মৎস্যভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চল। জেলার ৬৪ হাজার ৩০৬ হেক্টর আয়তনের ১২২টি ছোট-বড় হাওর থেকে প্রতি বছর মেলে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ২২ হাজার মেট্রিক টন মাছ। এছাড়া প্রচুর শামুক-ঝিনুক উৎপন্ন হয় এ হাওরাঞ্চলে, যা প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ।
Advertisement
তবে প্রতি বছরই হাওরের মাছ কমছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, স্থায়ী অভয়াশ্রম না থাকায়, হাওরে ক্ষতিকর চায়না জালের ব্যবহার, পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ নিধন, ইজারা প্রথা, সেচ দিয়ে মাছ শিকার, জমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার ও হাওর পানিশূন্য হয়ে পড়ায় ক্রমেই এ মৎস্যভাণ্ডারে মাছের উৎপাদন কমছে। প্রতিবছরই মাছের পরিমাণ কমে যাওয়াকেও আশঙ্কাজনক হিসেবে দেখছেন তারা।
এ হাওরগুলোতে মাছ ধরে জীবিকানির্বাহ করে হাজারো জেলে পরিবার। ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে জীবিকানির্বাহের তাগিদে জেলেরা দিনরাত হাওরে মাছ ধরেন। কেউ ডিঙি নৌকা নিয়ে কেউ ইঞ্জিনচালিত ট্রলার নিয়ে মাছ ধরেন। তবে দিন দিন হাওরে মাছের পরিমাণ কমে যাওয়ায় চিন্তিত তারা। বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন অনেকেই। মাছের প্রজাতির বিলুপ্তি ঠেকাতে ও উৎপাদন বাড়াতে অবশ্যই পোনা এবং ডিমওয়ালা মাছ নিধন বন্ধ করতে হবে। সেইসঙ্গে ক্ষতিকর চায়না জালের ব্যবহার, ইজারা প্রথা, সেচ দিয়ে মাছ শিকার, জমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহারের বন্ধ করতে হবে এমনই দাবি স্থানীয় জেলেদের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবেশগত কারণে হাওরে মাছের প্রজনন সমস্যা হচ্ছে। অনেক প্রজাতির মাছ এরই মধ্যে বিলুপ্তি হয়েছে। আরও অনেক প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। এছাড়া মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার, সেচে মৎস্য নিধন, নির্বিচারে পোনা মাছ নিধনও হাওরে মাছ উৎপাদন কমে যাওয়ার জন্য দায়ী।
Advertisement
কিশোরগঞ্জ মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, কিশোরগঞ্জের হাওরে ৮০ থেকে ১২০ প্রজাতির দেশীয় মাছ পাওয়া যায়। হাওরে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে এবছর জেলায় ৪৫টি বিলে নার্সারি করা হচ্ছে। যেখানে এক থেকে দেড় মাস বয়সী মাছের পোনা লালনপালন করে পুরো বিলে ছাড়া হবে। জেলেদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। হাওরে ক্ষতিকর চায়না জালের ব্যবহার, পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ নিধন, সেচ দিয়ে মাছ শিকার ও জমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন স্থানীয় কর্মকর্তারা। এগুলো ঠেকাতে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে।
লালচান নামে হাওরের এক জেলে বলেন, আমি হাওরে ৩০ বছর মাছ ধরে জীবিকানির্বাহ করি। দিন দিন হাওরে মাছ কমে যাচ্ছে। এর মূল কারণ চায়না জাল। এই জাল দিয়ে মাছ ধরলে ছোট মাছও ধরা যায়। এই জালের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। হাওরে মাছের উৎপাদন বাড়াতে মৎস্য অভয়াশ্রমের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। তাহলে আমাদের জেলেদের জীবনমানের উন্নয়নের পাশাপাশি গোটা দেশের মানুষের মাছের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে হাওরের মাছ।
আল ইসলাম নামে এক জেলে বলেন, প্রকৃত জেলেদের মধ্যে জলমহাল ইজারা দিতে হবে। মৎস্য সমবায় সমিতিগুলোতে প্রতীকী নাম ব্যবহার করে একশ্রেণির অসাধু লোক জলমহাল ইজারা নিয়ে আড়ালে জলমহালের সুবিধা ভোগ করে। অর্থ দিয়ে জলমহালের মালিক বনে যায়। এতে প্রকৃত জেলেরা লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হন। এগুলো বন্ধ করতে হবে। হাওরের জমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। তাহলে হাওর আবার মাছে ভরে উঠবে।
জেলে আবু সাঈদ বলেন, বৈশাখ থেকে আষাঢ় মাস এই তিন মাস প্রতিবছর মাছ ধরা বন্ধ রাখতে পারলে অনেকাংশে মাছের বংশবিস্তার বৃদ্ধি পাবে। কারণ এ সময় মাছ ডিম ছাড়ে। মৎস্য আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই, এটিরও বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলে হাওরের মাছ বাড়বে।
Advertisement
জেলে সুকুমার বলেন, পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ ধরা বন্ধ করতে হবে। ইজারা প্রথা ও সেচ দিয়ে মাছ ধরাও বন্ধ করতে হবে। ইদানীং হাওরের পরিবেশ দূষণ বেড়েছে। পরিবেশ দূষণের কারণে হাওরের মাছ কমে যাচ্ছে। হাওরে মাছ ঠিকমতো ডিম দিচ্ছে না দূষণের কারণে। এগুলো বন্ধ না করতে পারলে হাওর এক সময় মাছশূন্য হয়ে পড়বে।
সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ গত বছর তার নিজ হাওর উপজেলা মিঠামইন সফরে এক মতবিনিময় সভায় হাওর এলাকায় মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত মাছের প্রজননের প্রাক্কালে মাছ না ধরার আহ্বান জানান। আবদুল হামিদ বলেছিলেন, মাছের পোনা ডিম নষ্ট করা না হলে হাওর এলাকায় মাছের পরিমাণ বৃদ্ধি পেত। স্থানীয় প্রশাসনকে কারেন্ট জাল এবং মাছ ধরা নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণেরও আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি।
করিমগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নাসিরুল ইসলাম খান আওলাদ বলেন, হাওরে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে প্রতি বছরই সরকারিভাবে মাছ ছাড়া হয়। এই ছোট মাছগুলোই আমাদের কিছু জেলে চায়না জাল দিয়ে ধরে ফেলে। অবৈধ কারেন্ট জাল ব্যবহার করে মাছ ধরা বন্ধ করতে পারলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি হবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণেও হাওরে মাছের উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিপন কুমার পাল বলেন, বিভিন্ন কারণে হাওরে মাছের উৎপাদন কম হচ্ছে। পরিবেশ দূষণ, সময়মতো বৃষ্টি না হওয়া, কারেন্ট জালের ব্যবহার ও সম্প্রতি চায়না দোয়ারি জালের ব্যবহারের কারণে হাওরের মাছের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। কারেন্ট জাল ও চায়না জালের বিরুদ্ধে আমরা অভিযান চালাচ্ছি। যারা বিল ইজারা নেন তারা যেন বিল সেচে মাছ না ধরে সেই প্রচারণা চালাচ্ছি। প্রাকৃতিক মাছের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য মৎস্য আইন বাস্তবায়নে কাজ করছি।
তিনি বলেন, অভয়াশ্রম স্থাপন করা জরুরি। সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। জলমহাল প্রকৃত জেলেরা অর্থাৎ নিবন্ধিত জেলেরা পাচ্ছে কি না তা আমরা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। এছাড়া হাওরে মাছের উৎপাদন ধরে রাখতে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড হাতে নিয়েছে জেলা মৎস্য বিভাগ।
এসকে রাসেল/এমআরআর/এমএস