সাগরতলার সৌন্দর্যের লীলাভূমি বা পাতালপুরীর স্বর্গ বলা হয় ‘রেড সী’ কে। এখানে আছে বাগান আর অবিশ্বাস্য রকম সুন্দর প্রজাতির প্রাণী। কোনোটা ভয়ংকর কোনোটা আবার নিরীহ। সবই সৃষ্টিজগতের বিস্ময়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক অ্যাকোয়ারিয়াম এই রেড সীকে ফটোগ্রাফারদের স্বর্গও বলা হয়ে থাকে। এখানকার ছবি তুলতে প্রয়োজন সর্বোচ্চ সতর্কতা ও সাহস। ডুবুরি ফটোগ্রাফাররা সাগর প্রাণীর অবিশ্বাস্য রকম সুন্দর ও চিত্তাকর্ষক মুহূর্তের প্রতিচ্ছবি তুলে আনেন। এ শুধু অফুরন্ত রহস্য ভান্ডারই নয়। এখানে পাওয়া যায় আবিষ্কারের উতলা আনন্দ আর তৃপ্তি।
Advertisement
রাজকীয় সৌন্দর্যপৃথিবীর পানিতে কত রকম মাছ আছে তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। তবে রেড সীতে নয়শ’ প্রজাতির মাছ শনাক্ত করা গেছে। এসব মাছের রঙিন আভা, চোখ আর মনকে করে তোলে বিমোহিত। পাতালপুরীতে সুদৃশ্য শক্ত খোলসের কাঁকড়া যেমন আছে। তেমনিমেরুদণ্ডহীন ক্ষুদ্র প্রাণী তো অগণিত আছেই। সেই সঙ্গে পানির নিচের প্রবাল প্রাচীরে আছে বিভিন্ন রকম গর্ত। আরও আছে নানান রঙের টিউবওয়ার্ম আর বিভিন্ন নামে ও বিচিত্র নকশার হরেক রকম মাছ। এসব মাছ এবং টিউবওয়ার্ম এর কোনো কোনোটা চার মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এদের মুখ লেগে থাকে সামুদ্রিক প্লাংকটনের সঙ্গে। এসব জলজ প্রাণী চক্রাকারে পানির নিচে প্রবাল প্রাচীরের চারিদিকে গোল হয়ে ঘুরে বেড়ায়। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। অন্যরকম সাম্রাজ্য মাছেদের। সত্যিকার রাজকীয় সৌন্দর্য বলে যদি পৃথিবীতে কিছু থেকে থাকে, তবে তা আছে এই সাগরের তলেই।
প্রবাল প্রাচীর বলতে আমরা যা বুঝি তা আসলে পানির নিচের বালুকাময় আস্তরণ ছাড়া আর কিছু নয়। এই আস্তরণ ত্রিশ ডিগ্রি কোণে ঢালু হয়ে ক্রমশ: অনেক গভীরে চলে গেছে। সূর্যের আলো এখানে যথাযথভাবে পড়ে না। এখানকার গাছপালাগুলো অতি ক্ষুদ্র। মাত্র ত্রিশ মিটার দূর থেকেই দেখা যায় না এই সাগর বাগান। তবে প্রবাল দ্বীপ যেখান থেকে শুরু সেখানে সূর্যের আলো পাওয়া যায় ভালোই। সেই আলোতে প্রবাল প্রাচীর স্পষ্টই দেখা যায়। তা সত্ত্বেও শান্ত সাগরের বিচিত্র প্রাণী আর শৈবাল দেখে আনন্দ আর বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হতেই হয়।
আরও পড়ুন: খাবারে কেন সুঘ্রাণ হয়?
Advertisement
সাগরের পর্দা বারকুডাপ্রবাল দ্বীপে অতি ক্ষুদ্র জলজ কীট আছে। খালি চোখে প্রায় দেখাই যায় না। এরা যখন দল বেঁধে প্রবাল প্রাচীরের চারিদিকে ঘুরে বেড়ায় তখন এদের শরীরে চমৎকার রঙিন আলো বড়ই মনোহর লাগে। অপরদিকে বাটার ফ্লাই নামের মাছের ঠোঁট হচ্ছে রঙিন। মুখটা একটু লম্বাটে ও কিছুটা পুরু হয়ে থাকে। পানির নিচে অ্যাঞ্জেল মাছ,প্যারট মাছ ঠোঁট দিয়ে পাথর আর মাটি খুঁচিয়ে পানি ঘোলা করে । এটাই ওদের সার্বক্ষণিক কাজ। তবে একই জাতের প্রাণীদের প্রতি এদের টান আছে প্রচণ্ড। ওদের আস্তানায় অন্য কোনো মাছ বা প্রাণী এলে দলবদ্ধভাবে হামলা চালিয়ে তাড়িয়ে দেয় তাদের।
চালাক মাছ: স্করপিওনহাজার হাজার মনোমুগ্ধকর প্রাণী বাস করে পাতালপুরীতে। এদের মধ্যে স্করপিওন ফিশ অন্যতম। এদের শরীরটা লাল টকটকে। ঝালর দেওয়া পাতলা আঁশযুক্ত এদের শরীরটা ফুলের মতো মনে হয়। কখনো সাগর শৈবাল, আবার কখনো চুনা পাথরের সঙ্গে এমনভাবে লেপ্টে থাকে, বুঝাই যায়না। মরার মতো নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকে। এরা ভীষণ চালাক প্রাণী। নিশ্চল হয়ে মরার মতো ভান করে থাকে সত্যি, কিন্তু শিকার পেলেই আক্রমণ চালায়। এদের শরীরের আঁশ, পাখনা শত্রু মাছের জন্য ভয়ংকর। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্যই ডুবুরিরা অনেক সময় একে স্টোন ফিশ ভেবে ভুল করে।
ভয়ংকর মাছ: স্টোন ফিশপ্রবাল দ্বীপে যতো রকম মাছ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর আর বিষাক্ত মাছ হচ্ছে স্টোন ফিশ। তবে এই মাছ ভয়ানক চালাক। শত্রুকে আক্রমণ করে তৎক্ষণাৎ ছদ্মবেশ ধারণ করতে ওস্তাদ। পাথরের মতো গুটি সুটি মেরে অন্য পাথরের আড়ালে ঘাপটি মেরে থেকে শত্রুর চোখে ধুলো দেয়। প্রবাল বালির মধ্যে দেহটা পুরোপুরি সেঁধিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হতে পারে। এদের পাখনার বিষ মানুষের গায়ে লাগলে খিঁচুনি হয়, প্রবল যন্ত্রণা বোধ হয়। তবে রেড সীতে যেসব স্টোন ফিশ আছে সেগুলো শত্রু মোকাবেলায় ভয়ংকর দক্ষ হয়ে থাকে।
সাগর তলে ভয়ংকর প্রাণী চেনা যায় কীভাবে?প্রবাল দ্বীপের মাছ এমনিতেই যথেষ্ট ফুলবাবু। দারুণ সৌখিন। রঙের বৈচিত্র্যতার জন্য বিখ্যাত। তাই প্রতিটি মাছ অন্য কোনো প্রজাতির স্পর্শ একদম পছন্দ করে না। প্রবাল দ্বীপে ভয়ংকর প্রাণী ডুবুরিরা ভালোই চেনেন। ভয়ংকর প্রাণীরা সামনের দিকে এগিয়ে আসার সময় সোজাসুজি এবং স্মার্টলী চলে। একটুও ভয় করে না। উদাসীনভাবে হেলে দুলে চলছে তো চলছেই। সামনে কোনো বাধা পেলেও পালায় না। প্রবাল দ্বীপে যেসব প্রাণী এমন ধরনের আচরণ করে সেগুলো নিঃসন্দেহে ভয়ংকর বিষাক্ত প্রাণী বলে ধরে নেওয়া হয়। এদের খুব সাবধানে এড়িয়ে চলাই হচ্ছে উত্তম কাজ।
Advertisement
লায়ন ফিশের বিষাক্ত ডানাপ্রবাল দ্বীপের বিষাক্ত মাছের মধ্যে শীর্ষে আছে চিকেন ফিশ বা লায়ন ফিশ। এই প্রজাতির মাছ রেড সীতে প্রচুর দেখা যায়। দেখতেও ভারী সুন্দর। এদের শরীরটা পুরোপুরি ছোট বড় কাঁটায় ঢাকা থাকে। এদের পাখনার কাঁটা ভয়ানক বিষাক্ত। গায়ের উজ্জ্বলতা যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসে। ডুবুরিরা ছবি তুলতে পাতালপুরীতে নামলে লায়ন ফিশের ছবি না তুলে ওঠেন না। লায়ন ফিশ সাঁতার কাটে খুব ধীরে ধীরে। এই মাছের বুকের কাছে ফিতার মতো দেখতে ডানা আছে। সেগুলো পুরোপুরি বিষে ভরা থাকে। প্রবাল দ্বীপের যে কোনো প্রাণী এই বিষের ছোঁয়ায় ধরাশায়ী হতে বাধ্য।
পাতাবাহারের মতো শামুকপ্রবাল দ্বীপের খোলসবিহীন দূর্লভ জাতের শামুকের নাম হচ্ছে নিউডিব্রাঞ্চ। এদের শরীরের রঙটা দারুণ স্বচ্ছ। সারা শরীর ফুলের পাপড়ির মতো মনে হয়। পাতা বাহারের ঝরকার মতো ফুলিয়ে রাখে শরীর। দেখতে অনেকটা শস্য ঝাড়ের মতোও মনে হতে পরে অনেকটা। তবে এরা যখন চলাফেরা করে তখন মনে হয়, সবকিছু ভেঙে চুড়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আসলেই কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করে না খোলসবিহীন এই শামুক। উজ্জ্বল, বর্ণাঢ্য মেরুদণ্ডহীন প্রজাতির এই শামুকের সঙ্গে বিশ্বের তাবৎ লোকজ সংস্কৃতির যেন অপূর্ব মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মনে হয়, সাগর পানির বিশাল প্রবাল বাগানের অতুলনীয় সৌন্দর্য এই শামুকেরই অবদান।
বানর মাছ নাচতে জানেআসলে এই মাছের নাম স্প্যানিশ ড্যান্সার। দেখতে অপরূপ এই প্রবাল প্রাণীটি প্রবাল দ্বীপে কখনো কখনো দেখা যায়। এটির শরীরে সাদা রং চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। প্রবাল দ্বীপের দুষ্প্রাপ্য প্রাণী বলতে এই স্প্যানিশ ড্যান্সারকেই বোঝায়। পাখির মতো লাফ ঝাপ মেরে চলাফেরা করে এই প্রাণী। এই কারণেই এই প্রজাতির মাছের নাম রাখা হয়েছে বানর মাছ।
বাদুর মাছ রাতে বের হয়মরে ইল নামে প্রবাল দ্বীপে অদ্ভূত এক মাছ আছে। ওরা দিনের বেলায় চোখে দেখতে পায়না। তাই রাত হলে খাবারের সন্ধানে বের হয়। দিনভর প্রবালের গায়ে দেহটা ডুবিয়ে রাখে। সন্ধ্যা নামলেই বেরিয়ে আসে খাবারের খোঁজে। এদের তীব্র ঘ্রানেন্দ্রিয় আছে। নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শিকার খুঁজে নেয়। এদের ভয়ানক দাঁত আছে। বিশাল সাইজের দু’টো চোয়াল ওঠানামা করে শ্বাস প্রশ্বাস নেয়। তবে এরা খুব ভীত ও আরামপ্রিয় প্রাণী।
আরও পড়ুন: জলে ভাসে ডাঙায় চলে
পাতালপুরীতে ডুবুরিদের অভিজ্ঞতাডুবুরিরা রাতে সাগরে ডুব দিয়ে বিরল অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। পানির নিচে পাতালপুরীকে মনে হয় চারিদিকে নীল রং ছড়ানো। নিজেকে মনে হয় একা নিঃসঙ্গ। সারাবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। পানির নিচে টর্চের আলো ফেললে চোখে পড়ে অসংখ্য বিচিত্র রহস্যময় প্রাণী, গাছপালা। প্রবাল প্রাচীরের গায়ে সারি সারি লেপ্টে আছে বিচিত্র বর্ণের মাছ। এদের গায়ের রংটাও চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। যেহেতু টর্চের আলো একটা নির্দিষ্ট স্থানে এককভাবে পড়ে। তাই সুনির্দিষ্টভাবে একটা প্রাণীর রং দারুণভাবে দোলা দেয় মনে। পানির ভেতরে নামলে মৃত আকৃতির শৈবালগুলো তখন আসল রূপ ধারণ করে। এদের ডালপালা, ঝোপঝাড় বিভিন্ন বর্ণে আভায়িত হয়। কমলা, হলুদ, হাল্কা নীল গাছগুলো স্রোতের তালে তালে দুলে ওঠে। এর ঠিক নিচে তখন দেখা যায় মাছের প্রিয় খাবার প্লাংকটনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ। রাতের বেলা টর্চ জ্বালিয়ে দেখলে পানির নিচে প্যারট ফিশকে খুব সুন্দর লাগে। দেখা যায় ভয়ানক প্যারট কি শান্ত শিষ্ট হয়ে ঘুমিয়ে আছে। এরা এদের শরীরে থাকা মিউকাস বা পাতলা ঝিলি দ্বারা বেষ্টনী তৈরি করে রাতের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখে। অবশ্য টিংগারফিশ এবং ইউনিকর্ণ ফিশ লম্বা শিং এর জন্য বিখ্যাত। রাতের বেলা এরাও ঘুমায়। পাথরের পাশে শরীর এলিয়ে দিয়ে নির্জীব পড়ে থাকে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলেও সত্যি, দিনের বেলা চঞ্চল জীবগুলো রাত হলেই কেমন নির্জীব হয়ে যায়। গায়ের রং বদলানো, নিজেকে আড়াল করা আর বিশ্রামের সময় শত্রু মোকাবেলায় আত্মরক্ষার ভিন্নতর কৌশল পাতালপুরীর প্রতিটি প্রাণীই জানে। এমনই এক প্রজাতির মাছের নাম হচ্ছে ল্যাসি। বিচিত্র বর্ণের এই ফেদার স্টার গভীর প্রবাল দ্বীপে চুপ মেরে থাকে। এদের গায়ের পালক সিলভারের মতো চকচকে সাদা। বাস্কেট স্টার নামে আরেক প্রজাতির প্রবাল জীবের মাথাটা রাতে পাথরের সঙ্গে চুম্বকের মতো লেপ্টে রাখে। এরা স্রোতের টানে ভেসে ভেসে বেড়ায় আর প্লাংকটন খুঁজে খায়। আলোর প্রতি স্পর্শকাতর এই জীবের উপর ডুবুরিরা টর্চের আলো ফেলার সঙ্গে সঙ্গে ওরা ওদের সারা শরীর লজ্জাবতির মতো গুটিয়ে নেয়।
সাগর বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, প্রবাল দ্বীপের এসব ক্ষুদে মনোমুগ্ধকর মাছ ও পানির জীব ধীরে ধীরে আবহাওয়া ও পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে টিকে থাকতে অভ্যস্ত হচ্ছে। এরা দৈব দূর্বিপাকে টিকে থাকে ও বিপদ মোকাবেলায় আত্মরক্ষায় সক্ষম হচ্ছে। আগের মতো এখন পাতালপুরীর জীবের শরীরে সরু ও নরম অঙ্গ প্রবাল প্রাচীরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না। পাতালপুরীর এসব বিচিত্র জলজ প্রাণী সত্যিই মনকে সৃষ্টি জগত নিয়ে আরেকবার ভাবতে অনুপ্রাণিত করে। পাতালপুরীর অপরূপ রঙের পরিবেশকে সত্যিই এক স্বপ্নিল জাদু বলে মনে হয়।
কেএসকে/জিকেএস