জাতীয়

নদী দখল করলে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তথ্য চলে আসবে

সারাদেশে ৫৭ হাজার নদী দখলদারের নামের তালিকা তৈরি করেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। এ তালিকা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা নদী দখল করে পানির প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে। এ পর্যন্ত কিছু দখলদারকে উচ্ছেদ করা সম্ভব হলেও রক্ষকদের পৃষ্ঠপোষকতায় অধিকাংশরাই থাকছেন বহাল তবিয়তে। 

Advertisement

পরিবেশ রক্ষায় নদীর ভূমিকা, করণীয়সহ বিভিন্ন বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুরাদ হুসাইন।

জাগো নিউজ: নদী রক্ষা কমিশন এ পর্যন্ত কতজন নদী দখলদারের তালিকা তৈরি করেছে?

মনজুর আহমেদ চৌধুরী: বিগত পাঁচ বছরে সারাদেশে ৫৭ হাজার নদী দখলদারের নামের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সেটি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ওয়েবসাইটে আছে। জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে এ তালিকা সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিনিয়ত সেটি আপডেট করা হচ্ছে। 

Advertisement

জাগো নিউজ: নদী দখলমুক্ত করতে প্রতিবন্ধকতা কী কী?

ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী: প্রথমত, কোথায় কোথায় নদী দখল হচ্ছে সেটি সহজে জানা যায় না। বিভিন্ন মাধ্যমে আমাদের জানতে হয়। সে কারণে নতুন প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে নদী দখলের ১০-১৫ দিনের মধ্যে আমাদের কাছে তথ্য চলে আসবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক তার টিমের মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একটি সফটওয়্যার তৈরি করছেন। এটি হলে আমাদের তথ্য পেতে সুবিধা হবে। তথ্য পাওয়ার পরেই দখল বন্ধে জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়ে নির্দেশনা দেওয়া হবে।

যে নদীতে প্রবাহ থাকে ও নিয়মিত ব্যবহার হয় এমন বড় নদীগুলো দখল হয় না। নগরে যে সব নদী প্রবাহিত হয় সেসব ছোট নদী দখল হয়ে যাচ্ছে। নদীর ব্যবহার কমে গেলে স্থানীয়রা বাঁধ দিয়ে মাছ, ধান, সবজি চাষের পর সেটি দখল করে সেখানে আবাসন বা বাণিজ্যিক ভবন তৈরি করে। তাই দেশে যতগুলো নদী আছে সেগুলোর ব্যবহার বাড়ানো, নৌ চলাচল অব্যাহত রাখতে হবে। কৃষিপণ্য সড়কপথে আনা-নেওয়া করলে ব্যয় বেড়ে যায়, সেগুলো নদীপথে করলে তাতে ব্যয় কমে যায়।

জাগো নিউজ: নদী দখলদারদের সঙ্গে নদী রক্ষা কমিশন পেরে উঠছে না কেন?

Advertisement

মনজুর আহমেদ চৌধুরী: নদী রক্ষা করা শুধু নদী কমিশনের কাজ নয়, আমাদের কোনো বাহিনী নেই। এটি প্রশাসনেরও কাজ। যদি এ কাজে ধীরগতি তৈরি হয় তবে সেটি প্রশাসনেরও ব্যর্থতা। কেউ কেউ এগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বলে সন্তুষ্টি পাওয়ার চেষ্টা করে। এতে নদী রক্ষা কমিশনকে ব্যর্থ বলে প্রমাণিত করতে চায়। আমাদের কাজে কোনো ধীরগতি নেই।

চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর একটি বড় অংশজুড়ে কর্ণফুলী ড্রাইডক নামে একটি প্রতিষ্ঠান দখল করে রেখেছে। তাদের উচ্ছেদ করতে আমরা জেলা প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছি। সেখানে ফিশারিজ ঘাট উৎখাত করতে বলা হলেও এখন পর্যন্ত দখলমুক্ত করা হয়নি। কমিশন সরেজমিনে পরিদর্শন করে উচ্ছেদের জন্য চিঠি দিলেও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে বাধা সৃষ্টি করে। তারা অবৈধভাবে অবস্থান করছে। মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশের বলে তারা শিকড় গেঁড়েছে। তাহলে নদী রক্ষা কমিশন কীভাবে নদী রক্ষা করবে।

দূষণ নিয়ে নদী কমিশনকে মানুষ দোষী করে, অথচ পানি দূষণের জন্য বড় ভূমিকা রাখছে ওয়াসা। পরিবেশের নামে কিছু নামিদামি সংগঠন রয়েছে। এদের অনেকের পরিবেশ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। চাঁদাবাজি করাটাই এদের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে।

জাগো নিউজ: দেশে কতগুলো নদী রয়েছে তা নদী কমিশন শনাক্ত করতে পেরেছে?

মনজুর আহমেদ চৌধুরী: সারাদেশের সব নদী চিহ্নিত করতে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে তথ্য চাওয়া হয়েছিল। সেখানে নয় শতাধিক নদী চিহ্নিত করা হয়। তার মধ্যে কিছু বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সেখানে নানা ধরনের কল-কারখানা, আবাসন, আশ্রয়কেন্দ্রসহ স্থাপনা তৈরি হয়ে গেছে। সেগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। নদী দখলের সঙ্গে সরকারের অনেকে রয়েছেন।

জাগো নিউজ: ঢাকার মধ্যে ঐতিহ্যবাহী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, টঙ্গীখাল ও শীতলক্ষ্যা নদীর পানি দূষণমুক্ত করতে আপনাদের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি না। এসব নদীর পানি দূষণ রোধে কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?

মনজুর আহমেদ চৌধুরী: প্রথমত আইনের প্রয়োগ করতে হবে, সেটি করা হচ্ছে না। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, টঙ্গীখাল ও শীতলক্ষ্যার পানি খুবই দূষিত হয়ে গেছে। কোনো কোনো স্থানে এসব নদীর নাব্য হারিয়ে গেছে। নদীর ওপর ১৮টির মতো সেতু হওয়ায় নৌ চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। এসব কারণে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ২০০৯ সালে নদীগুলোকে সংকটাপন্ন হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আলাদা আলাদা কমিটি গঠন করে কাজ করা হয়। সংকটাপন্ন ঘোষণার ১৪ বছরেও এসব নদী আগের রূপে ফেরাতে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। পদক্ষেপের বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে জানতে চাইলেও তাদের কাছে কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। ঢাকার মধ্যে ডিটেলস এরিয়া প্ল্যান (ড্যাব) এলাকার মধ্যে কমপক্ষে ১৪-১৫টি নদী রয়েছে। সবগুলো সংকটাপন্ন হিসেবে গণ্য হয়। এসব নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো মাথাব্যথা নেই।

জাগো নিউজ: নদীর পানি এমন দূষণের কারণে কী ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়?

মনজুর আহমেদ চৌধুরী: নদীর পানি দূষণের কারণে একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে। ঢাকার চারদিকের এলাকায় তৈরি হবে সংকটাপন্ন অবস্থা। ভয়াবহ রকমের পরিবেশ দূষণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। নদীর পানিতে হেভি মেটাল, টকসিন, মাইক্রোপ্লাস্টিক আসছে। এসব মানবদেহে প্রবেশ করে ক্যানসারে রূপ নিচ্ছে। সে কারণে প্রতিনিয়ত মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে এ ধরনের রোগী বেড়ে গেছে।

ঢাকার মধ্যে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৮০-৯০ মিটারে নেমে গেছে। এটি ধীরে ধীরে আরও গভীরে যাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য বড় সংকেত। ডাইং কোম্পানিগুলো প্রচুর পরিমাণে ভূগর্ভস্থ থেকে পানি তুলছে। তাতে বিভিন্ন রং ব্যবহার করে তা নদীতে ছেড়ে দিচ্ছে, কেউ কেউ আবার সেগুলো গর্ত করে মাটির নিচে ঢেলে দিচ্ছে। এর মাধ্যমে নদীর গণহত্যার মতো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। আমাদের জন্য ভয়াবহ অবস্থা অপেক্ষা করছে।

এমএইচএম/এএসএ/জিকেএস