জাতীয়

চট্টগ্রামে ৪০ বছরে বিলুপ্ত ২৪ হাজার পুকুর-দিঘি

পুকুর-দিঘি-জলাশয়ের জন্য ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম। জমির চাহিদা বাড়াসহ নানান কারণে এসব জলাশয় ভরাট করে নির্মিত হচ্ছে স্থাপনা। ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হচ্ছে পুকুর-জলাশয়। এতে উষ্ণ নগরীতে পরিণত হচ্ছে চট্টগ্রাম। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সময়ের ব্যবধানে বিগত ৪০ বছরে ২৪ হাজারের মতো পুকুর-দিঘি ভরাট হয়েছে চট্টগ্রামে। এর মধ্যে রয়েছে অনেক ঐতিহ্যবাহী পুকুর-জলাশয়।

Advertisement

সম্প্রতি চট্টগ্রামে বেশি আলোচনায় আসে দেওয়ানজী পুকুর লেন। একজন মন্ত্রীর বাসভবন থাকায় সংবাদ সংগ্রহের জন্য সাংবাদিকদেরও যাতায়াত করতে হয় সেখানে। নামে দেওয়ানজী পুকুর লেন হলেও সেই পুকুর এখন আর নেই। আন্দরকিল্লার ‘রাজা পুকুর লেন’ নাম ঠিক থাকলেও রাজা পুকুর ভরাট হয়ে তৈরি হয়েছে স্থাপনা।

আরও পড়ুন>> শহরের বর্জ্য বুকে নিয়ে কুমার নদ এখন ময়লার ভাগাড়

দখল, দূষণ ও আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হওয়া চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বলুয়ার দিঘিও এখন শুধু নাম বহন করছে। চট্টগ্রামের আরেক ঐতিহ্যবাহী আশকার দিঘিও দখলে জর্জরিত। দিঘির চারদিকে উঠেছে বহুতল স্থাপনা। দখল-দূষণে সংকুচিত হচ্ছে এনায়েত বাজার এলাকার রানির দিঘি, পাহাড়তলীর পদ্মপুকুর, বড় মিয়ার মসজিদ পুকুর, হালিশহরের খাজা দিঘি, চান্দগাঁওয়ের মুন্সি পুকুর, বাকলিয়ার আবদুল্লাহ সওদাগর পুকুর, আগ্রাবাদ ঢেবা, আগ্রাবাদের দাম্মো দিঘি, কর্নেল হাট দিঘি, হাজারীর দিঘি, কারবালা পুকুর, ভেলুয়ার দিঘি, কাজীর দিঘি ও রামপুর বড় পুকুর।

Advertisement

পরিবেশ অধিদপ্তর ১৯৮১ সালের এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করে, চট্টগ্রামে প্রায় ২৫ হাজার পুকুর-জলাশয় রয়েছে। চার দশকের ব্যবধানে দখল-দূষণে হারিয়ে গেছে এর বেশিরভাগ। ১৯৯১ সালে মৎস্য অধিদপ্তরের এক জরিপে ১৯ হাজার ২৫০টি পুকুর-জলাশয়ের অস্তিত্ব মেলে। ২০০৬ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এক জরিপে চার হাজার ৫শ ২৩টি পুকুর-জলাশয় পাওয়া যায়।

মূলত জমির মূল্য অস্বাভাবিক বাড়ার কারণে নব্বইয়ের দশক থেকে চট্টগ্রামে পুকুর-জলাশয় ভরাটের মহোৎসব শুরু হয়। রাতারাতি পুকুর ভরাট করে তৈরি হয়েছে অগণিত স্থাপনা। ফলে চট্টগ্রাম শহরে পুকুর-জলাশয়ের সংখ্যা শতকের কোটায় চলে আসে। ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক মোরশেদ হোসেন মোল্লার এক সমীক্ষায় চট্টগ্রাম শহরে ১২শ ৪৯টি জলাশয়ের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন>> সবুজ শহর রাজশাহী, সুফল পাচ্ছে নগরবাসী

বিগত কয়েকবছরে ছোট ছোট অসংখ্য পুকুর ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ করেছে প্রভাবশালীরা। পরিবেশ অধিদপ্তর মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে জরিমানা কিংবা মামলা করে দায় সেরেছে। পুকুর ভরাটের মামলার বিচারে সাজা হওয়ার নজিরও নেই চট্টগ্রামে।

Advertisement

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক অধ্যাপক এ বি এম আবু নোমান জাগো নিউজকে বলেন, পরিবেশ আইনে পুকুর ভরাটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তি মামলা করতে হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পূর্বানুমতি নিতে হয়। আবার পরিবেশ আদালত গঠন করা হলেও তেমন লজিস্টিক সাপোর্ট নেই। পরিবেশ আদালতে যাদের পদায়ন করা তাদের কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। সবশেষে পুকুর ভরাটসহ এ ধরনের মামলাগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লোকজন ভরাটকারীদের বিরুদ্ধে আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দেন না। যারা মামলা করেন, তারা পরবর্তীসময়ে সমঝোতা করে ফেলেন।

আইনের এই শিক্ষক বলেন, যারা পুকুর ভরাট করেন কিংবা পাহাড় কাটেন, যারা পরিবেশ দূষণ করেন তারা অনেক প্রভাবশালী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভূমিদস্যুরাই পুকুর ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ করছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, মানুষ কৌশলে পুকুরের শ্রেণি পরিবর্তন করছে। এক্ষেত্রে খতিয়ানে জমির শ্রেণির পুকুর লেখা না থাকলে প্রতিকার পাওয়া দুষ্কর।

‘প্রভাবশালীরা প্রথমে পুকুরের পাশের নাল জমিতে ছোট স্থাপনা নির্মাণ করেন। পরে স্থাপনার পাশে ধীরে ধীরে পুকুর ভরাট করেন। এক সময়ে ভূমি অফিসে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করার আবেদন করেন। সেখানে ভূমি অফিসের লোকজন গিয়ে সরেজমিনে যদি দেখেন এখানে পুকুরের কোনো অস্তিত্ব নেই, তখন তারা শ্রেণি পরিবর্তনের পক্ষে প্রতিবেদন দেন। এভাবে পুকুর ‘নাল’ কিংবা ‘কিলা’ ভূমিতে পরিণত হয়।’

আরও পড়ুন>> ১৯ পণ্যের মোড়কে পাটের বদলে ফের ফিরেছে প্লাস্টিক

তিনি বলেন, পুকুর-জলাশয় ভরাটের বিরুদ্ধে আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারেন জনপ্রতিনিধিরা। জনপ্রতিনিধিরা এগিয়ে এলেও পরিবেশ অনেকাংশে রক্ষা সম্ভব। তাছাড়া মানুষের মধ্যে সচেতনতার বিকল্প নেই। এই শহর আমাদের। এই শহরে আমরা বাস করছি। এই শহরকে রক্ষার দায়িত্বও আমাদের।

পুকুর ভরাট নিয়ে বিগত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর জরিমানা করে দায় সেরেছে। কিন্তু ভরাট থামেনি। ভরাট হয়ে যাওয়ার পুকুরও ফিরে আসেনি। উপরন্তু নতুন নতুন কায়দায় ভরাট চলছে পুকুর-জলাশয়। নগরীর পশ্চিম বাকলিয়া বড় মিয়া মসজিদ সংলগ্ন ৩৮ শতকের পুকুরটি কোভিড পরিস্থিতির মধ্যে ২০২১ সালের শুরুর দিকে ভরাট শুরু করেন প্রভাবশালীরা। পরে পরিবেশ অধিদপ্তর সংশ্লিষ্টদের ডেকে শুনানি করেন। পরবর্তীসময়ে ২০ জন বিবাদীর বিরুদ্ধে আদালতে মামলার সিদ্ধান্ত নেন। ভরাট জায়গায় স্থাপনা হলেও এখনো ওই মামলার পরবর্তী অবস্থা জানা যায়নি।

২০২১ সালের শুরুর দিকে নগরীর মনছুরাবাদে শতবর্ষী তিনটি পুকুর ভরাট করেন প্রভাবশালীরা। ওই বছরের ১১ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম শুনানি করে মনছুরাবাদের খান সাহেব আবদুল হাকিম মিয়া ওয়াকফ এস্টেটের মোতোয়াল্লি লে. কর্নেল (অব.) ইকবাল শফিকে স্থানীয় গুরা পুকুর ভরাটের অপরাধে ৮০ হাজার টাকা পরিবেশগত ক্ষতিপূরণ ধার্য করেন। কিন্তু পুকুরগুলো আর আগের অবস্থানে ফিরে আসেনি। এখন একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এসব পুকুর। পুকুরের ভরাট করা জায়গায় তৈরি হয়েছে নানান স্থাপনা।

২০২২ সালের শুরু থেকে নগরীর উত্তর আগ্রাবাদের মুহুরী পাড়া এলাকার লাল মোহাম্মদ সিপাহী বাড়ির ময়লা পুকুরটি ভরাট করে প্রভাবশালীরা। পরিবেশ অধিদপ্তরের ওই সময়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পরিচালকও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি পুকুর ভরাটের বিষয়টির সত্যতা পেলেও পুকুরটি প্রভাবশালীদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেননি।

ওই বছরের ২৭ জুন চট্টগ্রামের পটিয়া পৌর সদরের পোস্ট অফিস মোড় এলাকায় জেলা পরিষদের সরকারি পুকুর ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ করে প্রভাবশালীরা। ওই স্থানে বর্তমানে পাকা দোকানঘর নির্মিত হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, জেলা পরিষদের নির্বিকার অবস্থানের কারণে পুকুরটি ভরাট হয়েছে। গত বছরের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে আগ্রাবাদে রংগীপাড়ার জলকলোনি এলাকার শতবর্ষী বালির বাপের পুকুরটির বড় অংশ ভরাট করে প্রভাবশালীরা। পরবর্তীসময়ে পরিবেশ অধিদপ্তর হস্তক্ষেপ করেও পুকুরটি রক্ষা করতে পারেনি।

গত ডিসেম্বর মাসে হাটহাজারীর ফতেয়াবাদ এলাকার ক্ষেত্রপাল বাড়ি এলাকায় শতবর্ষী একটি পুকুর ভরাট করা হয়। ওই ঘটনায় স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন পুকুর ভরাটস্থলে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে সুবল ধর নামে একজনকে এক লাখ টাকা জরিমানা করেন। কিন্তু ভরাট করা পুকুর আগের অবস্থানে ফেরেনি। চট্টগ্রামের পটিয়া পৌরসভা কাগজী পাড়া এলাকায় শতবর্ষী বড় পুকুরের অর্ধেক ভরাট করে সরকারি মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ কাছেই অধিগ্রহণের জন্য খালি জায়গা ছিল।

পরিবেশবিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা রসায়নের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. ইদ্রিস আলী জাগো নিউজকে বলেন, নগরীর পুকুর-জলাশয়গুলো ভূমিপুত্ররাই ভরাট করে ফেলছে। আশকার দিঘি সংকুচিত হয়েছে। পুকুর যতটুকু রয়েছে, তার জীব-বাস্তুতন্ত্র খুবই খারাপ। দেওয়ানজী পুকুর অনেক আগে থেকেই নেই। রানির পুকুর অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। রাজা পুকুরও নেই। যেগুলো আছে সেগুলোতেও আমাদের নির্লিপ্ততা রয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর, অংশীজন, রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরও নির্লিপ্ততা আছে। সবগুলো বৈপরীত্য থাকলে পুকুর কীভাবে রক্ষা সম্ভব?

তিনি বলেন, পুকুরতো আর কথা বলতে পারে না। কর্ণফুলী কোর্টে গিয়েছে, রায় পেয়েছে। রায়তো বাস্তবায়ন হয়নি। আমাদের নির্লিপ্ততাই আমাদের শেষ করছে। পুকুর, খাল কিংবা পাহাড় কোনোটাই এ নগরে নিরাপদ নয়।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, আমরা পুকুর শ্রেণিতে কোনো প্ল্যান অনুমোদন দেই না। পুকুর ভরাটেরও অনুমোদন দেই না। আইনগতভাবেও কোনো ধরনের জলাশয় ভরাটের সুযোগ নেই। তবে বিএস খতিয়ানে জমির শ্রেণি পুকুর, দিঘি কিংবা জলাশয় উল্লেখ না থাকলে সেক্ষেত্রে কোনো প্ল্যান ফিরিয়ে দেওয়া কঠিন। ডিটেল এরিয়া প্ল্যানে পুকুরের জায়গা চিহ্নিত করা আছে। নিজেদের বাঁচতে, নিজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পরিবেশের ক্ষতি থেকে রক্ষায় পুকুর-জলাশয়ের সুরক্ষা দেওয়া জরুরি।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মিয়া মাহমুমুদ হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘পুকুর ভরাটের কোনো সংবাদ পেলে বা কোনো নিউজ পেলে আমরা দ্রুততম সময়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করি। এ ধরনের খবরে দেরি করেছি এমন নজির নেই। ২০২২ সাল থেকে আমরা অনেক মামলা করেছি। তবে অনেক ক্ষেত্রে আমরা পুকুর ভরাট হয়ে যাওয়ার পর জায়গা জমির বিরোধ হলেই খবর পাই। তখন পুকুর রক্ষা কিংবা ভরাট বন্ধের সুযোগ থাকে না। সব মিলিয়ে পুকুর রক্ষা খুবই জরুরি। এজন্য মানুষদের আগে সচেতন হতে হবে।

এমডিআইএইচ/এএসএ/এএসএম