জাতীয়

মাটি মিশ্রিত বালি দিয়ে স্মৃতিস্তম্ভ, রড-সিমেন্টের মান নিয়ে সংশয়

একটি প্রকল্পের আওতায় সারাদেশের ২৮০টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করবে সরকার। ২০১৮ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটির সময়-ব্যয় কয়েক দফা বাড়ানোর পর ভৌত অগ্রগতি মাত্র ১৫ শতাংশ। সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) কয়েকটি সাইট সরেজমিনে পরিদর্শন করেছে। পরবর্তীসময়ে দেওয়া প্রতিবেদনে নির্মাণসামগ্রীর মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। কিছু সাইটে ব্যবহার করা হয়েছে মাটি মিশ্রিত বালি। ব্যবহৃত ইট, রড, সিমেন্ট নিয়েও রয়েছে সংশয়।

Advertisement

‘১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার জন্য ব্যবহৃত বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এ নির্মাণকাজ চলমান। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রকল্পটি ৪০টি জেলার ১১০টি উপজেলায় চলমান। ২৮০টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণসহ রায়ের বাজার বধ্যভূমির আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করা হবে এ প্রকল্পের আওতায়। ব্যয় বাড়িয়ে মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পটি সরেজমিনে পরিদর্শন করা হয় ২০২৩ সালের ২০ মে। আইএমইডির সহকারী পরিচালক মো. জুলহাস আলী সরকার সিলেট জেলার সদর উপজেলা, বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগর উপজেলা সরেজমিনে পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেন।

আরও পড়ুন>> মেগা প্রকল্প পরিদর্শনে যোগ হচ্ছে ড্রোন

আইএমইডির সহকারী পরিচালক মো. জুলহাস আলী সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘চলমান প্রকল্পের আওতায় বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণকাজে বালির বদলে মাটির সংমিশ্রণ পাওয়া গেছে। নির্মাণকাজে যে রড, সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে তার মান নিয়েও রয়েছে সংশয়। তাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুপারিশ করা হয়েছে। সরেজমিনে পরিদর্শন করে যতটুকু পেয়েছি ততটুকু তুলে ধরেছি। রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়-বিভাগকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

Advertisement

পরিদর্শনের আলোকে কিছু শর্তাবলি প্রতিপালন ও ব্যয় বাড়িয়ে প্রকল্পটির মেয়াদকাল ১ জুলাই ২০২৩ থেকে ৩০ জুন ২০২৫ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে আইএমইডি। প্রকল্পের মোট ব্যয় ৪৪২ কোটি ৪০ লাখ ১৩ হাজার টাকা। ১ জুলাই ২০১৮ থেকে ৩০ জুন ২০২১ মেয়াদে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পরিকল্পনা ছিল। পরে ব্যয় বাড়িয়ে জুন ২০২৩ নাগাদ মেয়াদ বাড়ানো হয়। এপ্রিল ২০২৩ সাল নাগাদ প্রকল্পের আওতায় মোট ব্যয় হয়েছে ২৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা, যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের মাত্র ৬ শতাংশ।

প্রকল্পের বিষয়ে আইএমইডির শর্তে বলা হয়েছে, জুন ২০২৫ সালের মধ্যে প্রকল্পের সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা ও বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা পুনর্বিন্যাস করে তা আইএমইডি ও পরিকল্পনা কমিশনসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সবার কাছে পাঠাতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে পূর্ণাঙ্গ কর্মপরিকল্পনা ও বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা এমনভাবে পুনর্বিন্যাস করতে হবে যাতে বর্ধিত সময়ে অবশ্যই প্রকল্পের সমুদয় কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করা যায়। সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। আছে আরও বেশকিছু শর্ত।

আরও পড়ুন>> ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ বাস্তবায়নে ২৪৫ প্রকল্প

মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে সিলেট জেলার সদর উপজেলা, বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগর উপজেলার তিনটি বধ্যভূমি পরিদর্শন করে আইএমইডি। সিলেট গণপূর্ত বিভাগের দুজন উপ-সহকারী প্রকৌশলীও উপস্থিত ছিলেন। এসময় দেখা যায়, সদর উপজেলার ক্যাডেট কলেজে স্থাপিত বধ্যভূমি মে মাসে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ বধ্যভূমির পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ফলে বৃষ্টির পানি জমাট বেঁধে রয়েছে। পিলারের প্লাস্টারেও সমস্যা। এখনো শহীদদের নামের তালিকার নামফলক স্থাপিত হয়নি।

Advertisement

বালাগঞ্জ উপজেলার গালিমপুরের বধ্যভূমির কাজ ৮০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী জানান, সওজের রাস্তা উন্নয়ন কাজের কারণে কোনো মালামাল নিয়ে আসা সম্ভব না হওয়ায় কাজটি কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। সম্প্রতি রাস্তার কাজটি সম্পন্ন হওয়ায় কাজ পুনরায় চলছে। সেখানে যে বালি দিয়ে কাজ করা হচ্ছে তাতে অনেক মাটির মিশ্রণ পাওয়া গেছে। ওসমানীনগর উপজেলার বধ্যভূমিটি বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অবস্থিত। সেখানে শহীদদের নামের তালিকার নামফলকটি সুন্দরভাবে স্থাপন করা হয়েছে। বধ্যভূমিটিও ভালো অবস্থায় রয়েছে।

মেয়াদ বাড়ানোর যৌক্তিকতা

চলমান প্রকল্পটির এপ্রিল, ২০২৩ পর্যন্ত আর্থিক অগ্রগতি ২৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা, যা অনুমোদিত প্রকল্প ব্যয়ের ৬ শতাংশ। ভৌত অগ্রগতি ১৫ শতাংশ। প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম হচ্ছে ২৮০ সাইটে বধ্যভূমি সংরক্ষণ এবং স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, রায়েরবাজার বধ্যভূমির কিছু আনুষঙ্গিক উন্নয়ন কাজ সম্পাদন। বধ্যভূমিগুলো অধিকাংশই ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে থাকায় সাইটের ভূমি অধিগ্রহণ আবশ্যক। জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম চলমান।

আরও পড়ুন>> মুজিবনগরে হবে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য উদ্যান

বাকি সাইটে সরকারি খাসজমি অথবা অন্য কোনো সংস্থা-প্রতিষ্ঠানের জমি। কিছু সংখ্যক সাইটের ভূমি বুঝে পাওয়া গেছে। সেখানে নির্মাণকাজ চলছে।

আইএমইডি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরের একটি অডিট আপত্তি রয়েছে। যার জবাব পাঠোনো হয়েছে। নিষ্পত্তির জন্য কার্যক্রম চলমান। প্রকল্পের ডিপিপিতে সংস্থান করা ডিজাইন অনুযায়ী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য প্রতিটি বধ্যভূমি সাইটে প্রয়োজনীয় ১৯ শতাংশ জমির সংস্থান হচ্ছে না। কাজেই যে সব সাইটে মডেল ডিজাইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ১৯ শতাংশ জমির সংস্থান নেই সেখানে বর্তমানে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর একজন ও অফিস সহায়ক একজন কর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছে। এ দুজন কর্মচারী দিয়ে প্রকল্প দপ্তরের দাপ্তরিক কার্যাদি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

আইএমইডির প্রতিবেদন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রকল্পের পরিচালক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম জাগো নিউজকে বলেন, এটা ভুলভাল প্রকল্প। জমি নেই কীভাবে স্মৃতিস্তম্ভ হবে। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোরও দরকার নেই। আইএমইডি রিপোর্ট দেখি তার পরে ফরোয়ার্ড করে দেবো। আমি পিডি (প্রকল্প পরিচালক) নই, দায়ে পড়ে পিডি হয়েছি।

এমওএস/এএসএ/এমএস