ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কিশোরগঞ্জ জেলার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে মেঘনা নদী। এই মেঘনা নদী থেকে অবৈধভাবে প্রকাশ্যে ড্রেজারে বালু উত্তোলন করছে একটি চক্র৷ অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার ১০টি গ্রামে নদীভাঙন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
Advertisement
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোনো প্রকার অনুমোদন বা ইজারা ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার চুন্টা ইউনিয়নের নরসিংহপুর ও আজবপুর বরাবর মেঘনা নদীতে থেকে ২০২২ সালে প্রায় ৭ মাস ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করে একটি চক্র। এই চক্রের নেতৃত্বে রয়েছেন ভৈরব পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মোশারফ হোসেন মিন্টু ও সেখানকার উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক মো. মোশারফ হোসেন মুসা। পরে গ্রামবাসীর প্রতিরোধের মুখে ড্রেজারগুলো অপসারণ করা হয়। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে ড্রেজারে বালু উত্তোলন করায় এই নদীর গতিবিধি অনেকটা বদলে যায়। এতে করে ভাঙন দেখা দেয় আজবপুর ও নরসিংহপুর গ্রাম। সেই ক্ষত এখনো বয়ে যেতে হচ্ছে গ্রামবাসীর।
সম্প্রতি আবারো এই চক্রটি কোনো প্রকার সরকারি ইজারা ছাড়া মেঘনা নদীতে যত্রতত্রভাবে ড্রেজারে বালু উত্তোলন শুরু করেছে। কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব উপজেলার সাদেকপুর ইউনিয়নের মেন্দিপুর গ্রামের ওই অংশ থেকে মাসখানেক ধরে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। একইসঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার বিভিন্ন অংশ থেকেও নিয়মিত বালু তোলা হয়। এতে করে উপজেলার মেঘনার পাড়ের দুবাজাইল, রাজাপুর, কাকরিয়া, চরকাকরিয়া, সিঙ্গাপুর, বড়ইচারা, আজবপুর, নতুনহাটি, পানিশ্বর, নরসিংহপুর গ্রামের বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ প্রতিনিয়ত পাড় ভাঙছে। পাশাপাশি সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই তারা এ কাজটি করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
২৮ মে সরেজমিনে গিয়ে সরাইল উপজেলার চরকাকরিয়া অংশে ছয়টি ড্রেজার (খননযন্ত্র) দিয়ে বালু উত্তোলন করতে দেখা গেছে। খননযন্ত্রগুলোর চারপাশে একাধিক বড় স্টিলের নৌকায় বালু উত্তোলন করে রাখা হচ্ছে।
Advertisement
খননযন্ত্রে থাকা বোরহান নামে এক ড্রেজার চালক জানান, ভৈরবের মিন্টু মিয়া (মোশারফ হোসেন) বালু উত্তোলন করছেন। সেখানে ৩৫-৪০ জন শ্রমিক কাজ করছেন। প্রতিদিন অন্তত আট থেকে ১০ লাখ টাকার বালু এখান থেকে ওঠানো হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনসহ প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে এখান থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে নিয়মিত।
এ প্রতিবেদকসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একাধিক সাংবাদিক বালু তোলার ভিডিও ও স্থিরচিত্র ধারণের সময় স্পিডবোটে করে আসেন ওই সিন্ডিকেটের ক্যাডার বাহিনী। তাদের আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখে সাংবাদিকরা সেখান থেকে সরে আসেন। সাংবাদিকরা ফেরার পথে ওইসব লোকজন নদীতে স্পিডবোট নিয়ে পিছু নেন এবং উল্টো ভিডিও চিত্র ধারণ করেন সাংবাদিকদের।
সরাইল উপজেলার মেঘনার পাড়ের চুন্টা ইউনিয়নের আজবপুর বাজার ও নরসিংহপুর গিয়ে নদীর পাড়ের ভাঙন চোখে পড়ে।
স্থানীয় মো. আবু হানিফ বলেন, গত ২-৩ বছরে আজবপুর গ্রামের আট কানি (৩০ শতকে এক কানি) জমি ভেঙে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এখন বালু উত্তোলনের কারণে প্রতিনিয়ত পাড়ের ভাঙন অব্যাহত রয়েছে।
Advertisement
স্থানীয়রা জানান, আজবপুর গ্রামের আবদুর রহমানের ৩১ শতকের মধ্যে ৫ শতক, রেদওয়ানা মিয়ার ৩১ শতকের মধ্যে ১০ শতক, কাজী আনোয়ার হোসেনের ১৬ শতাংশের ১৬ শতাংশ, হাফিজ মোল্লার ৩০ শতকের মধ্যে ৩০ শতক এবং মেঘনার পাড়ে থাকা তার ডক ইয়ার্ডের (বড় নৌকা রাখা ও নির্মাণের জায়গা) ৪৫ শতকের মধ্যে ৩০ শতক ও ফজল ইসলামের ৬০ শতকের মধ্যে ৩০ শতক জায়গা নদীগর্ভে চলে গেছে। মেঘনার পাড়ে থাকা মজনু মিয়ার ডক ইয়ার্ডের ১৬ শতাংশের ১৬ শতাংশ জায়গার সবটা চলে গেছে।
সরাইলের অরুয়াইল ইউনিয়ন পরিষদের ৭নং ওয়ার্ড সদস্য মো. আবুল বাশার বলেন, ভৈরবের মিন্টুদের নেতৃত্বে অনুমতি ছাড়াই বালু তোলা হচ্ছে। এতে নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। এভাবে অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলা হলে গ্রামের পর গ্রাম বিলীন হয়ে যাবে।
তবে অভিযুক্ত ভৈরব পৌরসভার কাউন্সিলর মোশারফ হোসেন মিন্টু এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক মোশারফ হোসেন মুসা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, স্থানীয়রা কেন বলছে জানি না। লোকজন না জেনেই অভিযোগ দিচ্ছেন।
সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ সরওয়ার উদ্দীন বলেন, বালু উত্তোলনের জন্য আমাদের কাছ থেকে কোনো অনুমোদন নেওয় হয়নি। এ বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ভৈরব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ সাদিকুর রহমান বলেন, ম্যানেজের বিষয়টি সত্য নয়। মেঘনা নদী থেকে বালু উত্তোলনের কোনো অনুমতি কাউকে দেওয়া হয়নি। তবে মেঘনার সরাইলের চরকাকরিয়া এবং ভৈরবের মেন্দিপুর থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে বলে জানতে পেরেছি।
এফএ/এএসএম