মতামত

বেড়া যখন ক্ষেতের ফসল খায়

লোকজ্ঞানীরা এই প্রাবাদিক বাণীর মর্ম জানেন। নাগরিক জীবনের মানুষ আজকাল তাদের প্রতি অতোটা দরদী নন, তাই জানার চেষ্টা করেন না সেই লোকমর্ম। কিন্তু তাই বলে তো ওই বাণীর মর্ম হারিয়ে যায়নি বা যেতে পারে না। লোভী মানুষ আর নির্লোভী মানুষের মধ্যে আকাশ আর পাতাল ব্যবধান, সেটা টের পাওয়া যায় যখন জনপ্রতিনিধিরাও সেই কাজে জড়িয়ে পড়েন।

Advertisement

আমরা অহরহই এরকম সংবাদ সংবাদপত্রের পাতায় এবং তাদের অনলাইন ভার্সনে ও বিভিন্ন নিউজ পোর্টালে পড়ি জনপ্রতিনিধিদের অপকীর্তির সংবাদ, যা তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কাজের সঙ্গে ঠিক মেলানো যায় না। জনগণের ভোটে নির্বাচিত বলেই যে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করে খেতে পারবেন না, সে-রকম কোনো বিধি তো চালু নেই।

তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করবেন, তাতে কোনো দোষ না থাকলেও, সেই বাণিজ্যের জন্য যদি ক্ষমতার সাহায্যে চালানো হয়, তাহলে তা বৈধতাকে দূরে ঠেলে অবৈধকে কোলে তুলে নেওয়া হয়। জনপ্রতিনিধির প্রধান দায়িত্ব গণমানুষের সম্পদ রক্ষা ও তাদের কল্যাণকে নিশ্চিত করা। উন্নয়নের কাজে মনোযোগী হওয়া। প্রাক্কলিত ব্যয় ও সময়ের মধ্যেই যাতে কাজ শেষ বা সম্পন্ন হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্বও জনপ্রতিনিধিদের। সেই জনপ্রতিনিধি যদি জনগণের সম্পদ নিজেরাই কুক্ষিগত করেন, তখন ওই প্রবাদটি মনের পর্দায় ভেসে ওঠে।

ফসল রক্ষার জন্য উৎপাদক কৃষক ক্ষেতে বেড়া দেয়। সেই বেড়াই যদি ফসল খেয়ে ফেলে, তাহলে ওই বেড়ার কোনো মূল্য থাকে? জনপ্রতিনিধি হচ্ছেন ফসলের ক্ষেতের বেড়াস্বরূপ। সেই তারাই যদি ক্ষেতের ফসল খেয়ে ফেলে, তাহলে জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব-কর্তব্য সবই ভেস্তে যায়। তাতে ক্ষতি হয় জনগণের, তাদের সম্পদের। বণিক বার্তায় প্রকাশিত এই সংবাদটুকু পাঠ করলে আমার মনে ওই প্রাবাদিক সত্যটি ভেসে ওঠে। আপনারাও পড়ে নিন ওই সংবাদের/ রিপোর্টের আদ্যোপান্ত।

Advertisement

পাহাড়, নদী ও সমুদ্রের মিলনস্থলে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। নদী দখল, পাহাড় কেটে বসত ও শিল্প স্থাপনে এখানকার প্রাণ-প্রকৃতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামের বড় সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে নদী ও সমুদ্র থেকে বালি উত্তোলনের ঘটনা। সুবিধাভোগী শ্রেশি ছাড়াও এ অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছেন জনপ্রতিনিধিরা।

সম্প্রতি বেশ কয়েকটি অভিযানে বঙ্গোপসাগরের সন্দ্বীপ চ্যানেল থেকে অনুমোদন ছাড়াই বালি উত্তোলনের প্রমাণ পেয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ছাড়াও এসব অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। নিয়মবহির্ভূতভাবে বালি উত্তোলনের কারণে দেশের গুরুত্বপূর্ণ নৌ-রুটের ক্ষতি হওয়ার পাশাপাশি ভাঙনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযুক্ত বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধির শাস্তি প্রদান করেছে অবৈধ পথে সমুদ্র চ্যানেল থেকে বালি উত্তোলনের দায়ে।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম আল মামুন, একই উপজেলার বাড়বকুণ্ড ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাদাকাত উল্লাহ মিয়াজি ও বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলী জাহাঙ্গীর এ তিন জনপ্রতিনিধির নির্বাচনী এলাকা চট্টগ্রাম বন্দরের সন্নিকটে কুমিরা-সীতাকুণ্ড-মিরসরাই সমুদ্র চ্যানেলসংলগ্ন। দেশের প্রধান জাহাজ ভাঙা শিল্পাঞ্চল এ সমুদ্র তীরে।

সমুদ্রের তীর রক্ষা ও জেগে ওঠা চর অপসারণের অজুহাতে এ তিন জনপ্রতিনিধি তাদের নিজস্ব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া আদেশ সৃজন করে রাতের আঁধারে বালি উত্তোলন ও বিক্রি করছেন। অভিযোগের ভিত্তিতে সরেজমিনে গিয়ে সত্যতাও পায় পরিবেশ অধিদপ্তর। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় অর্থদণ্ড করা হয়েছে এসব জনপ্রতিনিধির। অপরাধের দায়ে দণ্ডিত হলেও এ জনপ্রতিনিধিরা এখনো বহাল রয়েছেন। (বণিক বার্তা/২৮ মে, ২৩)

Advertisement

রিপোর্টের এই অংশটুকু পাঠের পর কি বিস্তারিত জানার দরকার আছে? চমকে ওঠার মতো তথ্য হচ্ছে পরিবেশ অধিদফতরের আদালতে শাস্তি পাওয়ার পরও, তাদের পদচ্যুত করা হয়নি। তারা যে অপরাধ করেছেন তা তারা স্বীকার করেছেন এবং জরিমানাও পরিশোধ করেছেন। এই প্রমাণ তো আইনের হাতেই আছে। কিন্তু তাদের সেই অপরাধ স্থানীয় সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চেতনায় ন্যায়ের কোনো ঢেউ তোলেনি। এমনকি তারা জানেনও না যে উপজেলা, ইউনিয়ন স্তরের জনপ্রতিনিধিরা এমন অন্যায় নিজেরাই করছেন, যা অপরাধের শামিল বা পরিবেশের ক্ষতির জন্য দায়ী, যা জাতির সার্বিক ক্ষতির অংশ। সেই অপরাধীরা অপরাধ স্বীকার করার পরও তারা জনগণের প্রতিনিধির আসনে বহাল থাকেন কেমন করে, সেটা এক বড় প্রশ্ন।

তারা যে ঘুসের বিনিময়ে ঊর্ধ্বতনদের মন জয় করেছেন, এই সহজ সরল সত্য সবাই বোঝেন। দেশের সরকারি অফিসগুলোর ঘুস খাওয়ার যে ওপেন সিক্রেটটি সরেজমিনে তদন্ত ছাড়াই বোঝা যায়, এই সত্য কি সরকার জানেন না? জানেন, কিন্তু যাদের ওপর রাজনৈতিক সরকারের নির্ভরতা, সেই প্রশাসনিক আমলাদের দায়িত্ব-কর্তব্য কী তারা আইন মেনে করেন? আইনের নামে ও আদালতের নামে, আপিলের নামে অন্যায়কে যারা প্রলম্বিত করেন, তারা আর যাই হোন, সৎ ও ন্যায়পরায়ন নন। জনপ্রনিধি হওয়ার যোগ্যতাও তাদের নেই।

যদি উল্লিখিত বালিখোর জনপ্রতিনিধিরা তাদের পদ থেকে চ্যুত হতেন সাময়িকভাবে এবং তার বিরুদ্ধে করা মামলা যে পর্যন্ত শেষ না হবে, ততদিন পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করতে পারবেন- এ ব্যবস্থা নেওয়া হতো তাহলে যারা অন্যায়ভাবে বালি উত্তোলন, পাহাড় কেটে বসতি ও শিল্প কারখানা বানানোর চেষ্টা করছেন, তাদের সেই লোভ ঠেকানো যেতো। বন-জঙ্গল-নদী নালা-পাহাড় ও সাগর যে আমাদের সামাজিক জীবনের জন্য সব থেকে বড় প্রয়োজন, সেটা আমরা জেনেও ওই বালিখোর, পাহাড়খোর, সমুদ্রখোর, নদীখোর, বৃক্ষখোর, জলাধারখোর এবং গণমানুষের পরিবেশখোরদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা যেতো। কিন্তু সরকার তা করেননি?

সরকার প্রশাসনের ঢিলেমির জন্য খেসারত দিয়ে যাচ্ছে আমজনতা। জনগণ, প্রান্তিক জনগণ ভাবছেন সরকারের গোপন ইশারায়ই ওই চিহ্নিত অপরাধীরা জনপ্রতিনিধির চেয়ারে বসে আছেন। এই সুবাদে তারা তাদের এলাকায় শার্টের কলার উঁচিয়ে হাঁটছেন। তাতে প্রমাণিত হচ্ছে যে পরিবেশ আদালত তার কিছুই করতে পারেনি।

আসলে অপরাধ/অন্যায় প্রমাণিত হলে তার জনপ্রতিনিধিত্ব স্থগিত রাখার বিধান কি নেই? জনপ্রতিনিধিরা যদি এভাবে সুযোগ পায়, তখন বালিখোর, বৃক্ষখোরসহ সব সাধারণ ভূমি/পাহাড়খোরদের পোয়াবারো হয়ে ওঠে। তারা নতুন উদ্যমে ও অদম্য বেগে অন্যায় করতে থাকে। সহযোগী করে নেয়, স্থানীয় সরকারের মানসিকভাবে অসৎচাকরিজীবীদের। তাদেরই সহযোগিতায় স্থানীয় পর্যায়ে তারা ছড়ি ঘুরিয়ে চলছে।

ন্যায় ও কল্যাণ এখন তিরোহিত সমাজ সংসার থেকে। আমরা মানসিকভাবে অনৈতিকতাকেই বরণ করে চলেছি। নৈতিকভাবে অপরাধকে স্বীকার করে নিয়ে সরকারও তার রাজনৈতিক চরিত্রে লেপে নিয়েছে অন্যায়কারীদের সহযোগ। মূলত গোটা সমাজ ব্যবস্থায় এ রোগ এতটাই প্রকট যে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার কথাও ভাবেন না সরকার। বরং সরকার ক্ষমতার মধু আহরণে ব্যস্ত। কি করে এই মসনদে আসীন থাকা যায়, তার রাজনৈতিক নীলনকশা সৃষ্টি করে চলেছেন।

আমরা যারা সমাজের নিচের স্তরে ঘটমান বাস্তবতাকে দেখি, যখন দেখি, কি অবলীলায় স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিও জনগণের সম্পদ, যা সামাজিক সম্পদ, তা কুক্ষিগত করছেন এবং তার জন্য কোনো শাস্তি হচ্ছে না, তখন হতাশ হওয়া ছাড়া আমাদের আর কী করার থাকে?

বেড়া যখন ক্ষেতের ফসল খেয়ে ফেলে, তখন সরকারেরই বা কি করার আছে?

লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/এমএস