পাবনার ঈশ্বরদীতে ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে উৎপাদিত বিষমুক্ত লিচু রপ্তানি হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে (দুবাই)। উপজেলার সলিমপুর ইউনিয়নের চরকদিমপাড়া গ্রামের চাষি শামীম প্রামানিক ব্যাগিং পদ্ধতিতে লিচু চাষে সফলতা পেয়েছেন। তার উৎপাদিত লিচু আকারে বড় হয়েছে। রংও হয়েছে টকটকে লাল। এ লিচুতে রাসায়নিক বা কীটনাশক ব্যবহার করা হয়নি। ব্যাগিং পদ্ধতি ব্যবহারে ঝড়েও গাছ থেকে কোনো লিচু ঝরেনি এবং খরায় বিবর্ণ হয়নি। ব্যাগের ভেতরে সুরক্ষিত অবস্থায় থাকায় কাঠবিড়ালি, বাঁদুড়, চামচিকাসহ কোনো পোকামাকড় আক্রমণ করতে পারেনি।
Advertisement
শামীম প্রামানিকের মতো ঈশ্বরদী উপজেলার ১৬ জনসহ পাবনা জেলার ২১ লিচু চাষি ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে লিচু উৎপাদন করেছেন। তবে এদের বেশিরভাগই এবার পরীক্ষামূলকভাবে স্বল্প পরিমাণ ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। এতে ফলন ভালো হওয়ায় আগামীতে চাষিরা বেশি পরিমাণ লিচু গাছে ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতি ব্যবহারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
জানা যায়, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইজ প্রজেক্ট এসইপির সহযোগিতায় ২০২১ সালের ৩০ জুন থেকে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওসাকা পাবনা জেলায় পরিবেশসম্মত উপায়ে নিরাপদ লিচু উৎপাদন প্রবর্তন উপ-প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যক্রম চালু করে। এ উপ-প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা দ্বারা টেকসই লিচু চাষ পদ্ধতি গ্রহণ করা, নিরাপদ লিচুর উৎপাদন ও বিতরণ নিশ্চিত করা, লিচুর জন্য অনগ্রসর স্থানীয় বাজারের সঙ্গে অগ্রসরমান বাজারের সংযোগ স্থাপন করা।
পরিবেশসম্মত লিচু উৎপাদনের জন্য লিচুর বাজার সম্প্রসারণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এদেশের লিচু অন্য দেশের তুলনায় বেশি সুস্বাদু। তাই বিদেশে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু ব্যাপকহারে রপ্তানির জন্য বিষমুক্ত নিরাপদ লিচু উৎপাদন করা ছাড়া সম্ভব নয়। সেজন্য প্রকল্পের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশে কৃষক পর্যায়ে প্রথমবারের মতো ২০২২ মৌসুমে লিচুতে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যাগিং পদ্ধতি ব্যবহার করে সফলতা পাওয়া যায়। এবার বাণিজ্যিকভাবে ব্যাগিং পদ্ধতিতে উৎপাদিত লিচু চাষ করে প্রথমবারের মতো সংযুক্ত আরব আমিরাতে রপ্তানি করা হচ্ছে। যা বিদেশে লিচু পাঠানোর দ্বার উন্মুক্ত করেছে। আশা করা যায়, একদিন এই ব্যাগিং পদ্ধতিই ঈশ্বরদীর লিচুকে ব্র্যান্ডিংয়ে উন্নীত করবে।
Advertisement
আরও পড়ুন: সম্ভাবনাময় আম রপ্তানিতে বাংলাদেশ
লিচু চাষি শামীম প্রামানিক বলেন, ‘ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে লিচু চাষের জন্য বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওসাকার মাধ্যমে চার দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলাম। ২০২২ সালে পরীক্ষামূলকভাবে স্বল্প সংখ্যক গাছে ব্যাগিং পদ্ধতি ব্যবহার করে সফলতা পেয়েছিলাম। এবার প্রায় ৫০ হাজার লিচু ব্যাগিং পদ্ধতিতে উৎপাদন করেছি। এরই মধ্যে আমার বাগানের ১৫ হাজার লিচু একটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়েছি। তারা এসব লিচু যাচাই-বাছাই করে দুবাই পাঠিয়েছে। বাগানের অন্য লিচুর তুলনায় ব্যাগিং পদ্ধতিতে উৎপাদিত লিচু বিদেশে রপ্তানির কারণে বেশি দাম পাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিটি ফ্রুট ব্যাগের দাম ৫ টাকা। এক ব্যাগে ১০ থেকে ১৬টি লিচু রাখা যায়। লিচু পাকার ২৫ দিন আগে অর্থাৎ লিচু গুটি আকার ধারণ করলে লিচুর ব্যাগিং শুরু হয়। এতে লিচুতে রাসায়নিক বা কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়নি। গাছের গোড়ায় কেঁচো সার ব্যবহার করেছি। ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে লিচুতে পোকা বা কোনো দাগ হয়নি। লিচু আকারে বড় হয়েছে। আগামী বছর আরও বেশি লিচু গাছে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করবো।’
লিচু চাষে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষিপদকপ্রাপ্ত উপজেলার মিরকামারী গ্রামের কৃষক আব্দুল জলিল ওরফে লিচু কিতাব এ বছর পরীক্ষামূলকভাবে ১০০ ব্যাগিং প্রযুক্তিতে লিচু উৎপাদন করেছেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ব্যাগিং পদ্ধতিতে লিচু চাষ কৃষকদের জন্য অত্যন্ত ভালো একটি পদ্ধতি মনে হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে লিচু উৎপাদনে কাঠবিড়ালি, বাঁদুড় ও পোকামাকড়ের আক্রমণের ভয় থাকে না। তাছাড়া অতিবৃষ্টি ও খরায় লিচুর ক্ষতির সম্ভাবনাও নেই। এ লিচু কীটনাশকমুক্ত হওয়ায় সুস্বাদু ও আকারেও বেশ বড় হয়েছে। আমি আগামী বছর থেকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যাগিং পদ্ধতিতে লিচুর আবাদ করবো।’
Advertisement
ভাড়ইমারি গ্রামের লিচু চাষি কাজল সরদার বলেন, ‘নিজের পরিবারের খাওয়ার জন্য ২০০ ব্যাগিং লিচু করেছিলাম। এতে আড়াই থেকে তিন হাজার লিচু হয়েছে। এ পদ্ধতির ফলে লিচু বিষমুক্ত এবং পাখি-পোকামাকড়ের আক্রমণের সুযোগ না থাকায় তা অত্যন্ত নিরাপদ। এ বছর তীব্র খরায় বেশিরভাগ গাছের লিচু বিবর্ণ ও আকারে ছোট হয়েছে। ব্যাগিং পদ্ধতিতে উৎপাদিত লিচুর আকার ও রং স্বাভাবিক ছিল। তাই আশেপাশের বাণিজ্যিক লিচু চাষিরা অনেকেই আগামীতে ব্যাগিং পদ্ধতিতে লিচু উৎপাদনের বিষয়টি জানার জন্য এসেছিলেন। তারা আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।’
আরও পড়ুন: খাগড়াছড়ির বাজারে লিচুর সমাহার
পাবনা জেলায় পরিবেশসম্মত উপায়ে নিরাপদ লিচু উৎপাদন প্রবর্তন উপ-প্রকল্পের প্রজেক্ট ম্যানেজার রফিকুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০২১ সালের ৩০ জুন এ উপ-প্রকল্প কাজ শুরু করেছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে এ প্রকল্প শেষ হবে। এ উপ-প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যাগিং পদ্ধতিতে লিচু উৎপাদনে চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এ পদ্ধতিতে লিচু উৎপাদনে কৃষকরা সফলতা পেয়েছেন। এ বছর ব্যাগিং পদ্ধতিতে উৎপাদিত বিষমুক্ত লিচু বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে। আগামীতে বাণিজ্যিকভাবে বহু কৃষক ব্যাগিং পদ্ধতিতে লিচু উৎপাদনে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তারা সবাই ব্যাগিং পদ্ধতিতে লিচু উৎপাদন করলে আগামী বছর আরও বেশি লিচু রপ্তানি করা যাবে।’
তিনি বলেন, ‘নিরাপদ লিচু উৎপাদন প্রবর্তন উপ-প্রকল্পের আওতায় লিচু চাষিদের অর্ধেক মূল্যে ফ্রুটিং ব্যাগ সরবরাহ করা হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাগের মূল্য ৫ টাকা। চাষিদের কাছে থেকে প্রতি ব্যাগ ২ টাকা ৫০ পয়সা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কৃষকদের কেঁচো সার সরবরাহ করা হয়েছে। ফলে লিচু চাষে তাদের রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হয়নি।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে উৎপাদিত লিচু চাষ নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। এ লিচুতে কীটনাশক ব্যবহার হয় না। ফলে এটি অত্যন্ত নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত। এ বছর পরীক্ষামূলকভাবে ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে যেসব চাষি লিচু চাষ করেছেন, তাদের অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা বলেছেন, আগামীতে বাণিজ্যিকভাবে এ পদ্ধতিতে লিচু চাষ করবেন। এখানকার ব্যাগিং পদ্ধতিতে লিচু চাষের বিষয়টি কৃষি বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছি। এ পদ্ধতিতে লিচু চাষে কৃষকদের সার্বিক সহযোগিতা করবে উপজেলা কৃষি অফিস।’
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট গাজীপুরের ফল বিভাগ, উদ্যান তত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শরফ উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশের লিচু সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। এ দেশের লিচুর বিদেশে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে রাসায়নিক বা কীটনাশকমুক্ত নিরাপদ লিচু উৎপাদন করা হলে এ লিচু বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।’
আরও পড়ুন: জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলের সমাহার
তিনি বলেন, ‘ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে লিচু উৎপাদনে চাষিদের প্রশিক্ষণে আমি ঈশ্বরদীতে গিয়েছিলাম। চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, তারা ব্যাগিং পদ্ধতিতে লিচু চাষে বেশ আগ্রহী। এ পদ্ধতিতে লিচু চাষ করলে চাষিরা লাভবান হবেন। ব্যাগিং পদ্ধতির উৎপাদিত নিরাপদ লিচুর দেশে-বিদেশে সব স্থানেই কদর রয়েছে। এসব লিচু যেন সহজেই চাষিরা বিদেশে পাঠাতে পারেন, সেজন্য জামান ট্রেডার্স নামে একটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। তাদের মাধ্যমেই কৃষকরা লিচু দুবাই পাঠিয়েছেন।’
শেখ মহসীন/এসইউ/জিকেএস