কুষ্টিয়ায় চালকলের বর্জ্যে ভয়াবহ দূষণের শিকার হচ্ছে খাজানগর-কবুরহাট এলাকার পরিবেশ। মিলের বর্জ্যে ভরাট হয়ে যাচ্ছে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ খাল। দুর্গন্ধযুক্ত খালের কালচে পানি কৃষিকাজে ব্যবহার করায় নষ্ট হচ্ছে ফসল। মারাত্মক দূষণের কারণে এলাকার পুকুর-জলাশয়ের মাছ মরে যাচ্ছে। আর খালের পানিতে মেশা বর্জ্যের দুর্গন্ধে এলাকার মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। ভারী এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের একটিরও বর্জ্য শোধনাগার না থাকায় মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে এই এলাকার জীববৈচিত্র্য।
Advertisement
কুষ্টিয়ার খাজানগরে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধান-চালের মোকাম। বটতৈল ইউনিয়ন থেকে শুরু করে খাজানগর, কবুরহাট হয়ে আইলচারা পর্যন্ত বড় আকারের অর্থাৎ ভারী অটোমেটিক রাইসমিল রয়েছে ৫৫টি। আর হাসকিং এবং প্রসেসিং মিলিয়ে মিলের সংখ্যা প্রায় ৪৫০টি। এর মধ্যে বর্তমানে প্রায় সাড়ে তিনশর মতো মিল চালু রয়েছে।
এসব রাইচ মিলের কোনোটিরই নিজস্ব বর্জ্য পরিশোধনাগার নেই। মিলের দুর্গন্ধযুক্ত দূষিত পানি পাইপের মাধ্যমে সরাসরি ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের খালে। যা চলে যাচ্ছে কৃষি জমিতে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে কৃষি উৎপাদন। আবার পুকুরের মাছ মরে ভেসে উঠছে। দূষিত পানির সঙ্গে ধানের চিটা, কুঁড়া ও ছাই থাকায় মুহূর্তের মধ্যেই ভরাট হয়ে যাচ্ছে খালগুলো।
দূরের রাইসমিলগুলোও পাইপ লাইনের মাধ্যমে বর্জ্যের সংযোগ রেখেছে খালের সঙ্গে। রাইসমিলের এসব বর্জ্য খালের পানিতে মিশে একদিকে যেমন পানিকে দূষিত করছে অন্যদিকে মারাত্মক পরিবেশ দূষণের কবলে পড়ছে এই এলাকার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ।
Advertisement
রাইসমিলের কারণে সৃষ্ট পরিবেশ দূষণ নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ ওই এলাকার বাসিন্দারা। স্থানীয়রা জানান, এই এলাকার মানুষের ভোগান্তির কোনো শেষ নেই। খালের পানিতে রাইসমিলের বর্জ্য এসে মেশায় খালের দুর্গন্ধে গোটা এলাকা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে।
খাজানগর এলাকার বাসিন্দা আকবর হোসেন বলেন, রাইচ মিলগুলোর বর্জ্যের কারণে এ এলাকার কোনো ফসল ভালো হয় না। মাঠের পানিতে নামলেই হাত-পা চুলকায়। এ কারণে শ্রমিকরা এখানে কাজ করতে চায় না।
স্থানীয় চা দোকানি রহমত বলেন, মিলের চিটা, ময়লা সব এই খালের পানিতে গিয়ে মিশে যায়। যার কারণে এই এলাকায় মশা-মাছির অত্যাচার বেশি।
বটতৈল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মিন্টু ফকির বলেন, মিল মালিকদের এ বিষয়ে বারবার বলা সত্ত্বেও তারা কেউই কথা শোনেন না। এমনকি কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য মাহবুব উল আলম হানিফ মিল মালিকদের পরিবেশ দূষণ বন্ধ করতে বললেও তারা কথা শোনেননি। পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রতিবছরই এসব খাল খনন করে। কিন্তু রাইসমিলের বর্জ্যের কারণে কয়দিনেই খাল ভরে যায়।
Advertisement
খালের পানিতে বর্জ্যের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে খামার বাড়ির উপ-পরিচালক হায়াৎ মাহামুদ বলেন, এসব বিষাক্ত বর্জ্যে ক্ষতিকর ভারী ধাতব যেমন আয়রন, লেডসহ নানা উপাদান থাকতে পারে। যেটি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আবার দূষিত পানিতে ফসলের উৎপাদনও কম হয়ে থাকে।
কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাশিদুর রহমান রাইসমিলের বর্জ্যের কারণে খালের পানি এবং পরিবেশ দূষণের কথা স্বীকার করে বলেন, খাজানগর এলাকার রাইসমিলগুলোর বর্জ্যের কারণে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ খাল কিছুদিন পরপরই ভরাট হয়ে যায়। যে কারণে বারবার পরিষ্কার করা সত্ত্বেও কোনো কাজে আসে না। আবার মিল মালিকদের অনেকবার খালে বর্জ্য না ফেলার জন্য অনুরোধ করেও কোনো লাভ হয় না।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এখানকার মাত্র ৩০টি চালকলের পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র রয়েছে। বাকি সবগুলোই ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে। মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ঘটালেও চালকল মালিকরা অনেক প্রভাবশালী হওয়ায় পরিবেশ অধিদপ্তর তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না।
বাংলাদেশ অটোরাইসমিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন কুষ্টিয়ার সভাপতি মো. ওমর ফারুক বলেন, মানুষের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ আমরা করতে চাই না। তবে সরকার যদি এখানে বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণে উদ্যোগ নেয় তাহলেই কেবল এ সমস্যার সমাধান হতে পারে। এতে করে এখানকার প্রকৃতি ও মানুষ মারাত্মক দূষণের হাত থেকে রক্ষা পাবে।
আল-মামুন সাগর/এমআরআর/এএসএম