মতামত

অযৌক্তিক ভ্যাটে বিদেশমুখী ক্রেতা

পুত্র-সন্তানের বিয়ের সময় উপহার দেওয়ার জন্য ডায়মন্ড ও গোল্ডের অর্নামেন্ট কেনার জন্য প্রতি বছর বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক বিত্তবান ও সম্পদশালী ভারত যান। সেখান থেকে নতুন নতুন ডিজাইনের পাশাপাশি সাশ্রয়ী দামে সব গহনা কিনে আনেন। শুধু ভারতেই যান না। বাংলাদেশিরা সোনার গহনা কিনতে দুবাই, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া যান। আর প্রবাসীরা যে দেশে থাকেন সেখান থেকে দেশে ফেরার সময় সোনার গহনা নিয়ে আসেন।

Advertisement

প্রতি বছর সোনার গহনা রপ্তানি করে বিপুল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে ভারত। তারপরও তারা দেশের ভোক্তার প্রতি বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কোনো ভাবেই ভারতীয় ক্রেতারা সোনার গহনা ও ডায়মন্ড কিনতে বিদেশ যায় না। জুয়েলারি ব্যবসার ক্ষেত্রে সোনা, সোনার অলংকার, রুপা বা রুপার অলংকার বিক্রির ক্ষেত্রে আরোপিত ভ্যাট হার ৩ শতাংশ। ভারতের সোনার বাজার এবং অর্থনীতির তুলনায় আমাদের দেশে বিক্রি ও ক্রেতার পরিমাণ বেশি না। তারপরও আমাদের ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ।

ক্রেতারা বলছেন, ৫ শতাংশ ভ্যাট অযৌক্তিক। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে তুলনা করলে এটা আমাদের জন্য বেশি। ভোক্তাদের বিদেশমুখী বন্ধ করতে হলে প্রতিযোগিতামূলক ভ্যাটের হার নির্ধারণ করতে হবে। প্রতিবেশী দেশটির এত বড় বাজার হওয়ার পর ক্রেতাদের জন্য ভ্যাট মাত্র ৩ শতাংশ। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতায় সক্ষম করতে জুয়েলারি খাতে আরোপিত শুল্ককর ও ভ্যাট হার কমানো এবং আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করতে হবে। এতে যেমন সরকারের বৈদেশিক আয় আসবে। তেমনি বাড়বে রাজস্ব আয়। বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আরেকটি খাত তৈরি হবে।

বর্তমানে জুয়েলারি ব্যবসার ক্ষেত্রে সোনা, সোনার অলংকার, রুপা বা রুপার অলংকার বিক্রির ক্ষেত্রে আরোপিত ভ্যাট হার ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হোক। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি এবং ডলারের বিনিময় মূল্যের কারণে ১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম বা প্রতি এক ভরি ২২ ক্যারেট সোনার মূল্য ৯৯ হাজার ১৪৪ টাকা। এর সঙ্গে ন্যূনতম মজুরি ৩ হাজার ৪৯৯ টাকা। তার সঙ্গে নির্ধারিত ৫ শতাংশ হারে বা ৫ হাজার ১৩২ টাকা ভ্যাট যুক্ত হলে, মোট মূল্য হয় ১ লাখ ৭ হাজার ৭৭৫ টাকা।

Advertisement

বাংলাদেশে প্রতি ভরিতে ভ্যাট দিতে হয় ৫ হাজার ১৩২ টাকা। অন্যদিকে ভারতে সমপরিমাণ সোনার অলঙ্কার কিনতে ৩ শতাংশ হারে বা ২ হাজার ৭৯১ টাকা ভ্যাট দিতে হয়। যার প্রভাব স্বর্ণালংকার ক্রয় ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট বিদ্যমান। অথচ বাংলাদেশের অলংকার শিল্পের অপার সম্ভাবনা আছে। ভ্যাট আহরণে আগামী দিনে সরকারের একটি বড় খাত হতে পারে জুয়েলারি শিল্প। এক্ষেত্রে ক্রেতাদের কাছে সহনীয় আকারে ভ্যাট নির্ধারণ করা জরুরি। বাজুস মনে করে সোনা একটি মূল্যবান ও স্পর্শকাতর ধাতু হওয়ায় মোট বিক্রয়ের ওপর ভ্যাট হার ৫ শতাংশের পরিবর্তে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা দরকার। এতে সরকারের রাজস্ব আয়ের পরিমাণ আরও বাড়বে।

ভ্যাট হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে- বাংলাদেশের ক্রেতারা যেন বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে অলংকার ক্রয়ে নিরুৎসাহিত হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, বিভিন্ন সময়ে উচ্চবিত্তদের একটা বড় অংশই বিদেশে গিয়ে অলংকার ক্রয় করেন। যার অন্যতম কারণ আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে আমাদের স্থানীয় বাজারের সাথে দামের পার্থক্য। যার কারণে যাদের সামর্থ্য থাকে একসাথে বেশি পরিমাণে সোনা ক্রয় করায়, তারা বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে বা আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে ব্যাগেজ রুলের অপব্যবহার করে দেশে সোনা আনছেন। এতে একদিকে যেমন দেশের অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে, অন্যদিকে সরকার প্রত্যাশিত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আবার দেশে যারা কেনাকাটা করেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে উচ্চ করহারের কারণে ভ্যাট প্রদানে অনীহা প্রকাশ করেন। এতে ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েন। আবার জুয়েলারি পণ্য রপ্তানি সম্ভব হচ্ছে না।

সরকারের প্রাথমিক হিসাবে বাংলাদেশের সোনার বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৪০ টন। তবে প্রকৃত চাহিদা নিরুপণে সরকারের সমীক্ষা প্রয়োজন। বৈধভাবে সোনার চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে বড় বাধা কাঁচামালের উচ্চমূল্য, অতিরিক্ত উৎপাদন ব্যয়, শিল্প সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতির উচ্চ আমদানি শুল্ক। বর্তমানে জুয়েলারি শিল্পের প্রায় সব ধরনের পণ্য ও যন্ত্রপাতির আমদানি শুল্ক ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ, যা স্থানীয় অন্যান্য শিল্পে আরোপিত শুল্কের চেয়ে অনেক বেশি। এতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

পাশাপাশি ৫ শতাংশ হারে উচ্চ ভ্যাট হার ও অতিরিক্ত উৎপাদন খরচের কারণে ভোক্তা পর্যায়ে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে দামের পার্থক্য হচ্ছে। এতে ক্রেতা হারাচ্ছেন জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ছোট ছোট জুয়েলারি ব্যবসায়ী। বাংলাদেশের মহান স্থাপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মাণে ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ভিশন ২০৪১ সফল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাজুসের প্রেসিডেন্ট সায়েম সোবহান আনভীরের নেতৃত্বে আমরা বদ্ধপরিকর।

Advertisement

আগামী দিনে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জাগরণ তুলতে চায় জুয়েলারি শিল্প। বর্তমানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জুয়েলারি শিল্পে আনুমানিক ৪৪ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। আগামীতে এই শিল্পে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সম্ভব। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে জুয়েলারি শিল্পে ভ্যালু এডিশন করে সোনার অলঙ্কার রপ্তানি সম্ভব। দুবাই যেমন সোনার ব্যবসার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশেও এই সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সম্ভাবনার বাস্তবায়নে জুয়েলারি শিল্পে ৩ শতাংশ ভ্যাট ও করমুক্ত সুবিধা চাই। সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশ গড়তে জুয়েলারি শিল্পে সব সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই।

লেখক: ভাইস-প্রেসিডেন্ট-বাজুস।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম