দেশজুড়ে

রাজনৈতিক অস্তিত্ব সংকটে কক্সবাজারের মোজাম্মেল পরিবার?

কক্সবাজারে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা উঠলেই একটি নাম প্রথমে উচ্চারিত হয়- এ কে এম মোজাম্মেল হক। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে আমৃত্যু আওয়ামী লীগের সেবক হিসেবে তার অবদান অনস্বীকার্য। যা প্রবীণ ও কেন্দ্রীয় নেতারা একবাক্যে স্বীকার করেন।

Advertisement

দুর্দিনে বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে পরিচিতি থাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সমীহ করতেন তাকে। সেই অবদানে ভর করে মোজাম্মেলের পাঁচ সন্তান মাসেদুল হক রাশেদ জেলা আওয়ামী লীগে সাংগঠনিক সম্পাদক, মেজ ছেলে শহিদুল হক সোহেল জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক, সেজ ছেলে শাহিনুল হক মার্শাল জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি, ছোট ছেলে কায়সারুল হক জুয়েল জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং একমাত্র মেয়ে তাহমিনা চৌধুরী লুনা জেলা যুব মহিলা লীগের সভাপতির পদ পান।

এদের মধ্যে জুয়েল ছাত্রলীগের রাজনীতি দিয়ে রাজপথ মাড়িয়ে দলীয় পদের অধিকারী হন। তবে বাকি সন্তানরা ছাত্র রাজনীতিতে না থাকলেও বাবার অবদানের স্বীকৃতিতে ভর করে মূলদল ও সহযোগী এবং অঙ্গ সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদের মালিক হয়ে মাঠে ছিলেন।

ওয়াকিবহাল মহলের মতে, দলে প্রয়াত এ কে এম মোজাম্মেল হকের অবদানের কৃতজ্ঞতায় তার পরিবারের সন্তানদের সঙ্গে ভাই-বোনের মতোই সম্পর্ক ছিল আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। কারণে-অকারণে তাদের খোঁজ নিয়েছেন তিনি। যেকোনো প্রয়োজনে চাইলেই সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ ছিল মোজাম্মেল পরিবারের সন্তানদের।

Advertisement

এর ধারাবাহিকতায় সামনের দিনগুলোতে জেলা আওয়ামী লীগের মূল পদ ছাড়াও বাকি সংগঠনগুলো গোছানোর দায়িত্বে মোজাম্মেল পরিবারের সন্তানরা আসতো এটাই সবার ধারণা ছিল। প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে জেলায় প্রশাসনিক প্রধানদের গুরুত্বেও থাকতেন মোজাম্মেল পরিবারের পাঁচ সন্তান। এর বহিঃপ্রকাশ দেখেছেন জেলাবাসী।

কিন্তু স্থানীয় সরকারের প্রশাসনিক ক্ষমতার লোভের বশে দাপুটে মোজাম্মেল হক পরিবারের সন্তানরা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে একে একে সবাই রাজনৈতিক পদবী হারিয়েছেন। ফলে আজ তারা রাজনৈতিক সংকটে ভুগছেন। স্থানীয় সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদি ক্ষমতার চেয়ারের লোভ আকাশ থেকে মাটিতে নামিয়ে এনেছে তাদের, এমনটি দাবি জেলার রাজনৈতিক বোদ্ধা মহলের।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের ত্যাগী কয়েকজন নেতা বলেন, তৃণমূলে দল গুছিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সুনজরে এলে দলীয় ও সরকার প্রধানের (প্রধানমন্ত্রী) সান্নিধ্য মেলে। কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয়। কিন্তু মাঠের কাজের অবদানের পরিবর্তে বাবা মোজাম্মেল হকের অবদানে অনায়াসে দলীয় ও সরকার প্রধানের সান্নিধ্য পেয়েছেন সন্তানরা। সেই পরিচিতি ও সম্পর্কের ওপর ভর করে মোজাম্মেল হকের সন্তানরা এলাকায় নানাবিধ ব্যবসা-বাণিজ্য করে স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, কোটি কোটি টাকার মালিক। পেয়েছেন কারণে-অকারণে প্রশাসনিক সহযোগিতাও। ব্যক্তির চেয়ে দল বড়- এ চিন্তাকে প্রাধান্য দিলে, তাদের দলীয় পদে যদি আর ফেরানো না হয় তবে বাবার গড়ে দেওয়া প্রাসাদ নিজেদের ভুলে নিজেরাই গুঁড়িয়ে ফেলেছেন বলে ইতিহাসে ঠাঁই হবে।

তথ্যমতে, ২০১৮ সালের মার্চ মাসে জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন মোজাম্মেল হকের মেজ ছেলে শহিদুল হক সোহেল। এর ঠিক এক বছরের মাথায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নৌকার প্রার্থী করা হয় মোজাম্মেল পরিবারের ছোট ছেলে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক কায়সারুল হক জুয়েলকে। দলীয় ভাবে ভোটে তিনি জয় পান। অবশ্য এর আগে ২০১৬ সালের ২৮ জানুয়ারি জেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে গঠিত সিরাজুল মোস্তফা-মুজিবুর রহমান কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ পান মোজাম্মেল হকের বড় ছেলে মাসেদুল হক রাশেদ।

Advertisement

মূল ক্ষমতার বাইরে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন শাহিনুল হক মার্শাল ও যুব মহিলা লীগের সহ-সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন তাহমিনা হক লুনা। কিন্তু ২০২২ সালের ২০ জুলাই যুব মহিলা লীগের সম্মেলনে তাহমিনা হক লুনাকে সভাপতি ঘোষণা করা হয়।

এরপর ক্ষমতার জন্য উন্মাদ হয়ে ওঠেন মোজাম্মেল হকের সেজ ছেলে শাহিনুল হক মার্শাল। ২০২২ সালের অক্টোবরে জেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী সাবেক সাংসদ মোস্তাক আহমেদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হন তিনি। কৌশলে জয়ও ছিনিয়ে নেন। বঙ্গবন্ধুর সময়কালে জাতীয় নির্বাচনে মোজাম্মেল হক পরাজিত হয়েছিলেন তরুণ স্বতন্ত্র প্রার্থী মোস্তাক আহমদের কাছে। তাই জেলা পরিষদের নির্বাচনের জয়কে মার্শালরা বাবার পরাজয়ের প্রতিশোধ হিসেবে প্রচার করেছিলেন।

এদিকে, দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে প্রার্থী হওয়ায় আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে মোজাম্মেল পরিবারের যথেচ্ছা যোগাযোগ রুদ্ধ হয়ে যায়। সেই ক্ষত না শুকাতেই চলতি ১২ জুন অনুষ্ঠিতব্য কক্সবাজার পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মাহবুবুর রহমানের নৌকার বিরুদ্ধে প্রার্থিতা ঘোষণা করেন প্রয়াত মোজাম্মেলের বড় ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাসেদুল হক রাশেদ। এটা স্থানীয় নির্বাচন, এতে দলের কিছু আসে যায় না উল্লেখ করে রাশেদকে জেতাতে কোমর বেধে মাঠে নামেন ভাই-বোন ও ঘরের বউ-বাচ্চা সবাই। নির্বাচনী প্রচারণায় একেকজন নানা বিতর্কিত বক্তব্য দিচ্ছেন। বর্তমান দায়িত্বে থাকা নেতাদের পাশাপাশি প্রয়াত অনেক নেতাকে নিয়েও কুৎসা রটিয়ে বক্তব্য দেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মার্শাল এবং অন্যরা। ভোটারদের অনুকম্পা নিতে মোজাম্মেল হককে কক্সবাজারের বঙ্গবন্ধু এবং হকশনকে কক্সবাজারের ৩২ নম্বর বলতেও দ্বিধা করছেন না তারা।

দলের নেতাকর্মীরা জানান, কক্সবাজারে দলের জন্য যে পরিবারের কর্তার সবচেয়ে অবদান বেশি সেই পরিবারের সন্তানদের এমন আচরণে চরম বিব্রত দলের হাই কমান্ড। তারা নানাভাবে মোজাম্মেল পরিবারের সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে অনুরোধ করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সান্নিধ্যের চেয়ে পৌর মেয়র, জেলা পরিষদের চেয়ারের ক্ষমতা বড় হিসেবে দেখায় দলীয় হাই কমান্ডের নির্দেশনা মানার প্রয়োজন বোধ করেননি তারা। ফলে, প্রথমে বিদ্রোহী প্রার্থী রাশেদকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর স্বেচ্ছাসেবক লীগ থেকে বহিষ্কার হন দলীয় প্রতীকে উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়া জুয়েল। অন্যদিকে বহিষ্কার হবেন জেনে তাড়াহুড়ো করে যুব মহিলা লীগের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন তাহমিনা হক লুনা। সর্বশেষ ৮ জুন জেলা যুবলীগ সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কৃত হন শহিদুল হক সোহেল। একটি মাত্র মেয়র পদের জন্য চারজন দলীয় পদবী হারিয়েছেন, হয়েছেন দলছুট। পড়েছেন রাজনৈতিক সংকটে।

জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য রাশেদুল ইসলাম বলেন, দলের জন্য প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম মোজাম্মেল হকের অবদান অনস্বীকার্য। তার সেই অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ না চাইতেই সন্তানদের অনেক কিছু দিয়েছেন দলীয় প্রধান জননেত্রী শেখ হাসিনা। বয়স্ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা থাকতেও অল্প বয়সে জুয়েলকে নৌকার মনোনয়ন দিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। রাজনৈতিক অবদান না থাকলেও স্বল্প শিক্ষিত সব ছেলে-মেয়েকে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছিল। কিন্তু এসব অর্জন কষ্টার্জিত না হওয়ায় ভার বহন করতে না পেরে নিজেদের হয়তো শেখ হাসিনার চেয়েও বড় মনে করা শুরু করেছিলেন তারা। এর বহিঃপ্রকাশ দলীয় সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো। এখন সব হারিয়ে তারা রাজনৈতিক সংকটে ভুগছেন। তাদের যদি মার্চি করে আবার দলে ফেরানো হয়, অন্যরাও লোভে পড়ে তাদের মতো আচরণ করবে।

জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, নিজস্ব গঠনতন্ত্র ও শৃঙ্খলার মধ্যেই চালিত হয় একটি সংগঠন। এখানে চেইন অব কমান্ড মানা অতি জরুরি। আর না মানলে কী হয় তা জেলার রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা অবলোকন করছেন। দলের জন্য একসময়ের ত্যাগী মোজাম্মেল পরিবারের সন্তানরাও শাস্তির বাইরে নয়, সেটা প্রমাণ হয়েছে। একটি গোছানো রাজনৈতিক পরিবার দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে অল্প দিনেই রাজনৈতিক সংকটে পতিত হয়েছে, এটা এলার্মিং।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে প্রয়াত মোজাম্মেল হক পরিবারের বড় ছেলে বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থী মাসেদুল হক রাশেদের মোবাইল নম্বরে কল দিলেও রিসিভ করেননি।

তবে, পরিবারের ছোট ছেলে উপজেলা চেয়ারম্যান কায়সারুল হক জুয়েল জাগো নিউজকে বলেন, কিছু হাইব্রিড নেতাদের কারণে আমরা বিতর্কে পড়েছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া আমরা অন্যদের মানি না। তিনি (শেখ হাসিনা) ফোন করে নির্বাচন না করতে বললে আমরা করতাম না। কিন্তু তিনি কল না দিয়ে, অন্যরা দিয়েছেন।

সব ভাই-বোনদের পদ হারিয়ে রাজনৈতিক সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, দলীয় পদ-পদবী আমাদের জন্য কিছু নয়। পদের চেয়ে জনগণই আমাদের সব। পদে না থাকলেও আমরা জনগণের মনে আজীবন থাকবো।

কক্সবাজার পৌরসভা নির্বাচন ১২ জুন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ নির্বাচনে বিভিন্ন পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন পাঁচ মেয়রসহ ৭৭ প্রার্থী। পৌরসভার ১২টি ওয়ার্ডের বর্তমান ভোটার সংখ্যা ৯৪ হাজার ৮০২ জন। এতে পুরুষ ৪৯ হাজার ৮৭৯ ও নারী ভোটার ৪৪ হাজার ৯২৩ জন। ৪৩টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ হবে ইভিএম পদ্ধতিতে। পৌরসভার সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছে ২০১৮ সালের ২৫ জুলাই। ওই নির্বাচনে মেয়র হন আওয়ামী লীগের মুজিবুর রহমান।

কক্সবাজার পৌরসভা নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা নির্বাচন অফিসার এসএম শাহাদাত হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

এসজে/এএসএম