মতামত

বাজেটের ‘মশা’ নিয়ে হৈচৈ

প্রতি বছরই অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেটে একটা ‘মশা’ থাকে। সামনে দিয়ে উড়ে যাওয়া সেই মশা নিয়ে আমরা সবাই মেতে উঠি, হৈচৈ করি। পেছন দিক দিয়ে হাতি চলে যায় আমরা টের পাই না। আমার ধারণা এটা সরকারের একটা কৌশল। সংসদের ভেতরে বাইরে বাজেট নিয়ে আলোচনায় বারবার ঘুরেফিরে সেই ‘মশা’ নিয়ে আলোচনা হয়। শেষ পর্যন্ত বাজেট পাসের সময় প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবনায় সেই মশাটি মারা পড়ে। আর পার পেয়ে যায় সমস্যার হাতি।

Advertisement

মশা মারা নিয়ে তখন ধন্য ধন্য রব ওঠে। সবাই বলে, সরকার জনগণের কথা শুনতে পেয়েছে এবং তাদের দাবি মেনে নিয়েছে। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে সেই ‘মশা’ হলো, করযোগ্য আয় থাকুক আর না থাকুক, রিটার্ন জমা দিতে হলে ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে। করযোগ্য আয় না থাকলেও কর দেওয়ার প্রস্তাবের নৈতিক ও আইনি ভিত্তি নেই। তাই শেষ পর্যন্ত যে এ প্রস্তাব টিকবে না, এটা সবাই জানে। কিন্তু সামনের এই মশা তাড়াতে গিয়ে আমরা পেছনে যে সমস্যার হাতি পার পেয়ে যাচ্ছে সে খেয়াল নেই কারোই।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সরকারের দৃঢ় নীতির কারণে গত ১৪ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি দারুণ মোমেন্টাম পেয়েছিল। রিজার্ভ বেড়েছে, জিডিপি বেড়েছে, প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু, এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, স্যাটেলাইট, সাবমেরিন, টানেল- একের পর এক নতুন যুগে পা রাখছে বাংলাদেশ।

এটা মানতেই হবে গত ১৪ বছরে অন্তত উন্নয়ন বিবেচনায় বাংলাদেশ বদলে গেছে। বাংলাদেশের এই বদলে যাওয়া বিস্মিত করেছে সবাইকেই। অর্থনীতির এই গতি প্রথম ধাক্কা খায় করোনার সময়কালে। বাংলাদেশ দারুণ দক্ষতায় করোনা মোকাবিলা করেছে। করোনা ধাক্কা সামলে বাংলাদেশের অর্থনীতি যখন পুনরুদ্ধারের পথে, তখনই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সেই যুদ্ধ গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকেই জিম্মি করে ফেলে। বাংলাদেশও বিশ্বের বাইরে নয়। তাই যুদ্ধের সর্বগ্রাসী ঢেউ ভাসিয়ে নেয় বাংলাদেশকেও।

Advertisement

গত ১৪ বছরে যে মজবুত অর্থনীতি সরকারের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল, তৃতীয় মেয়াদের শেষ বছরে নির্বাচন সামনে রেখে সেই অর্থনীতিই এখন সরকারের কপালে সবচেয়ে বড় চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। ডলারের পাগলা ঘোড়ায় সওয়ার হওয়া তছনছ করে দিয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে। ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমেছে। রিজার্ভের পতন ঠেকাতে রাশ টানা হয়েছে আমদানিতে। তাতে উৎপাদন কমেছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে রপ্তানিতে।

চড়া দামে জ্বালানি কেনা যাচ্ছে না বলে কমাতে হয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। তাতে ফিরে এসেছে লোডশেডিংয়ের অসহনীয় কাল। বিদ্যুতের অভাবে শিল্প-কারখানায় উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছে। তাতে প্রভাব পড়েছে বাজারে, কমেছে রপ্তানি। জ্বালানি তেলে দাম বাড়ানোর প্রভাব পড়েছে বাজারে। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে হু হু করে। প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে ৬-এর ঘরে আনার অঙ্গীকার করার চারদিনের মাথায় মূল্যস্ফীতি ১১ বছরের রেকর্ড স্পর্শ করেছে। মূল্যস্ফীতি এখন প্রায় ১০ ছুঁই ছুঁই।

১০ থেকে কীভাবে মূল্যস্ফীতি ৬ এর ঘরে নামবে তার কোনো অঙ্গীকার নেই বাজেটে। এক মণ দুধে এক ফোটা চনার মত, মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে না পারলে সরকারের সব অর্জনই অর্থহীন হয়ে যাবে। অর্থনীতিকে ঠেকা দিতে, বাজেটের ঘাটতি মেটাতে দেশের ভেতর-বাহির থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে সরকারকে। তাতে বাড়ছে সুদ মেটানোর চাপ। বাজেটে নেই কালো টাকা, খেলাপি ঋণ, অর্থপাচার ঠেকানোর সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। আমরা যখন ন্যূনতম কর ২ হাজার টাকা নিয়ে বেশি কথা বলি, তখন সমস্যার এ পাহাড় আড়ালেই থেকে যায়। এটা মানতেই হবে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন একটা চক্রের মধ্যে পড়ে গেছে। পা ঢাকলে মাথা উদোম হয়ে যায়, মাথা ঢাকলে পা।

এটা ঠিক বাংলাদেশের রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত এশিয়ায় তো বটেই সারাবিশ্বেই সবচেয়ে নিচের দিকে। গত কয়েক ছরে জিডিপি যে হারে বেড়েছে রাজস্ব আয় সে হারে বাড়েনি। ফলে এই অনুপাত আরও কমেছে। বর্তমানে ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত সাড়ে ৭ শতাংশ। এটা আসল লজ্জাজনক। সুযোগ থাকলে এই অনুপাত আমি লুকিয়ে রাখতাম, কাউকে দেখাতাম না।

Advertisement

মজবুত অর্থনীতির একটা কল্যাণ রাষ্ট্রের রাজস্ব আয় এত কম হতে পারে না। অনেকে বলেন, আমাকে কর দিতে হবে কেন? সরকারের আয়ের মূল উৎস রাজস্ব। কর দেওয়া মানে আমরাও সরকারের অংশ। আমাদের দেওয়া করের টাকায়ই সরকার চলে। আমরা কর যত বেশি বেশি দেব, রাষ্ট্র আমাদের তত বেশি সেবা দেবে। কর দেওয়া মানে রাষ্ট্রের অংশীদার হওয়া। একজন সচ্ছল নাগরিকের জন্য কর দেওয়াটা গর্বের বিষয় হওয়ার কথা। ভ্যাট আকারে পরোক্ষভাবে কর আমরা সবাই দেই। কিন্তু ১৭ কোটি মানুষের দেশে আয়কর দেন মাত্র ২৮ লাখ মানুষ, এটা লজ্জাজনক, দুর্ভাজ্যজনক। চলতি অর্থবছর পর্যন্ত করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ টাকা।

মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় আগামী অর্থবছর থেকে করমুক্ত আয় সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা করার প্রস্তাব এসেছে। খুব ভালো প্রস্তাব। মধ্যবিত্তরা একটু স্বস্তি পাবে। করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে ৩ লাখ মানে হলো বছরে সাড়ে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করলে আপনাকে কোনো কর দিতে হবে না। এর বেশি করলে নির্দিষ্ট হারে কর দিতে হবে। বছরে সাড়ে লাখ টাকার বেশি আয় মানে মাসে ৩০ হাজার টাকা। মাসে ৩০ হাজার টাকা আয় করেন, দেশে এমন মানুষের সংখ্যা কি মাত্র ২৮ লাখ। এটা কেউ বিশ্বাস করবে? এটা যদি বিশ্বাস করতে হয়, তাহলে বাংলাদেশের জিডিপি, মাথাপিছু আয় সবই মিথ্যা।

প্রকট বৈষম্য বিবেচনায় নিলেও এটা মানতে হবে, দেশে বছরে সাড়ে ৩ লাখ টাকার বেশি আয় করা মানুষ আছে কয়েক কোটি। মাসে ৩০ হাজার টাকার বেশি আয় না হলে তো ঢাকায় টিকে থাকাই মুশকিল। তাহলে মাত্র ২৮ লাখ আয়কর দেন, বাকিরা দেন না কেন? দেন না, কারণ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তাদের অনুপ্রাণিত করতে পারেনি। কর দেওয়া যে দেশপ্রেমের অংশ সেটা বোঝাতে পারেনি। ট্যাক্স মানেই বাংলাদেশের মানুষের কাছে হয়রানি আর দুর্ভোগেরে নামান্তর। মানুষ যে কোনো ভাবে রাজস্ব বোর্ডকে এড়াতে চায়। সবার ধারণা একবার ট্যাক্সের জালে ফেঁসে গেলে আর মুক্তি নেই।

আয়কর ব্যবস্থাটা জনবান্ধব করতে পারলে করযোগ্য আয় করেন, এমন সবাইকে আওতায় আনতে পারলে বাংলাদেশের রাজস্ব আয় এমনিতেই অনেক বেড়ে যেতো, তখন আর আইএমএফ’এর পরামর্শ শুনতে হতো না। আয় বাড়াতে ন্যূনতম ২ হাজার বিধান নিয়ে লাখ টাকার সমালোচনা শুনতে হতো না। করযোগ্য আয় করা মানুষদের খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়ে রাজস্ব বিভাগ এখন টিন আছে, এমন লোকদের ধরতে চাইছে।

দেশে এখন ৮০ লাখ মানুষের ট্যাক্স আইডিন্টিফিকেশন নাম্বার-টিআইএন বা টিন আছে। তার মধ্যে প্রতিবছর রিটার্ন জমা দেন ৩০ লাখের মতো মানুষ। এদের মধ্যে আয়কর দেন ২৮ লাখের মতো মানুষ। সরকার এখন নিয়ম করছে সরকারের ৪৪টি সেবা পেতে হলে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার রসিদ জমা দিতে হবে। আর অর্থমন্ত্রী প্রস্তাব করেছেন, রিটার্ন জমা দিতে গেলে করযোগ্য আয় থাকুক না থাকুক ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে।

বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার আগে আইএমএফ নানা শর্ত দিয়েছিল। তার মধ্যে রাজস্ব আয় বাড়ানোর শর্তও আছে। রাজস্ব বোর্ডও সেই হাতি আর মশার সহজ কৌশলেই গেছে। করযোগ্য আয় করেন এমন কোটি মানুষকে চিহ্নিত করার চেষ্টা না করে, টিন আছে এমন মানুষদের কাছে অন্যায়ভাবে কর আদায় করতে চাইছে। অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। অনেকে বলছেন, টিন থাকলেই ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে। ব্যাপারটা মোটেই এমন নয়। নির্ধারিত ৪৪টি সেবা নিতে গেলেই রিটার্নের কপি লাগবে আর রিটার্ন দিতে গেলেই ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে।

বছরে ২ হাজার টাকা তেমন বড় কিছু নয়। কিন্তু করযোগ্য আয় না থাকলেও কর দিতে হবে এটা নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। আমার ধারণা যে ৪৪টি সেবার জন্য রিটার্ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যারা সেই সেবাগুলো নিতে যাবেন, তাদের সবার বার্ষিক আয় অবশ্যই সাড়ে ৩ লাখ টাকার ওপরে। যার সন্তান ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে, তার বার্ষিক আয় সাড়ে ৩ লাখের কম হতেই পারে না।

আমার ধারণা করযোগ্য আয় না থাকলেও কর দিতে হবে এই প্রস্তাব প্রত্যাহার করলেও খুব ক্ষতি নেই। নির্ধারিত ৪৪টি সেবার জন্য রিটার্ন বাধ্যতামূলক রাখলেই আরও অনেককে করজালে আনা সম্ভব। রিটার্ন দিতে গেলেই করযোগ্য আয়ের হিসাব বেরিয়ে আসবে। এভাবে ধাপে ধাপে সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় করযোগ্য আয়ের লোকদের বের করে আয়কর দিতে অনুপ্রাণিত করলে আয় এমনিতেই বাড়বে।

প্রথম কথা হলো, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ে মানুষের মধ্যে যে আতঙ্ক আছে তা দূর করতে হবে। গণমুখী কর আদায় ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে। হয়রানি বন্ধ করতে হবে। মানুষ যাতে বছরে সাড়ে ৩ লাখ টাকার বেশি আয় হলেই স্বেচ্ছায় দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত হয়ে কর দিতে যায়, দেশ গড়ায় অংশ নেওয়ার গৌরবে শামিল হয়; তেমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তাহলে আর আইএমএফ’এর কথাও শুনতে হবে না। অর্থনীতি নিয়ে এত ভয়ও পেতে হবে না।

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম