প্রতিনিয়ত নানাভাবে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। কলকারখানার বর্জ্য, প্লাস্টিকের অত্যধিক ব্যবহার, অযথা গাড়ির হর্ন বাজানো, বাতাসে বিষাক্ত জীবাণুর মিশ্রণসহ নানা কারণে পরিবেশের স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিঘ্নিত হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে মানুষের ওপর। পরিবেশ দূষণের ফলে নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে দেশের মানুষ। পরিবেশ দূষণের কারণ ও তা থেকে উত্তরণের বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রোমেল আহমদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের শাবিপ্রবি প্রতিনিধি নাঈম আহমদ শুভ-
Advertisement
জাগো নিউজ: প্রতিদিন নানাভাবে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে আপনি কোন বিষয়কে দায়ী মনে করছেন?
অধ্যাপক রোমেল আহমদ: পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে আমাদের অনেক শঙ্কা। এর মূল কারণ হচ্ছে মানুষের বিলাসী জীবনের প্রতি আকাঙ্ক্ষা। অল্প সময়ের মধ্যে বেশি আরামের ফসল হচ্ছে আজকের পরিবেশ দূষণের কারণ। প্লাস্টিকের ব্যবহার, অতিরিক্ত সার ব্যবহার, বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিকস ব্যবহার, পাবলিক গাড়ির পরিবর্তে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার, নদী দখল, বন দখল, নগরায়নসহ বেশ কয়েকটি কারণ আমাদের পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ বলে আমি মনে করছি।
জাগো নিউজ: পরিবেশ দূষণ কীভাবে জীববৈচিত্র্যকে প্রভাবিত করছে?
Advertisement
অধ্যাপক রোমেল আহমদ: পরিবেশে শুধু মানুষ নয়, অনেক ধরনের জীবের অস্তিত্ব রয়েছে। অনেক জীব আমরা চোখে দেখি, অনেকগুলো দেখি না। যা চোখে দেখি না তাদের সংখ্যা অসংখ্য। বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া রয়েছে যেগুলো মানুষের জীবন রক্ষা করছে। পরিবেশ দূষণের কারণে যেসব জীব আমরা দেখি না সেগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অতিরিক্ত জীবাণুনাশক ব্যবহার ও অতিরিক্ত পলিথিন ব্যবহারের ফলে তাদের বসবাসের পরিবেশ ধ্বংস করছি। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। সব ধরনের জীবকে নিয়েই জীববৈচিত্র্য গঠিত। পরিবেশ দূষণের ফলে এ জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে রয়েছে।
জাগো নিউজ: প্রতিনিয়ত মানুষের নানামুখী কর্মের কারণে ভয়াবহ মাত্রায় পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। এর ভবিষ্যৎ ফলাফল কী?
অধ্যাপক রোমেল আহমদ: মানুষের বিপর্যয় হবে। মানুষের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। আমরা যদি একটু তাকাই তাহলে দেখতে পাই আমাদের রোগব্যাধির কোনো অভাব নেই। আমরা মেডিকেল সায়েন্স জয় করেছি। আমরা খাদ্য ঘাটতি পূরণ করেছি কিন্তু আমরা সুখী না। একসময় সুখী মানুষের অভাব ছিল না। তিনবেলা খেতে পারতো না তবুও সুখী ছিল। কিন্তু এখন তিনবেলা খেতে পারলেও সুখ নেই। পরিবেশ দূষণের ফলে বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধি আমাদের আক্রমণ করছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে। আমাদের আবাসস্থল এমনও হতে পারে যেখানে বসবাস করা উপযোগী থাকবে না। এছাড়া ফসলের কথা বললে এরইমধ্যে অনেক ফসল আছে যেগুলো আগে বেশি করে ফলতো কিন্তু তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এর উৎপাদন কমে গেছে। পরিবেশ দূষণের ফলে মানুষের সুপেয় পানির অভাব মারাত্মক হবে। এখনো যদি দেখি আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে সুপেয় পানির সংকট। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ আরও মারাত্মক হবে।
জাগো নিউজ: পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় একটি ভূখণ্ডের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন পরিবেশবাদীরা। মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশের বনভূমির পরিমাণ মোট ভূখণ্ডের ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ যা দেশের জন্য হুমকিস্বরপ। পরিবেশ দূষণ রোধে বনায়নের গুরুত্ব কতটুকু এবং বনায়ন বৃদ্ধিতে আমাদের করণীয় কী?
Advertisement
অধ্যাপক রোমেল আহমদ: বাংলাদেশে বনভূমি কতটুকু আছে সেটা কোথাও বলা হয় ১৭ শতাশ, কোথাও ১৬ শতাংশ আবার কোথাও ১৫ শতাংশ। আসলে বাংলাদেশে সে পরিমাণ বনভূমি নেই। দেশে বর্তমানে সাড়ে ৮ থেকে ১০ শতাংশ বনভূমি রয়েছে। বাংলাদেশে সরকারির চেয়ে বেসরকারি বনভূমি অনেক বেশি। আমাদের দেশের প্রতিটি এরিয়ায় নার্সারির উন্নয়ন হয়েছে। মানুষ আগে বাড়িতে কাঁঠাল গাছ লাগাতো না কিন্তু এখন লাগায়। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ফলদ ও বনজ গাছ মানুষ বাসাবাড়িতে লাগিয়ে থাকে। মানুষ যদি সচেতন হয় এবং সরকারের পরিবেশ সংক্রান্ত যেসব আইন ও নীতি আছে সেগুলো যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের দেশে ২৫ শতাংশ বনভূমি হবে। এজন্য করণীয় হচ্ছে মানুষের সচেতনতা ও পরিবেশ রক্ষায় জনসম্পৃক্ততা। এ কাজে সরকার অনেক আগেই হাত দিয়েছে। কাজটি চলমান। রাস্তাঘাট ও পতিত জায়গায় ব্যাপক হারে গাছপালা লাগাতে হবে। গাছের পরিচর্যায় কাজ করতে হবে।
জাগো নিউজ: মাটি, পানি ও বায়ূ দূষণে সাধারণ একটি কারণ প্লাস্টিক বর্জ্য যা পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ হিসেবে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে কী করা যেতে পারে?
অধ্যাপক রোমেল আহমদ: একটা সময় প্লাস্টিক ছিল না তবুও মানুষ চলাফেরা করেছে। প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে আমরা পাট ব্যবহার করতে পারি। পাটের ব্যবহার বাড়ালে এবং প্লাস্টিক উৎপাদন, বিতরণ ও বিপণন নিয়ে বাংলাদেশে যেসব আইন আছে সেসব আইন সত্যিকার অর্থে অনুসরণ করা হলে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো যেতে পারে। প্লাস্টিকের আগে মানুষ বিভিন্ন ধরনের গাছের পাতা, কাগজের প্যাকেট ব্যবহার করতো, সেগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া এখন প্লাস্টিকের বায়োডিগ্রেডেবল পণ্য আসছে সেগুলোর ব্যবহার বাড়াতে হবে। সর্বোপরি প্লাস্টিক ব্যবহারে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
জাগো নিউজ: পরিবেশ দূষণ থেকে উত্তরণের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
অধ্যাপক রোমেল আহমদ: প্রথমত, মানুষকে সচেতন হতে হবে। আমরা এখন অনেকটা সচেতন হওয়ার চেষ্টা করছি। এখনো বাজারে গেলে মানুষ দেশি মুরগি না ফার্মের মুরগির ডিম কিনবে এর খোঁজ নেয়। আসলে এটা আমাদের সচেতনতার উদাহরণ বলা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধের উপায়গুলো আমাদের মাথায় ঢুকাতে হবে। শিশু থেকে শুরু করে সবার মধ্যে ধারণ করতে হবে ‘বাঁচতে হলে পরিবেশ রক্ষা করতে হবে’। সেক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচিতে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তৃতীয়ত, সরকার প্রণীত আইনগুলো বাস্তবায়নে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের দেশে পরিবেশ সংক্রান্ত অনেক আইন রয়েছে। সেগুলোর বাস্তবায়নই পারে পরিবেশ দূষণ রোধ করতে হবে। চতুর্থত, রাজনীতির ঊর্ধ্বে গিয়ে জনগণ ও সরকারকে পরিবেশ রক্ষায় যা করা প্রয়োজন তা করতে হবে। কারণ, এটা হচ্ছে মানুষের অস্তিত্বের লড়াই। আমাদের প্রজন্মদের বাঁচাতে এটা করতে হবে।
জাগো নিউজ: পরিবেশ দূষণ রোধে সরকার এরই মধ্যে যেসব আইন প্রণয়ন করেছে সেগুলো বাস্তবায়নে সরকারের কী করা উচিত বলে মনে করছেন?
অধ্যাপক রোমেল আহমদ: আইন বাস্তবায়নে অনেক বাধা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কোথাও পাহাড় কাটা হলে পরিবেশ বিভাগকে তথ্য দিলে তারা পরিদর্শনে এসে দেখে। তারা এসে বাধা দিলে উল্টো হয়রানির শিকার হয়। সমস্যা হচ্ছে যারা পাহাড় কাটে তারা সমাজের প্রভাবশালী অংশ। এটা যে সরকারই আসুক সেই সরকারের ছত্রছায়ায়, পুলিশের ছত্রছায়ায় অথবা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছত্রছায়ায় তারা এ ধরনের কাজ করে থাকে। সরকারকে রাজনৈতিক সম্পর্ক, অর্থবিত্ত, সম্পদশালী কিংবা অন্য কোনো বিষয় এসব তোয়াক্কা না করে সবাইকে আইন লঙ্ঘনের শাস্তি দিতে হবে। জনগণকে সম্পৃক্ত করে যেকোনো আইন প্রয়োগ করতে হবে। জনগণের মুভমেন্টের কাছে কোনো আইন, কোনো নীতি টিকে থাকতে পারে না। মানুষ চাইলে একীভূত হয়ে যেকোনো কিছু করতে পারে। এক্ষেত্রে মানুষের সচেতনতা বাড়াতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে। সরকারকে জনগণের মতামত নিয়েই পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখতে হবে। সর্বোপরি, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সরকারের আলাদা একটা রাজনৈতিক ইশতেহার থাকা প্রয়োজন।
জাগো নিউজ: ধন্যবাদ আপনাকে।
অধ্যাপক রোমেল আহমদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
এসআর/এমএস