দেশজুড়ে

নদ-নদীতে বাড়ছে লবণাক্ততা, কমছে ফসলি জমি

বছরের পর বছর ধরে খুবই কম বৃষ্টিপাত, উজানের নদী থেকে পানি প্রবাহ একেবারে কমে যাওয়া এবং বঙ্গোপসাগর থেকে অধিক পরিমাণে পানি ওপরে উঠে আসায় খুলনার নদ-নদীগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছে লবণাক্ততা।

Advertisement

পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, উজান থেকে একটি নদী দিয়েই খুলনার নদ-নদীতে পানি প্রবাহিত হয়, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। অন্যদিকে সাগর থেকে একাধিক নদ-নদীর মাধ্যমে অধিক পরিমাণে লবণাক্ত পানি ওপরে উঠে আসছে। উজানের সামান্য মিঠাপানি সাগরের লবণাক্ত পানিকে মিঠাপানিতে পরিণত করতে পারছে না।

বৃষ্টিপাতের পরিমাণও ১০ বছর আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। যে কারণে প্রতিবছরই খুলনার নদ-নদীতে লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ছে। একইসঙ্গে নদ-নদীর তলদেশও ভরাট হচ্ছে।

নদ-নদীতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ফসলি জমিতেও প্রবেশ করছে লবণাক্ত পানি। এতে পতিত জমির পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে বলে জানিয়েছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা।

Advertisement

খুলনা মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, দুই দশক আগেও খুলনা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীগুলোর পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ ছিল ১০/১৪ ডিএস/মিটার (ডেসিসিমেন পার মিটার)। যা বর্তমানে বেড়ে ৩০ থেকে ৩৬ ডিএস/মিটারে দাঁড়িয়েছে।

ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অমরেন্দ্র নাথ বলেন, উজানের পানি না আসায় এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়ায় ১০ বছরের মধ্যে খুলনার নদ-নদীগুলোতে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি লবণাক্ততা বেড়েছে। যা নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে।

তিনি বলেন, সবশেষ গত মে মাসের শেষ সপ্তাহে খুলনার রূপসা নদীতে লবণাক্ততার মাত্রা পাওয়া যায় ৩২ ডিএস/মি, সাগর থেকে উঠে আসা শিবসা নদীতে ৩৬ ডিএস/মি, কাজিবাছা নদীতে ৩৫ দশমিক ২ ডিএস/মি, কপোতাক্ষ নদে ২৬ দশমিক ৩ ডিএস/মি এবং পশুর নদে সর্বোচ্চ ৩৭ ডিএস/মি। যা পাঁচ বছর আগেও ২৫-২৬ ডিএস/মি এর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এ কর্মকর্তা আরও বলেন, খুলনায় উজানের পানি আসে একটি মাত্র নদীপথে। পদ্মা নদী থেকে গড়াই, মধুমতি ও ভৈরব নদ হয়ে রূপসা নদীতে পড়ে মিঠাপানি। রূপসা হয়ে কাজিবাছা ও পশুরের মাধ্যমে চলে যায় সাগরে। কিন্তু সেই উজানের পানির পরিমাণ এতই কমে গেছে যে, লবণপানিকে ঠেলে মিঠাপানি নিচে নামতে পারছে না। মিষ্টিপানির আধারগুলোও নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে ফসলি জমিতেও লবণাক্ততা দিন দিন বাড়ছে।

বর্তমানে খুলনার ‘শস্য ভান্ডার’ হিসেবে পরিচিত ডুমুরিয়া উপজেলার মাটিতে ৮ দশমিক ২, বটিয়াঘাটা উপজেলার মাটিতে ৯.৭ এবং সাগরের কাছে পাইকগাছাতে ১৩ দশমিক শূন্য ৬ ডিএস/মি লবণাক্ততা মিলেছে। এ হারে লবণাক্ততা বাড়লে ফসলি জমির পরিমাণ দিন দিন কমতে থাকবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন খুলনা মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের এ মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।

Advertisement

লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে ফসলি জমির পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমছে বলে জানান কৃষি অধিদপ্তর খুলনার অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) মোছাদ্দেক হোসেন।

তিনি বলেন, লবণাক্ততার কারণে আমাদের অনেক জমি পতিত থাকার পাশাপাশি এক ফসলিতেই থেকে যাচ্ছে। দুই ফসলিতে (বছরে দুইবার ফসল ফলানো) পরিণত করা সম্ভব হচ্ছে না। বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় মিঠাপানির আধারগুলো নষ্ট হচ্ছে। জমিতে মিঠাপানির সেচ দিতে পারলে জমিতে লবণাক্ততা কমে যায়। কিন্তু সেই উপায়ও নেই।

খুলনার পাইকগাছা উপজেলার চাঁদখালি এলাকার কৃষক আলাউদ্দিন সানা বলেন, ‘পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় আমাদের এলাকার সবচেয়ে প্রমত্তা কপোতাক্ষ নদ এখন মৃতপ্রায়। এ নদের পানি এখন এতটাই লবণাক্ত যে তা ব্যবহার করার উপায় নেই। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে এ নদীতে চিংড়ি মাছ ধরা ছাড়া আর কোনো কাজেই আসে না। সেচ দেওয়াতো দূরের কথা।’

খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান সরদার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে নদী ও জমিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ছে। তাই চেষ্টা করা হচ্ছে লবণসহিষ্ণু ফসল চাষের। বিশেষ করে ভুট্টা, সূর্যমুখী, তিল চাষ করে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন আমাদের কৃষকরা। সরকারের ক্লাইমেট স্মার্ট প্রকল্পের আওতায় তাদের সে সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. সানাউল ইসলাম বলেন, খুলনা অঞ্চলের নদ-নদীতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির অনেকগুলো কারণ রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাগরে লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সীমানার নদীগুলো থেকে আমাদের পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে; যে নদীগুলোর কোনোটারই উৎস্য আমাদের দেশে নেই। ফলে এ অঞ্চলের নদ-নদীতে লবণের মাত্রা বাড়ছে।

তিনি বলেন, পাহাড় থেকে যে পানি নেমে আসে তাই স্বাদুপানি। কিন্তু আমাদের দেশের জন্য যে পানি প্রয়োজন তা আসছে না। অন্যদিকে সাগরের পানি উঠে আসছে।

পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এ অধ্যাপক বলেন, আমাদের নিজেদের কারণেও স্বাদু বা মিষ্টি পানির উৎস নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের পাহাড়ি এলাকায় যেসব জলাভূমি, বিল, হাওর, বাঁওড় ছিল সেগুলোতে মিষ্টিপানি ধরে রাখা সম্ভব ছিল। কিন্তু আমরা নিজেরাই তা নষ্ট করেছি। জনবসতির চাপে সেই পানির আধার এখন সংকটের মুখে।

আলমগীর হান্নান/এসআর/এমএস