জাতীয়

ঢাকায় তাপদাহের প্রধান কারণ সবুজায়ন কমে যাওয়া

চলতি বছর দেশে গরমের মাত্রা বেশি। তীব্র তাপদাহে জনজীবন অতিষ্ঠ। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবন চরম কষ্টের মধ্যে যাচ্ছে, এমনকি প্রচণ্ড গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। তীব্র তাপদাহ থেকে বাঁচতে বৃক্ষরোপণের কোনো বিকল্প নেই। তবে বাড়তি জনসংখ্যার কর্মসংস্থান ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে উন্নয়নের প্রয়োজন। এই উন্নয়নের দোহাই দিয়ে বৃক্ষ নিধনও চলছে জোরেশোরে।

Advertisement

এর সমাধান কী, তা নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের ডিন ও চেয়ারম্যান, বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফুল হক মিঠু।

জাগো নিউজ: ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র তাপদাহ অনুভূত হচ্ছে? যা অনেকটা অস্বাভাবিক। এর কারণ কী? বৃক্ষ নিধন না করেও কী উন্নয়ন সম্ভব?

ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার: সাম্প্রতিক সময়ে যে তাপদাহ দেখা যাচ্ছে তা আসলে দীর্ঘদিনের পরিবেশ ধ্বংসের একটি ফলাফল। দীর্ঘদিন ধরে তাপমাত্রার এই পর্যায়ক্রমিক বৃদ্ধির ফলে বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তাপদাহের প্রধান কারণ ঢাকার সবুজায়ন কমে যাওয়া। গাছপালা কার্বন-ডাই অক্সাইড ও তাপ শোষণ করে অক্সিজেন সরবরাহ করে। ফলে বাতাসে অক্সিজেন ছড়িয়ে আশপাশের এলাকা শীতল হয়।

Advertisement

শহরের সৌন্দর্যবর্ধনের নামে সড়ক বিভাজনের বড় গাছগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। এ কারণে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন ও জলীয়বাষ্প কমে গিয়ে বাড়ছে তাপমাত্রা। একই কারণে বৃষ্টিপাতও কমে যাচ্ছে। জলাধার কমে যাওয়াও তাপমাত্রা বাড়ার অন্যতম কারণ। এছাড়া জনসংখ্যা, শিল্প-কারখানা, যানবাহন, ভবন, গ্লাস নির্মিত ভবন বৃদ্ধি, অস্বাভাবিক যানজট ইত্যাদি কারণেও তাপদাহের মাত্রা বাড়ছে। বর্তমান নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় অপরিকল্পিত উন্নয়ন কার্যক্রমই তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য বেশি দায়ী।

গাছ না কেটেও উন্নয়ন সম্ভব। কোনো উন্নয়ন প্রকল্প নকশা করার আগেই গাছের কথা বিবেচনা করতে হবে। গাছ প্রকল্পে রেখেই নকশা করা সম্ভব। প্রকল্প এলাকায় যদি কোনো গাছ পড়ে যায়, সেটি স্থানান্তরের ব্যবস্থা করতে হবে। এটা উন্নত দেশগুলোতে করা হয়। আর যদি গাছ স্থানান্তর সম্ভব না হয় তাহলে প্রত্যেকটি গাছের বায়োমাস ও ইকোলজিক্যাল ভ্যালু মূল্যায়ন করে নতুন করে বৃক্ষায়ন করতে হবে।

জাগো নিউজ: ‘হিট আইল্যান্ড ইফেক্ট’ নগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য কতটা দায়ী? সবুজায়ন হিট ওয়েভ বা তাপদাহ প্রতিরোধে কতটা সক্ষম?

ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার: ঢাকার পিচঢালা রাস্তা দিনের বেলা উত্তপ্ত হয়, যা রাতের প্রথমভাগ পর্যন্ত তাপ ধারণ করে। তারপর রাতে রাস্তা থেকে তাপমাত্রা নির্গমন হয়, তখন এটা নগরের তাপ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।

Advertisement

নতুন করে তৈরি বহুতল ভবনগুলোতে অতিরিক্ত গ্লাস ও এসির ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে। কাচে ধারণ করা তাপ ও এসি থেকে নিঃসৃত তাপ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে শহরের তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। একটি বিশাল অংশের মানুষ রান্নার কাজে কাঠ পোড়ায়। নগরীতে প্রায় ২০ লাখ পরিবার রয়েছে যাদের ২০ লাখ চুলায় গড়ে প্রতিদিন প্রায় তিন ঘণ্টা করে রান্নার কাজ চলে। বাতাসে অবস্থিত ধুলিকণা ও দূষিত গ্যাসের তাপ শোষণ করার ক্ষমতা থাকার কারণে বর্তমানে অত্যধিক দূষিত বায়ুতে অবস্থিত ধুলিকণা এবং গ্যাসীয় পদার্থগুলো সূর্যের তাপমাত্রাকে শোষণ করে তাপপ্রবাহ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে।

এছাড়া সালফার-ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন মোনো অক্সাইড, কার্বন-ডাই অক্সাইড তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। এভাবে হিট আইল্যান্ড ইফেক্ট তাপমাত্রাকে বায়ুমণ্ডলে আবদ্ধ করে রেখে নগরের তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে।

তাপদাহ কমাতে শহরের প্রতিটি ফাঁকা স্থানে গাছ লাগাতে হবে। রাস্তার বিভাজকে শোভাবর্ধনকারী গাছ ছাড়াও ভূমির ধরনের ভিত্তিতে বিভিন্ন রকম উপকারী বৃক্ষ রোপণ করতে হবে। বাড়াতে হবে ছাদবাগান। জলাভূমির পরিমাণও বাড়াতে হবে। উদ্ধার করতে হবে দখল করা জলাভূমি। প্রয়োজনে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করে এর পরিবর্তে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। অবকাঠামো নির্মাণের সময়ও সচেতন হতে হবে এবং একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে নির্মাণ করতে হবে ভবন।

গাছপালা কার্বন-ডাই অক্সাইড ও তাপ শোষণ করে অক্সিজেন সরবরাহ করে। ফলে বাতাসে অক্সিজেন ছড়িয়ে আশপাশের এলাকা শীতল রাখে। বন উজাড় করায় বৃক্ষ কমে গিয়ে এখন অক্সিজেন, জলীয়বাষ্প কমে গিয়ে তাপমাত্রা বেড়েছে। একই কারণে বৃষ্টিপাতও কমে গেছে।

জাগো নিউজ: সবুজায়নে বাধা কোথায়? উন্নত দেশ তাপদাহ কমাতে কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে?

ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার: রাজধানীর ৩৬টি স্থান নিয়ে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে। এতে দেখা যায়, যে এলাকায় সবুজের উপস্থিতি রয়েছে সেখানে তাপমাত্রা তুলনামূলক কম। নয়টি স্থানে তাপমাত্রা বেশি ছিল। কারণ সেখানে গাছপালা কম। নয়টি স্থানে গাছ বেশি থাকায় তাপমাত্রাও কম ছিল। বাকি ১৮টিতে মধ্যমানের তাপমাত্রা ছিল। সবচেয়ে কম তাপমাত্রা ছিল বোটানিক্যাল গার্ডেন ও জাতীয় চিড়িয়াখানায়। দ্বিতীয় কম তাপমাত্রার অন্য এলাকাগুলো ছিল, রমনা পার্ক, ধানমন্ডি লেক পাড়, ক্যান্টনমেন্টসহ কিছু এলাকা। সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রার এলাকা ছিল তেজগাঁও, মতিঝিল, মিরপুর, যাত্রাবাড়ীসহ কিছু বাণিজ্যিক এলাকা। এগুলোতে তিন থেকে সাড়ে তিন ডিগ্রি তাপমাত্রার তারতম্য ছিল। এতেই প্রমাণিত হয়, বৃক্ষ তাপমাত্রা কম কিংবা বৃদ্ধির অন্যতম উৎস।

অপরিকল্পিত নগরায়ণ সবুজ নগরী গড়তে প্রথম বাধা। যত্রতত্র ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। মানুষের সচেতনতার অভাব, নগরের দায়িতপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ ও জনসাধারণের কাজের সমন্বয়ের অভাব এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে নগরীর সবুজায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

ইউরোপের দেশগুলোর নগরগুলোতে তাপমাত্রা সহনীয় রাখতে টেকসই নগর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, অধিক পরিমাণে জলাভূমি এবং প্রতিফলিত পৃষ্ঠ যুক্তকরণের মাধ্যমে শহরের স্থাপত্য পরিবর্তন করা, অধিক পরিমাণে বৃক্ষরোপণ করা, গ্রীষ্মের জন্য অস্থায়ী অনাবাসিক স্থান তৈরি করার মতো পদক্ষেপ নেয়। এছাড়া প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলা এবং শূন্য বর্জ্য অনুসরণ করা, পরিবহন ব্যবস্থা টেকসই করা, কার্বন-ডাই অক্সাইডকে ব্যয়বহুল করে তোলা, রাস্তা ও ছাদকে সবুজ করে গড়ে তোলা প্রভৃতি কর্মকাণ্ড তাপদাহ নিয়ন্ত্রণে রাখে।

জাগো নিউজ: রাজধানীতে আরবান ওয়াসিস গড়ে তোলা সম্ভব?

ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার: জনবহুল নগরীর আবাসিক এলাকাগুলোতে এবং বড় বড় ভবনগুলোর দেওয়ালে বৃক্ষরোপণ তথা আরবান ওয়াসিস গড়ে তোলা সম্ভব। ধানমন্ডি, লালমাটিয়া, মহাখালী ডিওএইচএস এবং উত্তরার আবাসিক ভবনগুলোতে ছাদবাগান করার মাধ্যমে ঢাকায় সবুজের পরিমাণ বাড়ানো যায়। ভবন ডিজাইন করার সময় আরবান ওয়াসিসের কথা মাথায় রেখে ডিজাইন করা দরকার। অপরিকল্পিত ছাদবাগান ভবনের ক্ষতি করতে পারে। ছাদ স্যাঁতসেঁতে হয়ে যেতে পারে, অপরিষ্কার বাগানে মশা ও পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়ে পেতে পারে।

জাগো নিউজ: চিফ হিট অফিসার নগরের তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখতে কী ধরনের ভূমিকা রাখতে পারবেন?

ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার: চিফ হিট অফিসার রাজধানীসহ সমগ্র দেশের তাপমাত্রার রেকর্ড রাখবেন। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নেবেন এবং এই লক্ষ্যে কাজ করবেন। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা বাড়াতে তিনি বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক পদক্ষেপ নিতে পারেন।

বিভিন্ন সেমিনার ও বৈঠকের আয়োজন করতে পারেন, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন, তথ্যচিত্র ইত্যাদি প্রচারের ব্যবস্থা করতে পারেন। এছাড়া তাপমাত্রা বাড়ার কারণ ও নিয়ন্ত্রণে করণীয় পর্যালোচনা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে একত্রিত হয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন। চিফ হিট অফিসার নিয়োগ একটি ফলপ্রসূ কার্যক্রম এবং প্রতিটি জেলায়ই হিট অফিসার নিয়োগ করা প্রয়োজন।

জাগো নিউজ: রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধে করণীয় কী?

ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, পৃথিবীর প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ বায়ুদূষণের শিকার হচ্ছে। মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ বিশুদ্ধ বায়ু পাচ্ছে। সবার আগে দূষণের উৎসগুলো চিহ্নিত করে দূষণ কমিয়ে আনতে হবে। বৃক্ষরোপণের পাশাপাশি ঢাকার আশপাশের ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

আগুনে পোড়ানো লাল ইটের বিকল্প সিমেন্ট-বালুর ব্লক ইটের ব্যবহার বাড়াতে হবে। ইটভাটাগুলোতে উন্নত ও দূষণমুক্ত প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। এছাড়া বন্ধ করতে হবে মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি চালানো। সপ্তাহের ভিন্ন দিনে জোড়-বিজোড় পদ্ধতিতে গাড়ি চলার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ফিটনেসবিহীন যানবাহন ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

পাশাপাশি সমন্বয়হীনভাবে রাস্তার খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করতে হবে। সেবাদানকারী সংস্থার সংস্কার কাজে সমন্বয় এনে স্বল্প সময়ে শেষ করতে হবে সংস্কার। নির্মাণসামগ্রী উন্মুক্তভাবে ফেলে রাখা যাবে না। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে। যাতে যেখানে সেখানে নগর বর্জ্য বা কৃষিবর্জ্য উন্মুক্তভাবে পোড়ানো না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে।

জাগো নিউজ: আপনাকে ধন্যবাদ।

ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার: জাগো নিউজকেও ধন্যবাদ।

এসএম/এএসএ/এমএস