আইন-আদালত

কুড়িগ্রামের ১১ জনের বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষীর জবানবন্দি

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন সংঘটিত হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কুড়িগ্রামের উলিপুর ও রাজারহাটের ১১ জনের বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষী মো. মফিজুল ইসলাম তার জবানবন্দি পেশ করেছেন। তার জেরার জন্য আগামী ২৫ জুলাই পরবর্তী দিন ঠিক করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

Advertisement

সাক্ষ্যগ্রহণের নির্ধারিত দিনে রোববার (৪ জুন) ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ দিন ঠিক করে আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলম।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী প্রসিকিউটর সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি জানিয়েছেন, ওইদিন (২৫ জুলাই) সাক্ষীর জেরা শেষ হলে পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণ করা হবে।

আদালতে এদিন রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন প্রসিকিউটর সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি ও প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল। অন্যদিকে আসামিপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট আব্দুস শুকুরি খান। তবে আসামিপক্ষের অন্য দুই আইনজীবী অ্যাডভোকেট গাজী এম এইচ তামিম ও অ্যাডভোকেট আব্দুস সাত্তার পালোয়ান এদিন উপস্থিত ছিলেন না।

Advertisement

এ মামলায় বর্তমানে আসামি সংখ্যা ১১ জন। তাদের মধ্যে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন- মো. নুরুল ইসলাম ওরফে নুর ইসলাম (৭১), এছাহাক আলী ওরফে এছাহাক কাজী (৭৩), মো. ইসমাইল হোসেন (৭০), মো. ওছমান আলী (৭০), মো. আব্দুর রহমান (৬৫), মো. আব্দুর রহিম ওরফে রহিম মৌলানা (৬৫), মো. শেখ মফিজুল হক (৮১), মো. ছাইয়েদুর রহমান মিয়া ওরফে মো. সাইদুর রহমান (৬৪) ও আব্দুল কাদের (৬৭)। অন্য দুজন পলাতক। গ্রেফতারের স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করেননি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।

এর আগে গ্রেফতার আসামিদের মধ্যে মো. শাহজাহান আলী ও মকবুল হোসেন ওরফে দেওয়ানী মকবুল নামে দুজন মারা যান।

প্রসিকিউটর সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি জানান, এর আগে মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) গঠন করে ওপেনিং স্ট্রেটমেন্ট ও সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ঠিক করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এরই ধারাবাহিকতায় আজ মামলায় সাক্ষীর জবানবন্দি নেওয়া হয়।

তিনি জানান, এ মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ছিল ১৩ জন। এরমধ্যে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকা মো. শাহজাহান আলী ও মকবুল হোসেন নামের দুই আসামি সম্প্রতি মারা যান। এখন মামলায় গ্রেফতার ও পলাতক আসামি মোট ১১ জন। এরমধ্যে গ্রেফতার ৯ জন কারাগারে আর অন্য দুজন পলাতক।

Advertisement

২০২১ সালের ২৫ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে উলিপুর ও রাজারহাট উপজেলার ১৩ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।

সংস্থার ৮০তম প্রতিবেদন জমার পর এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এ মামলার ১৩ আসামির মধ্যে ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দুজন পলাতক রয়েছেন। তদন্ত প্রতিবেদনের তিন ভলিউমে ৩৭৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে ওই প্রতিবেদন তুলে ধরেন তদন্ত সংস্থার প্রধান এম সানাউল হক। এসময় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) মো. রুহুল আমীনসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ১৩ আসামির বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি থেকে তদন্ত শুরু হয়ে একই বছরের ২৪ অক্টোবর শেষ হয়। আটক, নির্যাতন, অপহরণ, গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগের ১৬টি অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে ৭৪৫ জনকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে।

আসামিদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগপ্রথম: ১৯৭১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর আনুমানিক ১০টার দিকে কুড়িগ্রামের উলিপুর থানাধীন পাঁচপীর রেলস্টেশন আর্মি ও রাজাকার ক্যাম্পের ইনচার্জ রাজাকার আ. হামিদ মওলানা ওরফে ডাগ্গিল মওলানার (মৃত) নেতৃত্বে ১৫-১৬ জন সশস্ত্র রাজাকার পাকিস্তানি আর্মি নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধার বাবা আব্দুল জব্বার আনছারী ওরফে আনছারী মাস্টার ও নিরীহ নিরস্ত্র পনির উদ্দিন মুন্সিকে বাড়ি থেকে অপহরণ করে নির্যাতন করে। পরদিন সন্ধ্যায় দুজনকে গুলি করে হত্যা করে পাঁচপীর রেলওয়ে স্টেশনের পাশে মাটিচাপা দেয়।

দ্বিতীয়: ১৯৭১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভোরে হামিদ মওলানার নেতৃত্বে রাজাকার নুর ইসলামসহ ১৫-১৬ জন দুর্গাপুর গ্রামে হামলা করে ১০ জনকে আটক করে। এরমধ্যে মাকরু শেখকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি আর্মি। বাকি সবাইকে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে তওবা করিয়ে ছেড়ে দেয়।

তৃতীয়: ১৯৭১ সালের ১ সেপ্টেম্বর আনুমানিক ভোর ৫টায় উলিপুরের পাঁচপীর রেলস্টেশনের আর্মি ও রাজাকার ক্যাম্পের ইনচার্জ রাজাকার হামিদ মওলানার নেতৃত্বে রাজাকার মফিজসহ ১৫-১৬ জন সশস্ত্র রাজাকার ৫-৬ জন পাকিস্তান আর্মি নিয়ে উলিপুর থানাধীন ঢেকিয়ারাম গ্রামের স্বাধীনতার স্বপক্ষের মুক্তিকামী জনতাকে অত্যাচার নির্যাতন করার জন্য হামলা চালায়। সেখানে স্বাধীনতার স্বপক্ষের ও বীর মুক্তিযোদ্ধার বাবা রজব আলী সরকারকে হাত ও চোখ বেঁধে অপহরণ করে নির্যাতন করে। এরপর তাদের হত্যা করে মরদেহ পানিতে ফেলে দেয়।

চতুর্থ: ১৯৭১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর উলিপুরের পাঁচপীর রেলস্টেশন আর্মি ও রাজাকার ক্যাম্পের ইনচার্জ রাজাকার কমান্ডার হামিদ মওলানার (মৃত) নেতৃত্বে কাজী এছাহাকসহ ১৫-১৬ জন সশস্ত্র রাজাকার ৫-৬ জন পাকিস্তান আর্মি নিয়ে আওয়ামী লীগ করার কারণে পাঁচপীর গ্রামের নশির উদ্দিনকে আটক করে। তাকে নিয়ে স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি এবং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুল জলিল সরকারের বাড়িতে হামলা করে ছোট ভাই আব্দুল মজিদকে আটক করে। তারপর তাকে দিয়ে গর্ত করে সেখানে তাকে গুলি করে হত্যার পর মাটিচাপা দেয়। বাড়িঘরে লুটপাট চালিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।

পঞ্চম: ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর পাঁচপীর রেলস্টেশন আর্মি ও রাজাকার ক্যাম্পের ইনচার্জ রাজাকার আ. হামিদ মওলানার (মৃত) নেতৃত্বে রাজাকার ইসমাইলসহ ১৫-১৬ জন সশস্ত্র রাজাকার ও ১০-১২ জন পাকিস্তান আর্মি আওয়ামী লীগ সমর্থন করার কারণে গোড়াই পাঁচপীর গ্রামে হামলা করে। সেখানে আকবর আলী সরকার ও আজিজার রহমানকে আটক করে রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের নির্যাতন করে গুলি করে হত্যা করে।

ষষ্ঠ অভিযোগ: ১৯৭১ সালে ৯ অক্টোবর রাজাকার ওসমানসহ ১৫-১৬ জন পাক আর্মি নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা জহুর উদ্দিন ব্যাপারীর বাড়িতে হামলা করে তাকে অপহরণ করে নির্যাতন করে এবং পরে গুলি করে হত্যা করে।

সপ্তম: ১৯৭১ সালে ২৫ অক্টোবর রাজাকার আব্দুর রহমানসহ পাকিস্তানি আর্মি নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা ফুলজার হোসেনকে আটক করে। এরপর ফুলজার হোসেনের বাবা হুসেন আলী ও মা গোজন বেওয়াকে আটক করে নির্যাতন করে। এছাড়া মোখছেদ আলীসহ ফুলজার হোসেনের দুই ভাইকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে।

অষ্টম: বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গফুর ও আমির উদ্দিন বাবা-মাকে দেখতে বাড়িতে আসার খবর পেয়ে ১৯৭১ সালের বাংলা কার্তিক মাসের ১০ তারিখে পাঁচপীর রেলস্টেশন আর্মি ও রাজাকার ক্যাম্পের ইনচার্জ রাজাকার আ. হামিদ মওলানার নেতৃত্বে রাজাকার মো. আব্দুল বারীসহ ১৫-১৬ জন সশস্ত্র রাজাকার ও ১০-১২ জন পাকিস্তান আর্মি লঘরটারী গ্রামে হামলা করে। বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. গফুর ও আজিব উদ্দিনের আশ্রয়দাতা পনির উদ্দিনকে মারপিট করে মারাত্মকভাবে আহত করে। পরে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গফুর ও আজির উদ্দিনকে নির্যাতন করে হত্যা করে।

নবম: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন রমজান মাসে অসুস্থ মাকে দেখার জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মহব্বত আলী বাড়িতে এসে অভিযুক্ত রাজাকারদের ভয়ে রাতের বেলায় প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের পরিত্যক্ত বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন। রাজাকাররা খবর পেয়ে ৮ নভেম্বর সকাল ১০টার সময় হামলা করে রাজেন্দ্র চন্দ্র রায়ের বাড়ি থেকে মহব্বত আলীকে নিরস্ত্র অবস্থায় অপহরণ করে পাঁচপীর রেলওয়ে স্টেশন আর্মি ও রাজাকার ক্যাম্পে আটক করে। পরে রাতে গুলি করে হত্যা করে।

দশম: ১৯৭১ সালের ১০ নভেম্বর দুপুরে রাজাকার কমান্ডার হামিদ ও রাজাকার মকবুলসহ ৪-৫ জন সশস্ত্র রাজাকার ও ১০-১২ জন পাকিস্তান আর্মি মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ায় মো. মফিজল হক ও তার চাচাতো ভাই নুরুল হোসেনদের বাড়িঘরে লুটপাট চালায় ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।

এগারতম: ১৯৭১ সালে ১৩ নভেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধারা কুড়িগ্রাম জেলার সদর অর্জুনডারা পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্পে গোলা ছুড়লে উভয়পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়। এসময় পাকিস্তান আর্মিরা ওসমান মিয়াকে গুলি করে হত্যা করে এবং হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়।

বারতম: ১৯৭১ সালে উলিপুরে রাজাকাররা পাকিস্তানি আর্মি নিয়ে বেশ কয়েকটি গ্রামে হামলা চালায়। সেখানে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। পরে কামাল উদ্দিন, মো. নাছির উদ্দিন ও আইয়ুব আলীসহ অনেককে আহত করে। মোছা. হাছিনা বেগমকে ধর্ষণ করে। এছাড়া প্রায় ৭০০ লোককে হত্যা করে।

তেরতম: ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর রাজাকার নুরুল ইসলাম, কাদের ও ইছাহাক কাজীসহ ১০-১২ জন পাকিস্তানি আর্মি নিয়ে যমুনা গ্রামে হামলা করে। আশেপাশের গ্রামে হামলা চালিয়ে ফরহাদ ও আছর উদ্দিন ব্যাপারীসহ ২০-২৫ জনকে হত্যা করে।

চৌদ্দতম: রাজাকাররা গোড়াই মিয়াজিপাড়া গ্রামে হামলা করে দছির উদ্দিনের বাড়িতে আগুন দেয় এবং নিরীহ গ্রামবাসী তবির উদ্দিনকে হত্যা করে।

পানেরতম: ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর কুড়িগ্রামের উলিপুরে রাজাকার ইছা খলিফাসহ রাজাকাররা মফিজ উদ্দিন সরকারকে গুলি করে হত্যা করে।

ষোলতম: দছির উদ্দিন ব্যাপারীকে জেলার পাঁচপীর রেলওয়ে স্টেশনে নিয়ে হত্যা করে মরদেহ মাটিচাপা দেয় রাজাকাররা।

এফএইচ/এমকেআর/জিকেএস