‘বর্বর নিপীড়নে বাস্তুচ্যুত হয়ে ক্ষতবিক্ষত শরীরে বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়েছি। জাতিসংঘের সহযোগিতা ও বাংলাদেশের আন্তরিকতায় শরীরের ক্ষত শুকিয়েছে। কিন্তু পূর্ণ নাগরিকত্ব দিয়ে মিয়ানমার আমাদের ফিরিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত মনের ক্ষত শুকাবে না। রোহিঙ্গা হিসেবে নাগরিকত্ব ও ভিটে-বাড়ির নিশ্চয়তা দিয়ে আমাদের ফিরিয়ে (মিয়ানমার) নিন। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা ভালো আছি, কিন্তু আর থাকতে চাই না।’
Advertisement
বৃহস্পতিবার (৮ জুন) সকালে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অনুষ্ঠিত মানববন্ধন ও সমাবেশে এসব কথা বলেছেন রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতারা।
গণহত্যার বিচার, পূর্ণ নাগরিক অধিকার দিয়ে মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন দাবিতে উখিয়ার পালংখালীর তাজনিমারখোলা, সলিমুল্লাহ কাটা, কুতুপালং লম্বাশিয়া, বালুখালী পানবাজারসহ ২৩টি ক্যাম্পে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) কঠোর নিরাপত্তায় এ মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছেন রোহিঙ্গারা।
সকাল সোয়া ১০টা থেকে পৃথকভাবে শুরু হওয়া মানববন্ধন ও সমাবেশ চলে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত। তীব্র গরম উপেক্ষা করে ‘গো ব্যাক হোম’ প্রতিপাদ্যে চলমান মানববন্ধনে বিভিন্ন দাবি নিয়ে বক্তব্য দেন ক্যাম্প ও ব্লক ভিত্তিক কমিউনিটি রোহিঙ্গা নেতারা। এ সময় উপস্থিত রোহিঙ্গারা একবাক্যে দাবি তোলেন, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস অ্যান্ড গো হোম’।
Advertisement
বার বার বৈঠক হলেও এখনো শুরু হয়নি প্রত্যাবাসন। তাই, দ্রুত প্রত্যাবাসন ও নিপীড়নের বিচার নিশ্চিত করার দাবিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানববন্ধনে জড়ো হন হাজারো রোহিঙ্গা। মানববন্ধন ধীরে ধীরে সমাবেশে রূপ নেয়। সমাবেশে তাদের ওপর ঘটে যাওয়া হত্যা, ধর্ষণসহ নিপীড়নের সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন। পূর্ণ মর্যাদা নিয়ে দ্রুত প্রত্যাবাসন চান তারা।
এ সময় নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশ সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতারা সগোত্রীয়দের উদ্দেশ্যে বলেন, আমাদের আশ্রয় দিয়েছে বলে এদেশের সরকার ও জনগণের মনখারাপ হয় এমন কোনো কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। আমাদের অনেকে মাদকসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পুরো আশ্রিত রোহিঙ্গাবাসীকে লজ্জায় ফেলেছেন। প্রত্যাবাসন দ্রুত করার দাবি আমরা করলেও তা নিশ্চিত হতে কতদিন লাগে তার সঠিক হিসাব নেই। ততদিন যেন বাংলাদেশ সরকার ও স্থানীয় জনগণ আমাদের সুন্দরভাবে আশ্রয় দেন, সেই পরিস্থিতি বজায় রাখুন।
মধুরছড়ার রোহিঙ্গা সালামত খান বলেন, ‘আমরা মিয়ানমারের অবর্ণনীয় নিপীড়নের শিকার হয়েছি। নারীদের ধর্ষণ, শিশুদের হত্যা করে আগুনে নিক্ষেপ, গর্ভবতীর পেট কেটে মা-বাচ্চা দুজনকেই হত্যার মতো বর্বরতা পৃথিবীর আর কোথাও ঘটেছে কি না জানি না। প্রাণ বাঁচাতে অন্যায়ভাবে সীমান্ত অতিক্রম করলেও বাংলাদেশ সরকার আমাদের আশ্রয় দিয়েছে। মর্যাদা নিয়ে বার্মায় (মিয়ানমার) ফিরতে চাই। বিশ্বনেতাদের প্রতি অনুরোধ, নাগরিকত্বসহ সম্মানজনক প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করুন।’
টেকনাফ ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা ও হেড মাঝি বজলোর রহমান বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং নাগরিকত্ব অধিকার, বসবাসের বাড়ি ও জমি, সম্পত্তি ফেরত, জীবিকা ও চলাচলের অধিকার, নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ চার দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ক্যাম্পের ভেতর মানববন্ধন করেছি। আমরা চাই কোনো ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে যেন প্রত্যাবাসন কার্যক্রম বন্ধ না হয়। নিজ দেশ ফিরতে চাই।
Advertisement
রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৬ এপিবিএনের উপ-অধিনায়ক (পুলিশ সুপার) জামাল পাশা জাগো নিউজকে বলেন, উখিয়া-টেকনাফের ২৩টি ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা ১৩ স্থানে স্বদেশে ফেরার আকুতি জানিয়ে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে। সকাল ৯টা থেকে নির্দিষ্ট জায়গায় জড়ো হতে থাকেন রোহিঙ্গারা। সোয়া ১০টার দিকে তারা ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে যান। তেমন কোনো প্রচারণা না থাকলেও ধীরে ধীরে রোহিঙ্গা সমাগম বেড়ে সমাবেশে পরিণত হয় মানববন্ধন। সবার একবাক্যে দাবি গণহত্যার বিচার ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসন।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নির্যাতন ও গণহত্যার শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা দেশ ছাড়া হবার পাঁচবছর পূর্তি উপলক্ষে ২০২২ সালের ২৫ আগস্ট সমাবেশ ও মানববন্ধনের আয়োজন করে। এর আগে ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট ক্যাম্পে প্রথম বড় সমাবেশ করা হয়, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মাস্টার মুহিবুল্লাহ। পরে তিনি সগোত্রীয় সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন। এরপরের সমাবেশগুলোতে নির্দিষ্ট কেউ নেতৃত্বে ছিলেন না। কমিউনিটি নেতারাই রোহিঙ্গাদের জড়ো করান।
সায়ীদ আলমগীর/এসজে/এএসএম