ধর্ম

মক্কা-মদিনার দোয়া কবুলের বিশেষ স্থানসমূহ

ফখরুল ইসলাম নোমানী

Advertisement

হজের সফর দোয়া কবুলের অপূর্ব সুযোগ। হজ বা ওমরাহর জন্য ইহরামের নিয়ত করার সময় থেকেই দোয়া কবুল হওয়া শুরু হয়। হজের সফরে এমন কিছু সময় ও স্থান রয়েছে যে সময় ও স্থানে দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। যে স্থানগুলোতে নবি-রাসুলদের দোয়া কবুল হয়েছিল বলে বর্ণিত আছে। সেসব জায়গায় দোয়া করা বাঞ্ছনীয়। পবিত্র নগরী মক্কা-মদিনার বিভিন্ন জায়গায় দোয়া কবুল হয়ে থাকে। সেসব স্থানে আল্লাহ তাআলার ওপর পরিপূর্ণ আস্থা রেখে-মনোযোগসহ বিনম্রচিত্তে, অশ্রুসজল নয়নে দোয়া করা দরকার। এখানে দোয়া কবুলের প্রসিদ্ধ কিছু স্থান উল্লেখ করা হলো-

১. বাইতুল্লাহ দৃষ্টিগোচর হলে

আল্লাহর ঘর বাইতুল্লাহ দেখে দোয়া করা। বাইতুল্লাহ দেখামাত্র দোয়া করা। বর্ণিত আছে বাইতুল্লাহ প্রথম নজরে আসার পরে যে দোয়া করা হবে তা কবুল হবে।

Advertisement

২. হারাম শরিফের সীমানা

হারাম শরিফের সীমানা বাইতুল্লাহর পশ্চিমে জেদ্দার পথে শুমাইসি পর্যন্ত ২২ কি.মি., পূর্বে তায়েফের রাস্তায় ‘উরানা’ পর্যন্ত ১৫/১৬ কি.মি., দক্ষিণে ‘আযাতু লীন’ ইয়ামেনের রাস্তায় প্রায় ১২ কি.মি. এবং উত্তরে মদিনা শরিফের পথে ‘তানঈম’ পর্যন্ত প্রায় ৭ কি.মি.। এই সীমানার মধ্যে দোয়া করা।

৩. মসজিদুল হারাম

কাবা শরিফের চারদিকের বৃত্তাকার যে সুরম্য নান্দনিক মসজিদ গড়ে ওঠেছে তাই মসজিদুল হারাম। এ মসজিদুল হারামে দোয়া করলে তা কবুল হয়।

Advertisement

৪. হাতিমে কাবা

কাবা ঘরসংলগ্ন উত্তর দিকে অর্ধবৃত্তাকার দেয়ালঘেরা স্থান ‘হাতিমে কাবা’ ও ‘হুজ্জাতু ইসমাইল’। এই স্থানটুকু আগে কাবাঘরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তপ্রাপ্তির কিছুদিন আগে কাবা ঘরের সংস্কার করা হয়। এ সময় হালাল অর্থের অভাবে পূর্ণ কাবা নির্মাণ সম্ভব হয়নি বিধায় হাতিম অংশ বাদ রেখে বর্তমান কাবা ঘর নির্মাণ করা হয়েছে।

৫. মিজাবে রহমত

কাবা ঘরের ছাদের পানি পড়ার জন্য উত্তর পাশে হাতিমের ভেতরে মাঝ বরাবর সোনার পরনালা হচ্ছে মিজাবে রহমত।

৬. কাবা শরিফের রোকনসমূহ

কাবা ঘরের প্রত্যেক কোণকে রোকন বলা হয়। কাবা ঘরের উত্তর-পূর্ব কোণকে বলা হয় রোকনে ইরাকি, উত্তর-পশ্চিম কোণকে বলা হয় রোকনে শামি এবং দক্ষিণ-পশ্চিম কোণকে বলা হয় রোকনে ইয়ামানি। দক্ষিণ পূর্ব কোণকে বলা হয় রোকনে হাজরে আসওয়াদ। এগুলো দোয়া কবুলের স্থান।

৭. হাজরে আসওয়াদ

কাবা ঘরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে দেয়ালে লাগানো জান্নাতি পাথর হলো হাজরে আসওয়াদ। এখানেও দোয়া কবুল হয়। এ কোণ থেকেই হজ, ওমরা ও জিয়ারতকারীরা তাদের তওয়াফ শুরু করেন।

৮. মুলতাজিম

হাজরে আসওয়াদ ও কাবা ঘরের দরজার মধ্যবর্তী স্থানকে বলা হয় মুলতাজেম। এ স্থানের সঙ্গে বুক লাগিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করা। এটিও দোয়া কবুলের বিশেষ স্থান।

৯. বাবুল কাবা

কাবা ঘরের দরজা। দরজায় দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করা। এখানে দাঁড়িয়ে দোয়া করলেও মহান আল্লাহ বান্দার দোয়া কবুল করেন।

১০. মুস্তাজার

কাবার বহির্গমন দরজা। যেটি বর্তমানে দেওয়াল দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

১১. রোকনে ইয়ামানি ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যস্থল

কাবা ঘরের দক্ষিণ পার্শ্ব। তওয়াফের প্রতি চক্করে এ স্থানে এসেই কোরআনের সর্বোত্তম দোয়া পড়া হয়- ‘রাব্বানা আতিনা ফিদ দুনিয়া হাছানাতাও ওয়া ফিল আখিরাতি হাছানাতাও ওয়া কিনা আজাবান-নার।’ (সুরা বাকারা: আয়াত ২০১)

১২. মাতাফ

কাবা ঘরের চারদিকে মারবেল পাথরে মোড়ানো ধবধবে সাদা উন্মুক্ত স্থানই হলো মাতাফ বা তওয়াফের জন্য খোলা স্থান। যেখানে প্রতিদিন তওয়াফকারীদের জন্য রহমত নাজিল হতে থাকে।

১৩. মাকামে ইবরাহিম

কাবা শরিফের একটু পূর্ব দিকে মাতাফের মধ্যে যে পাথরখন্ড কারুকার্যখচিত বেরিকেডে সংরক্ষিত জান্নাতি ইয়াকুত পাথরসমূহের মধ্যে একটি ইয়াকুত পাথর হচ্ছে মাকাকে ইবরাহিম। যার ওপর দাঁড়িয়ে কাবা ঘর নির্মাণ করেছিলেন হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম। এ মাকামে ইবরাহিমকে নামাজের স্থান হিসেবে গ্রহণ করার দিকনির্দেশনা এসেছে কোরআনে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ اتَّخِذُوۡا مِنۡ مَّقَامِ اِبۡرٰهٖمَ مُصَلًّی

 ‘তোমরা মাকামে ইবরাহিমকে নামাজের স্থানরূপে গ্রহণ করো।’ (সুরা বাকারা: আয়াত ১২৫)

১৪. সাফা পাহাড়

কাবা শরিফের পূর্ব পাশের নিকটতম পাহাড় ‘সাফা’। এটি হজ ও ওমরার রোকন। এ সাফা পাহাড় থেকে সাঈ শুরু করতে হয়।

১৫. মারওয়া পাহাড়

সাফা পাহাড় থেকে মারওয়ায় এসে সাঈর চক্কর শেষ করতে হয়। সাফা থেকে মারওয়ার দূরত্ব ৪৫০ মিটার। সাফার মতো মারওয়া পাহাড়ে এসেও হজ, ওমরা পালনকারী ও জিয়ারতকারীরা আল্লাহর কাছে একান্ত মনে দোয়া করে থাকেন।

১৬. মাসআ

যেখানে হজ-ওমরা পালনকারীরা সাঈ করে থাকেন। অর্থাৎ সাফা পাহাড় ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থান। এখানে সাঈর সময় আল্লাহর কাছে দোয়া করা।

১৭. মিলাইনে আখদারাইন

সাফা পাহাড় থেকে সাঈ শুরু করে মারওয়া পাহাড়ের দিকে ৫০ গজ গেলেই মিলবে সবুজ রঙের লাইট দ্বারা চিহ্নিত প্রায় ৪০ হাত স্থান। এটি মিলাইনে আখদারাইন। এ স্থানটি পুরুষরা কিছুটা দ্রুত পায়ে অতিক্রম করবে। এ স্থানে আল্লাহর কাছে দোয়া করা।

১৮. আরাফাতের ময়দান

হজরত আদম ও হাওয়া আলাইহিমাস সালামের পুনর্মিলনের স্থান। এখানেই তাঁদের তওবা কবুল হয়। তাঁরা এই দোয়াটি পড়েছিলেন-

رَبَّنَا ظَلَمۡنَاۤ اَنۡفُسَنَا ٜ وَ اِنۡ لَّمۡ تَغۡفِرۡ لَنَا وَ تَرۡحَمۡنَا لَنَکُوۡنَنَّ مِنَ الۡخٰسِرِیۡنَ

‘রাব্বানা জালামনা আংফুছানা,ওয়া ইন লাম তাগফির লানা ওয়া তারহামনা লানাকুনান্না মিনাল খছিরিন।’ (সুরা আরাফ: আয়াত ২৩)

হাদিসে পাকে এসেছে, ক্ষমা প্রার্থনার সর্বোত্তম স্থান হলো আরাফাতের ময়দান। উত্তম দোয়া আরাফার দিবসের দোয়া এবং উত্তম কথা যা আমি এবং আমার আগের নবীরা বলেছেন। আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই তিনি একক তার কোনো শরিক নেই; রাজত্ব তারই প্রশংসাও তার; তিনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান।

১৯. জাবালে রহমত

দয়ার পাহাড়। এই পাহাড়ের পাদদেশেই আরাফাত সুবিস্তৃত ময়দানে অবস্থিত। ৯ জিলহজ সকাল থেকেই হজ পালনকারীরা আরাফাতের ময়দান ও তৎসংলগ্ন জাবালে রহমতে এসে অবস্থান নেয়। সূর্যাস্ত পর্যন্ত এখানে উপস্থিত থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনায় রোনাজারি করে। এখানের দোয়া আল্লাহ তাআলা কবুল করে নেন।

২০. মসজিদে নামিরা

জিলহজ মাসের ৯ তারিখ আরাফাতের দিন মসজিদে নামিরা থেকে হজের খুতবা দেওয়া হয়। এ মসজিদে জোহর ও আসর নামাজ জামাতে পড়া হয়। এখানের দোয়াও আল্লাহ তাআলা কবুল করে নেন।

২১. মুজদালিফা

জিলহজ মাসের ৯ তারিখ দিবাগত পুরো রাত মুজদালিফায় খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করতে হয়। এটি সব হজ পালনকারীর জন্য আবশ্যক। হজরত আদম ও হাওয়া আলাইহিমাস সালাম এখানে একত্রে রাতযাপন করেন। এখানের দোয়াও আল্লাহ তাআলা কবুল করেন।

২২. মিনা

শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ ও কোরবানির ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত স্থান মিনা। এখানেই আল্লাহ তাআলার আদেশে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম নিজের তরুণ ছেলে হজরত ইসমাইলকে কোরবানির জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন। এখনো হজ পালনকারীরা এ স্থানে দমে শোকর (কোরবানি) আদায় করেন।

২৩. মিনায় কঙ্কর নিক্ষেপের পর দোয়া করা

এ স্থানে শয়তান হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালামকে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করে। তাই তিনি শয়তানকে উদ্দেশ্য করে কংকর নিক্ষেপ করেন। তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে হজ পালনকারীরা আজও এখানে কংকর নিক্ষেপ করেন। কঙ্কর নিক্ষেপের সময় জামরাত থেকে একটু সরে গিয়ে দোয়া করা। এখানের দোয়াও আল্লাহ তাআলা কবুল করেন।

২৪. মসজিদে খায়েফ

ঐতিহাসিক মিনা প্রান্তরে ‘মসজিদে খায়েফ’ অবস্থিত। এখানে আদিকাল থেকে শেষ নবি হজরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামসহ ৭০ জন পয়গম্বর আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করেছেন। এ স্থানেও দোয়া কবুল হয়।

২৫. জমজমের পানি পান করার সময়

পবিত্র নগরী মক্কা ও মদিনায় জমজমের পানি পান করার সময় দোয়া করা। জমজমের পানি পান করার সময় আল্লাহর কাছে যা খুশি তা চাইবেন। এখানে যে দোয়াই করবেন; আল্লাহ তাআলা তা-ই কবুল করবেন।

২৬. শেষে বিদায়ী তওয়াফ

হজের সব কাজ সম্পন্ন হলে দেশে ফেরার আগে বিদায়ী তওয়াফ করতে হবে। তাওয়াফ শেষে মুলতাজামের কাছে গিয়ে দোয়া করা। মুলতাজামে চেহারা, বুক, দুই বাহু ও দুই হাত রেখে দোয়া করা। এটিই হজ ও ওমরা পালনকারীদের জন্য শেষ সুযোগ। এ সুযোগকে যথাযথ কাজে লাগানো হজ ও ওমরাহ পালনকারীদের একান্ত কর্তব্য।

২৭. রিয়াজুল জান্নাত

হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার ঘর থেকে মসজিদে নববির মিম্বর এর মধ্যস্থিত স্থান। বর্তমানে মসজিদে নববির যে অংশ টুকুতে সবুজ রং এর কার্পেট বিছানো আছে। তাই রিয়াজুল জান্নাত। সেখানে নামাজ পড়া অনেক সৌভাগ্যের বিষয়। এখানে দোয়া করলেও মহান আল্লাহ কবুল করে নেন।

উপরোল্লিখিত স্থানসমূহ ছাড়াও পুরো হারাম শরিফেও দোয়া কবুল হওয়ার কথা বর্ণিত আছে। এ ছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মস্থান, হজরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার বাড়ি, জাবালে নুর, জাবালে সওর, মসজিদে নববির উস্তুয়ানা, দারে আরকাম, মেহরাবে নববি ও আসহাবুস সুফফার স্থানসমূহতে দোয়া কবুল হয়।

দোয়া করার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি করা যাবে না। আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ও আস্থা রেখে দোয়া করা খুবই জরুরি। দোয়ার সময় এ বিশ্বাস মনে পোষণ করা যে, আল্লাহ অবশ্যই আমার কথা শুনছেন এবং আমার দোয়া কবুল করছেন। এমনকি হজ ও ওমরাহ সম্পন্ন করে বাড়ি ফিরে আসার পরও ৪০ দিন পর্যন্ত হাজিদের দোয়া কবুল হতে থাকে এবং হাজি যত দিন পর্যন্ত ইচ্ছাকৃত কোনো কবিরা গুনাহে লিপ্ত না হবেন, ততদিন পর্যন্ত তাঁর দোয়া কবুল হতে থাকবে।

আল্লাহ তাআলা সবাইকে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর হেদায়াত নসিব করুন। হে আল্লাহ! আমাদের সকলকে আপনার মকবুল বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত করুন। আমিন।

লেখক: ইসলামি চিন্তক ও গবেষক।

এমএমএস/জিকেএস