ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনইপি) কর্তৃক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ৪০০ মিলিয়ন টনেরও বেশি প্লাস্টিক উৎপাদিত হয়, যার অর্ধেক শুধু একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়। উৎপাদিত প্লাস্টিকের ১০ শতাংশেরও কম পুনর্ব্যবহারযোগ্য। বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক পণ্যের তিন-চতুর্থাংশ ল্যান্ডফিল বা প্রাকৃতিক পরিবেশে জমা হয়। সারা বিশ্বে বছরে আনুমানিক ১৯-২৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য হ্রদ, নদী, সাগর এবং সমুদ্রে মিশে যায়, যা প্রায় ২,২০০টি আইফেল টাওয়ারের ওজনের সমান। উল্লেখ্য যে, আইফেল টাওয়ারের মোট ওজন ১০,১০০ টন।
Advertisement
এমনই এক প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির উদ্যোগে এ বছর সারা বিশ্বে উদযাপিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। নেদারল্যান্ডসের সহায়তায় পশ্চিম আফ্রিকার দেশ আইভরি কোস্ট এ বছর দিবসটির আয়োজক দেশ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। এ বছর দিবসটির থিম বা প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে “Solutions to Plastic Pollution”। আর স্লোগান ঠিক করা হয়েছে “Beat Plastic Pollution”। বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক বাংলায় নির্ধারিত প্রতিপাদ্য হলো ‘প্লাস্টিক দূষণের সমাধানে সামিল হই সকলে’ আর স্লোগান হলো ‘সবাই মিলে করি পণ, বন্ধ হবে প্লাস্টিক দূষণ”।
এখানে উল্লেখ্য যে, এ বছরই বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি হয়েছে। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP) এর নেতৃত্বে ১৯৭৩ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে। বিশ্ব পরিবেশ দিবসে, ব্যক্তি, সম্প্রদায় এবং সরকারকে পরিবেশগত উদ্যোগে সম্পৃক্ত করার জন্য বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন কার্যক্রম এবং অনুষ্ঠান হয়। কিছু সাধারণ কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে বৃক্ষ রোপণ অভিযান, পরিচ্ছন্নতা অভিযান, শিক্ষামূলক কর্মসূচি, পরিবেশগত প্রদর্শনী এবং টেকসই অনুশীলনের বিষয়ে সেমিনার। এই ক্রিয়াকলাপগুলোর লক্ষ্য পরিবেশ সংরক্ষণ, দূষণ কমানো, টেকসই জীবনযাত্রার প্রচার এবং পরিবেশগত সমস্যাগুলোর সমাধানে সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানদের চাপ প্রয়োগ এবং সচেতনতা বাড়াতে ব্যক্তি ও সংস্থাকে পদক্ষেপ নিতে অনুপ্রাণিত করা।
আলেকজান্ডার পার্কস ১৮৫৫ সালে প্রথম মানবসৃষ্ট প্লাস্টিক আবিষ্কার করেন এবং এর নাম দেন পার্কসিন। এটি নাইট্রিক অ্যাসিডের সাথে উদ্ভিদ সেলুলোজ বিক্রিয়া করে তৈরি করা হয়েছিল। ১৯০৭ সালে, লিও বেকেল্যান্ড একটি সম্পূর্ণ সিন্থেটিক প্লাস্টিক আবিষ্কার করেন এবং এর নাম দেন বেকেলাইট। তিনিই প্রথম প্লাস্টিক শব্দটি ব্যবহার করেন। ক্রম বিবর্তনের ধারায় প্লাস্টিকের বহু রূপ ও ধরন আজ আমাদের নিত্য সঙ্গী।
Advertisement
বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্লাস্টিক হলো মনুষ্যসৃষ্ট পলিমার, যা মূলত রাসায়নিকভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি বা প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে তৈরি হয়। প্লাস্টিক সাধারণত নমনীয়, ক্ষয় প্রতিরোধী, টেকসই এবং সস্তা। মাটি, পানি, বায়ুমণ্ডল, বন্যপ্রাণী, জীববৈচিত্র্য এবং মানব স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বিধায় একে সাধারণত প্লাস্টিক দূষণ বলা হয়।
প্লাস্টিক আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাপনের একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। বিশ্বে মানুষ প্রতি মিনিটে প্রায় এক মিলিয়ন প্লাস্টিকের বোতল ক্রয় করে এবং প্রতি ঘণ্টায় এক বিলিয়ন প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করে। স্বল্প খরচ, স্থায়িত্ব, প্রক্রিয়াকরণের সহজতা, হালকা ওজন এবং উচ্চ তাপ ও বৈদ্যুতিক নিরোধক প্লাস্টিককে ব্যক্তি এবং বিপুল সংখ্যক শিল্প খাতের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। প্লাস্টিকের অসংখ্য সামাজিক সুবিধা অনস্বীকার্য হওয়া সত্ত্বেও, এটি আমাদের পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্লাস্টিক বর্জ্য দ্রুত বাড়ছে এবং পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে। এটি ইতিমধ্যে বাস্তুতন্ত্র, মানব সম্প্রদায়, প্রাণিকুল এবং পৃথিবীর জলবায়ু ব্যবস্থাকে একটি গুরুতর হুমকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।
ইউরোপ্লাসের তথ্য অনুযায়ী, প্লাস্টিক বেশিরভাগই ‘পলিমারাইজেশন বা পলিকনডেনসেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেলুলোজ, কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, লবণ এবং অপরিশোধিত তেলের মতো প্রাকৃতিক উপকরণ থেকে’ তৈরি করা হয়। প্লাস্টিক বর্জ্যগুলো পচতে দীর্ঘ সময় নেয় কারণ পণ্যগুলোতে ব্যবহৃত উপাদানগুলো আমাদের পরিবেশে বিদ্যমান নেই এবং প্রাকৃতিকভাবে এমন কোন জীবাণু কণা নেই, যা তাদের কার্যকরভাবে নষ্ট করে ফেলতে পারে। প্লাস্টিক পণ্যগুলো নষ্টের সময় তাদের ধরন এবং গাঠনিক অবস্থা বিবেচনা করে আলাদা হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ ১০ থেকে ১,০০০ বছরের মধ্যে পচে যেতে পারে। আবার একটি প্লাস্টিকের বোতল যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ, এটি ক্ষয় হতে ৪৫০ বছর পর্যন্ত সময় নিতে পারে। অপরিশোধিত প্লাস্টিক বর্জ্য আমাদের পরিবেশে বিষাক্ত পদার্থ যোগ করে এবং মানুষের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে, বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করে এবং বন্যপ্রাণীর ক্ষতি করে।
Advertisement
স্তূপ করা প্লাস্টিক বর্জ্য খুবই উদ্বেগজনক কারণ এটি মারাত্মক পরিবেশগত পরিণতি সৃষ্টি করতে পারে। যখন সূর্য এবং এর তাপের সংস্পর্শে আসে, তখন এগুলো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করতে পারে। এটি অবশ্যই ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে অবদান রাখে যা ইথিলিন এবং মিথেনসহ আরও ক্ষতিকারক গ্যাস তৈরিতে সহায়তা করে, যা তাপমাত্রাকে আরও বেশি বৃদ্ধি করে ধ্বংসের একটি দুঃস্বপ্নের চক্র তৈরি করে।
সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ল’ ২০১৯ এর তথ্য অনুযায়ী প্লাস্টিক আমাদের পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলীয় অবস্থাকেও প্রভাবিত করছে। মোট প্লাস্টিক পণ্যের প্রায় ৯৮ শতাংশ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে উৎপাদিত হয়, যা গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করে, যা বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সংকটের একটি প্রধান কারণ। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) জানিয়েছে যে বর্তমানে বিশ্বের কার্বন বাজেটের ৩.৪ শতাংশ প্লাস্টিক রয়েছে এবং আগামী বিশ বছরে তা পাঁচগুণ বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
প্লাস্টিক বর্জ্য পোড়ানোর ফলে ২০১৯ সালে বায়ুমণ্ডলে ৮.৫ মিলিয়ন টন কার্বন-ডাই অক্সাইড যোগ হয়েছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ১০ থেকে ১৩ শতাংশ ঘটছে প্লাস্টিক বর্জ্য পোড়ানোর কারণে। ২০২২ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে ভেসে যেতে পারে এবং মেঘের গঠনকে প্রভাবিত করতে পারে এবং তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত এবং এমনকি দীর্ঘমেয়াদি জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রভাবিত করতে পারে।
সামুদ্রিক পরিবেশ প্লাস্টিক দূষণের সবচেয়ে বড় শিকার। প্লাস্টিক দূষণের ফলে প্রতি বছর ১ মিলিয়ন সামুদ্রিক পাখি এবং ১০০,০০০ সামুদ্রিক প্রাণী মারা যায়। বিজ্ঞানীরা হিসাব করেছেন যে বর্তমানে সমুদ্রে ৫.২৫ ট্রিলিয়ন মাইক্রো এবং ম্যাক্রো প্লাস্টিক কণা জমা রয়েছে। প্রতি বর্গমাইল সমুদ্রে প্লাস্টিকের ৪৬,০০০ কণা জমা হয়েছে। সাগরে জমে থাকা প্লাস্টিকের মোট ওজন দুই লাখ ৬৯ হাজার টন। প্রতিদিন ৮ মিলিয়ন টুকরো প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে জমা হচ্ছে। এভাবে সাগরে প্লাস্টিক বর্জ্যের বিশাল অংশ জমেছে।
বর্তমানে, প্রশান্ত মহাসাগরে প্লাস্টিক বর্জ্য প্যাচ প্রায় ১.৬ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার। প্লাস্টিক বর্জ্যের অনুরূপ জমা অন্যান্য মহাসাগর ও সাগরেও তৈরি হয়েছে। শুধু সমুদ্রের তলদেশই নয়, ভূপৃষ্ঠের সমুদ্রের পানির কমবেশি ৮৮ শতাংশ প্লাস্টিক দূষণে দূষিত। প্লাস্টিক বর্জ্যে সবচেয়ে মারাত্মক দূষণ ঘটাচ্ছে প্লাস্টিক ব্যাগ বা পলিথিন ব্যাগ। প্রতি মিনিটে আমরা ১ মিলিয়ন প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারের পরে ফেলে দিই।
প্রতি বছর আমরা অজান্তে সমুদ্র সৈকতে ৮.৩ বিলিয়ন প্লাস্টিকের ব্যাগ এবং প্লাস্টিকের টুকরো নিক্ষেপ করি। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে সমুদ্রে প্লাস্টিক পণ্য ও কণার সংখ্যা মাছের সংখ্যার চেয়েও বেশি হবে। বর্তমানে সাগরে ধরা পড়া প্রতি তিনটি মাছের মধ্যে একটির পেটে প্লাস্টিক রয়েছে। প্লাস্টিক পণ্যে মাইক্রোবিড থাকে, যা সহজেই পরিবেশকে দূষিত করতে পারে।
বাংলাদেশে প্লাস্টিক উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং শিল্পটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্লাস্টিক হলো বিদেশি রপ্তানি বাণিজ্য থেকে আয়ের ১২তম সর্বোচ্চ উৎস এবং আমাদের তৈরি পোশাক সেক্টর, স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বয়ংচালিত শিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে ৫,০০০ প্লাস্টিক তৈরি কারখানা রয়েছে এবং এর মধ্যে ৯৮ শতাংশই ছোট ও মাঝারি কারখানা। এসব কারখানায় প্রায় ১২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। বাংলাদেশের প্লাস্টিক পণ্য স্থানীয় ও বৈশ্বিক উভয় বাজারে সময়ের সাথে সাথে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এবং প্লাস্টিক উৎপাদনের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ প্লাস্টিক রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ ১১৫.১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করবে বলে আশা করছে।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, গত ১৫ বছরে, বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার ২০০৫ সালে ৩ কেজি থেকে তিনগুণ বেড়ে ২০২০ সালে ৯ কেজি হয়েছে। শুধু ঢাকায়ই বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার ২২.২৫ কেজি হয়েছে। সংখ্যাটি শহরাঞ্চলের জাতীয় গড়ের তিনগুণ বেশি। ঢাকায় ২০০৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দৈনিক প্লাস্টিক বর্জ্য ১৭৮ টন থেকে ৬৪৬ টন পর্যন্ত বেড়েছে। ঢাকার প্লাস্টিক বর্জ্যের মাত্র ৩৭.২ শতাংশ রিসাইকেল করা হয়।
বাংলাদেশে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চিত্র হতাশাজনক। বিশ্বব্যাংকের ২০২১ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, অপর্যাপ্ত প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে প্লাস্টিক দূষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলির মধ্যে একটি। লাইটক্যাসল পার্টনার্সের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দশম স্থানে রয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারি প্লাস্টিক দূষণকে আরও খারাপ করেছে।
যদিও বাংলাদেশে মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার অন্যান্য অনেক উন্নয়নশীল এবং প্রতিবেশী দেশের তুলনায় কম, তবে প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা এমন একটি সমস্যা, যা আমাদের দেশকে বৈশ্বিক অবস্থানে দশম স্থান দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী অব্যবস্থাপিত প্লাস্টিক বর্জ্যের ২.৪ শতাংশের জন্য বাংলাদেশ দায়ী।
টেকসই প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশে একটি ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ, যা আমাদের সামগ্রিক বৃদ্ধি ও উন্নয়নকে চ্যালেঞ্জ করছে। দেশে প্রতিদিন প্রায় ৩,০০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে এবং শুধু ঢাকা শহরে একই সময়ে প্রায় ১৪ মিলিয়ন পিস পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হয়। ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্যগুলোর বেশিরভাগই তাদের প্রথম ব্যবহারের পরে ফেলে দেওয়া হয় এবং ভুল বা অব্যবস্থাপনার কারণে সেগুলো রাস্তা, ড্রেন, খাল, নদী এবং রাস্তার পাশের খোলা জায়গায় অপরিশোধিত থেকে যায়।
বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক ব-দ্বীপ এবং এই নির্দিষ্ট ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে ভূমিভিত্তিক প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে জমা হতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, প্রতিদিন প্রায় ৭৩,০০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য পদ্মা, যমুনা এবং মেঘনা নদীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে, যা আমাদের জলজ বাস্তুতন্ত্রের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনার ফল ভোগ করছে বাংলাদেশ। প্লাস্টিক পণ্যগুলো কখনই সম্পূর্ণরূপে পচে যায় না বরং কণা আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণাগুলো খুব অল্প দূরত্ব অতিক্রম করে মানবদেহে প্রবেশ করে এবং মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি ঘটাতে পারে। অন্যদিকে, পোড়ানো প্লাস্টিক সামগ্রী থেকে উৎপন্ন বিষাক্ত গ্যাস ও কণা মানুষের নিশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে ক্যানসারসহ জটিল রোগব্যাধি তৈরি করে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের মানুষের বার্ষিক মৃত্যুর প্রায় ৩২ শতাংশ পরিবেশগত অবনতির সাথে জড়িত। বিশেষ করে বাইরের বায়ু দূষণ, অপর্যাপ্ত পানি, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি মান এবং প্লাস্টিক দূষণের মাধ্যমে সিসার আধিক্য এই মৃত্যুর কারণ।
বিশ্বব্যাংক আরও উল্লেখ করেছে, ২০১৯ সালে পরিবেশগত কারণে স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য আনুমানিক বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৪.৪ ট্রিলিয়ন টাকা। প্লাস্টিক বর্জ্য ড্রেনেজ সিস্টেম ধ্বংস করে, জলাবদ্ধতা তৈরি করে যা মশার প্রজনন ক্ষেত্র তৈরির অন্যতম কারণ, যা ডেঙ্গুর মতো ভেক্টর বাহিত রোগের ঘটনা ঘটায়। এছাড়াও, চিকুনগুনিয়া, কলেরা, ডায়রিয়া এবং ম্যালেরিয়ার মতো রোগের প্রার্দুভাবের জন্য প্লাস্টিক দূষণ অনেকাংশে দায়ী।
সুতরাং, প্লাস্টিক দূষণ বিশ্বব্যাপী একটি জটিল সমস্যা; যা পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, অর্থনীতি ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য বিরাট হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশ্বের ৫১ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য, যা পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ, শুধু এশিয়ার দেশগুলোতে উৎপাদিত হয়। আগেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পরিবেশে প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য যুক্ত হচ্ছে, যা সব ধরনের বর্জ্যের ৮০ শতাংশ।
এমন পরিস্থিতিতে, জাতিসংঘের পরিবেশ উন্নয়ন কর্মসূচি এ বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসে সব সদস্য রাষ্ট্রকে প্লাস্টিক দূষণের হাত থেকে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও সামগ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানিয়েছে। ইউএনইপি’র একটি নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদি দেশ ও কোম্পানিগুলো সঠিক নীতি ও বিদ্যমান প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাজার পরিবর্তন করে তাহলে ২০৪০ সালের মধ্যে প্লাস্টিক দূষণ ৮০ শতাংশ কমে যেতে পারে।
“Turning off the Tap: How the world can end plastic pollution and create a circular economy” শীর্ষক এই প্রতিবেদনে বিশ্ব কীভাবে প্লাস্টিক দূষণের অবসান ঘটাতে পারে এবং একটি বৃত্তাকার অর্থনীতি তৈরি করতে পারে তার বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে সঠিক অনুশীলন, বাজারের পরিবর্তন এবং নীতিগুলির সমাধানকেন্দ্রিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যা রাষ্ট্র বা সরকারগুলোকে চিন্তাভাবনা এবং ব্যবসায়িক পদক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত করতে পারে।
ইউএনইপি বলছে, প্লাস্টিক প্রাকৃতিকভাবে বায়োডিগ্রেডেবল নয়, প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একমাত্র উপায় হলো একটি বৃত্তাকার অর্থনৈতিক মডেল গ্রহণ করা। প্লাস্টিকের সার্কুলার ব্যবহারের ওপর জোর দিয়ে, 3R কৌশলের (রিডুস, রিইউজ, রিসাইকেল) ওপর ভিত্তি করে এর ব্যবহার কমিয়ে আনা। এর ফলে প্লাস্টিক দূষণজনিত সামাজিক ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সহজ হবে।
শুধু একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক মডেলের মাধ্যমেই আমরা প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনার 3R পদ্ধতিকে সত্যিকার অর্থে গ্রহণ করতে এবং একটি জাতি হিসেবে আমাদের প্লাস্টিক দূষণ কমাতে সক্ষম হবো। এই পরিস্থিতিতে, ক্রমবর্ধমান প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলা করতে এবং সবুজ বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে প্লাস্টিকের টেকসই ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাংকের একটি নতুন প্রতিবেদনে (Towards a Multisectoral Action Plan for Sustainable Plastic Management in Bangladesh) বলা হয়েছে, বাংলাদেশে টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনার জন্য মাল্টি সেক্টরলাল কর্ম পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে যেখানে প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলায় স্বল্পমেয়াদী, মধ্য-মেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা অর্ন্তভুক্ত রয়েছে।
এ কথা সত্য যে, প্লাস্টিক পণ্যগুলো মানুষের জীবনকে আরও স্মার্ট করে তুলেছে কিন্তু একই সময়ে, প্লাস্টিকের অব্যবস্থাপনা আমাদের এমন পরিস্থিতিতে নিয়ে গেছে যেখানে আমাদের গ্রহ ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী পরিবেশগত প্রভাবের সম্মুখীন হচ্ছে। বাংলাদেশের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি, আগামী বছরগুলোতে প্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, ফলে পরিবেশগত বিপর্যয় আরও বাড়বে, মানব জীবন এবং অন্যান্য জীবিত প্রাণীকে প্রভাবিত করবে। কাজেই এখনই সচেতন হতে হবে।
আমাদের দেশে নীতি ও আইন প্রণয়নের চর্চা থাকলেও সেসবের কার্যকর প্রয়োগ এখনও অপ্রতুল। সরকারের কার্যকরী প্রবিধান ও প্রয়োগের উদ্যোগ ছাড়াও, ব্যক্তি, গোষ্ঠী, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সচেতনতাও এই সমস্যা মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সুতরাং, বিশ্ব পরিবেশ দিবসের এই দিনে আমরা সবাই মিলে প্লাস্টিক দূষণের সমাধানে শামিল হই এবং আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীকে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষায় ‘সবাই মিলে করি পণ, বন্ধ হবে প্লাস্টিক দূষণ’।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।
এইচআর/ফারুক/এএসএম