ম পালন করেন। আর সে নিয়মানুযায়ী তিন ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। লাইনটা গাজী ভাইয়ের নজরে আনতে, তিনি হেসে বলেন, ও জানে না নামাজ কয় ওয়াক্ত। আমি একটু হেসে বলেছিলাম, সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের কাছ থেকে তো জেনে নিতে পারতেন। গাজী ভাই জানতেন, আমি সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের লেখার শুধু নয়, তার জীবনের চলার পথেরও ভক্ত। তাই তিনি আমার কথার কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি।

তারপরেও ছোট্ট সে উপন্যাসটি পড়েছিলাম। পড়ে কিছুটা হতাশ হয়েছিলাম। তিনি যেভাবে ঢাকাকে জানার চেষ্টা করেছিলেন, সেভাবে ঢাকা উঠে আসেনি ওই উপন্যাসে। এমনকি গাজী ভাইয়ের চরিত্রও। এরপরে ধীরে ধীরে সমরেশ মজুমদার বাংলাদেশে অনেকের ব্যক্তিগত পরিচিত হয়ে ওঠেন। নানান পত্রপত্রিকায় তার লেখা ও সাক্ষাৎকার ছাপা হতো।

এদিকে আমাদেরও বয়স ও দায়িত্ব বেড়ে যাওয়ায় ওইভাবে আর দেখা করার সময় সুযোগ হতো না। তারপরেও আজও মাঝে মাঝে মনে হয়, সমরেশ মজুমদার ঢাকা ও বাংলাদেশকে বুঝতে চেয়েছিলেন। তার প্রথমবারের আগ্রহভরা চোখ দেখে তাই মনে হয়েছিল। তবে পরে কি তিনি নিজেই বুঝেছিলেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, তারপদ রায় এমনি যাদের শেকড় আছে পূর্ববঙ্গে তাদের পক্ষে ঢাকাকে বোঝা বা পূর্ববঙ্গ বা আজকের বাংলাদেশ নিয়ে লেখা সম্ভব। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের ছেলের পক্ষে তা সম্ভব নয়।

আসলে কি উপন্যাসের সঙ্গে নিজের জীবনের একটা বহমান রক্ত স্রোত বা একটা সময়ের বাতাস মিশে থাকে? সেই রক্তস্রোত আর সময়ের বাতাসই কি শব্দের চরিত্রগুলোকে জীবন্ত করে? আর তাই হয়তো ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার বুঝেছিলেন, ঢাকাকে তিনি সেই ভাবে নিজের রক্তে ঢোকাতে পারবেন না।

লেখক: সাংবাদিকতায় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস