জাতীয়

ভেস্তে গেছে সব পদক্ষেপ, নতুন উদ্যোগে আশা

বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বাড়ায় ২০১৬ সালের মে মাসে বজ্রপাতকে দুর্যোগ ঘোষণা করে সরকার। প্রতি বছরই শত শত মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে বজ্রপাতে। কিন্তু বজ্রপাত মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি সরকার। বজ্রপাতপ্রবণ জেলাগুলোতে অনেকদিন ধরে কর্মসূচি নেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করা হলেও তা আলোর মুখে দেখেনি। তালগাছ লাগানোর কর্মসূচিও বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। এরই মধ্যে নেওয়া হচ্ছে আরেকটি প্রকল্প, যা নতুন করে আশা দেখাচ্ছে।

Advertisement

আবহাওয়া ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা জানান, আবহাওয়ার ধরন বদলে যাওয়া, পরিবেশ দূষণ, গাছ কেটে ফেলাসহ নানান কারণে দেশে বজ্রপাত বেড়ে গেছে। এতে মৃত্যুও বাড়ছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ রোল মডেল, কিন্তু আমরা বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকাতে পারছি না। প্রতি বছর শত শত কৃষক, গরিব প্রান্তিক মানুষ মারা যায়, কিন্তু সরকার কিছু করতে পারছে না। বজ্রপাতে মৃত্যু রোধে বহুদিন ধরে একটি প্রকল্প নেওয়ার চেষ্টা করা হলেও নানান প্রতিবন্ধকতায় তা এখনো নেওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন>> ১৩ মাসে বজ্রপাতে ৩৪০ মৃত্যু, অধিকাংশই কৃষক

Advertisement

গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচির (টিআর) টাকা দিয়ে বজ্র নিরোধক দণ্ড ও বজ্র নিরোধক যন্ত্র (লাইটেনিং অ্যারেস্টার) স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সফল হয়নি তা। কোনো ফলাফল না পাওয়ায় বজ্রপাত ঠেকাতে তালগাছ রোপণের কর্মসূচিও বাতিল করা হয়।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বজ্রপাতে মৃত্যু প্রতিরোধে ২০২০ সালে একটি প্রকল্প নেওয়ার উদ্যোগ নেয় মন্ত্রণালয়। তখন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বলেছিল যেহেতু প্রকল্পের ব্যয় অনেক বেশি, তাই একটি ফিজিবিলিটি স্টাডি (সম্ভাব্যতা যাচাই) করে সেই প্রতিবেদনসহ জমা দিতে হবে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কোনো তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে ফিজিবিলিটি স্টাডি করার জন্য বলে। পরে মন্ত্রণালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাডির প্রতিবেদনসহ ২০২২ সালে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। তখন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে পরিকল্পনা বিভাগ এ বিষয়ে পরবর্তীসময়ে সিদ্ধান্ত জানাবে বলে আমাদের জানায়।

পরে বজ্রপাতে মৃত্যু বেড়ে গেলে গত এপ্রিল মাসে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়। মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও সচিব এ বিষয়ে জোরালো তদবির করেন। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়, বজ্রপাতে প্রচুর লোক মারা যাচ্ছে। এখন বন্যা বা সাইক্লোনেও মৃত্যু প্রায় শূন্যের কোটায় নেমেছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ রোল মডেল হলেও বজ্রপাতের মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না। চিঠি দিয়ে তাদের প্রকল্পটি প্রক্রিয়ার মধ্যে নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। পরে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় জানায়, প্রকল্পটি আগামী অর্থবছর সবুজ পাতায় এলে তখন এটা প্রক্রিয়ার মধ্যে নেবে।

সবুজপাতা হচ্ছে দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার দলিল, যেখানে সরকার আগামী অর্থবছরে কী কী নতুন প্রকল্প নেবে সেটার তালিকা থাকে। এ প্রকল্পগুলো একনেক অনুমোদন করে। সবুজ পাতায় না এলে উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে সরকার বিবেচনায় নেয় না।

Advertisement

আরও পড়ুন>> ঝড়-বজ্রপাত ও দুর্যোগে কী করবেন?

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অনুবিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানান, বজ্রপাতপ্রবণ ১৫ জেলায় মৃত্যু ঠেকাতে এ প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ২৩২ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় বজ্রপাতপ্রবণ এলাকায় এক ডেসিমেল জায়গায় কংক্রিটের শেল্টার করা হবে। বজ্রপাতের সময় মাঠে কাজ করা বা খোলা জায়গায় থাকা মানুষ সেখানে আশ্রয় নেবে। এক কিলোমিটার অন্তর অন্তর নির্মাণ করা হবে একেকটি শেল্টার। একই সঙ্গে বসানো হবে বজ্র নিরোধক যন্ত্র, এসব যন্ত্র ১০০ মিটার এলাকা বজ্রপাত থেকে সুরক্ষা দেবে। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় ১৫ জেলায় বজ্রপাতের ৩০ থেকে ৪০ মিনিট আগে মানুষের মোবাইল ফোনে সতর্ক করে মেসেজ যাবে।

এ প্রকল্পের আওতায় বজ্রপাত থেকে বাঁচতে জনসচেতনতা বাড়ানোর কাজ করা হবে বলেও জানায় ত্রাণ মন্ত্রণালয়।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন, অডিট, এনডিআরসিসি) এবিএম সফিকুল হায়দার জাগো নিউজকে বলেন, ‘বজ্রপাতে মৃত্যু রোধে আমাদের উদ্যোগ আছে। আমরা একটি প্রকল্প নিয়েছি। প্রকল্পটি ফাইনাল স্টেজে রয়েছে। এটি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের মাধ্যমে আমরা ফিজিবিলিটি স্টাডি করিয়েছি। তারা পজিটিভ মতামত দিয়েছে। প্রকল্পটি আমাদের পর্যায়ে গোছানো কমপ্লিট। যাচাই-বাছাই কমিটির মিটিং হয়েছে। এখন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলে আমরা প্রকল্পটি শুরু করতে পারবো। প্রকল্পের মোট ব্যয় এক হাজার ২৩২ কোটি টাকার মতো।’

তিনি বলেন, ‘বজ্রপাতপ্রবণ ১৫টি জেলায় এটি বাস্তবায়ন করা হবে। এটি একটি পাইলট প্রজেক্ট। এ প্রকল্পের মূল বিষয় হলো প্রকল্প এলাকায় কংক্রিটের শেড নির্মাণ করা হবে। আকাশে মেঘ হলে মাঠে কাজ করা কৃষকরা সেখানে আশ্রয় নেবেন। এছাড়া আমরা বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন করবো। একই সঙ্গে বজ্রপাত হওয়ার আগে নিরাপদে থাকার জন্য প্রকল্প এলাকার মানুষের কাছে সতর্কবার্তা পাঠানো হবে।’

আরও পড়ুন>> সতর্কতার অভাবেই বজ্রপাতে মৃত্যু বাড়ছে

সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, নওগাঁ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, কিশোরগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জামালপুর, ময়মনসিংহ এ ১৫ জেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে বলেও জানান অতিরিক্ত সচিব।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব (পরিকল্পনা-৩) আবু ইউসুফ মোহাম্মদ রাসেল বলেন, ‘বজ্রপাতে মৃত্যু রোধে নেওয়া প্রকল্পটি এখন পরিকল্পনা কমিশনে আছে। এটি যাতে দ্রুত নেওয়া হয়, সেজন্য আমাদের মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কারণ বজ্রপাতে বিপুল সংখ্যক মানুষ মারা যাচ্ছে। প্রকল্পটি সবুজ পাতায় নিয়ে প্রসেস করার জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে।’

‘প্রকল্পের আওতায় ১৫টি জেলায় এক ডেসিমেল জায়গার ওপর সেফ শেল্টার করা হবে। সেখানে গিয়ে কৃষকরা বসবেন। আর খোলা জায়গা লাইটেনিং অ্যারেস্টার বসাবো। অ্যারেস্টার একশ মিটার এলাকা কাভার করবে।’

তিনি বলেন, ‘এ প্রকল্পের আরেকটি মেজর কম্পোন্ট হলো আর্লি ওয়ার্নিং। সব করলাম মানুষ যদি না জানে, কৃষক যদি কাজ করতেই থাকে, তবে তো লাভ হবে না। তাই বজ্রপাত হওয়ার আগে তাদের মোবাইলে একটা মেসেজ যাবে যে বজ্রপাত হতে পারে, আপনি নিরাপদ আশ্রয়ে যান।’

উপ-সচিব আরও বলেন, ‘এছাড়া এ প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণের বিষয়টিও থাকবে। স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের আমরা বজ্রপাতের ওপর ট্রেনিং দেবো।’

প্রতি বছর মরছে মানুষদুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বজ্রপাতে ২০১১ সালে ১৭৯ জন, ২০১২ সালে ২০১ জন, ২০১৩ সালে ১৮৫ জন, ২০১৪ সালে ১৭০ জন, ২০১৫ সালে ২২৬ জন, ২০১৬ সালে ৩৯১ জন মারা যান।

এছাড়া ২০১৭ সালে ৩০৭ জন, ২০১৮ সালে ৩৫৯ জন, ২০১৯ সালে ১৫৮ জন, ২০২০ সালে ২৫৫ জন, ২০২১ সালে ৩৬৩, ২০২২ সালে ৩৩৭ জন বজ্রপাতে মারা গেছেন।

চলতি বছর এ পর্যন্ত ৮০ জনেরও বেশি মারা গেছেন বলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়। গত ৪ মে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঝড়বৃষ্টির সময় বজ্রপাতে সাতজনের মৃত্যু হয়। ১৭ মে ১৪টি গরুসহ একজন খামারিও মারা যান। এরপর ২৩ মে একদিনে বজ্রপাতে মারা যান ১৩ জন।

দুর্নীতিতে উদ্যোগ মাটিবজ্রপাত রোধে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও দুর্নীতির কারণে তা সফল হয়নি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের (টিআর) নীতিমালা সংশোধন করে বজ্রপাত থেকে প্রাণহানি রোধে ১৫টি জেলায় ‘বজ্র নিরোধক দণ্ড, বজ্র নিরোধক যন্ত্র (লাইটনিং অ্যারেস্টার)’ স্থাপনে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় মন্ত্রণালয়। কিন্তু লুটপাট হয়ে যায় এ অর্থ। টাকা খরচ দেখানো হলেও অনেক জায়গায় বসেনি কোনো বজ্র নিরোধক দণ্ড ও বজ্র নিরোধক যন্ত্র। এ নিয়ে বহু চিঠি চালাচালি ও তদন্তও করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। বজ্রপাত রোধে এক কোটি তালগাছ রোপণের কর্মসূচি হাতে নেয় সরকার। অনিয়ম ও দুর্নীতিতে এ উদ্যোগও মাঠে মারা যায়।

গত বছরের ১১ মে সচিবালয়ে বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম আয়োজিত ‘দুর্যোগ মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত আমরা’ শীর্ষক সংলাপে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান তালগাছ লাগানোর কর্মসূচি বাতিল করার কথা জানান। প্রতিমন্ত্রী বলেন, ৩৮ লাখের মতো তালগাছ লাগানোর পর দেখা গেলো, যত্নের অভাবে মারা যাচ্ছে। তাই এটা বাতিল করে দিয়েছি। আর একটি তালগাছ বড় হতে ৩০ থেকে ৪০ বছর সময় লাগে। তাই এটি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান মনে হচ্ছে না।

আরএমএম/এএসএ/জেআইএম