মতামত

বাজেট যেমন হল

নিত্যপণ্যের দামে কিছুটা ছাড় পাওয়া গেল কি না, এটুকুর বাইরে বাজেট নিয়ে আমজনতার বিশেষ আগ্রহ সাধারণত থাকেনা। জিডিপি-র মারপ্যাঁচ, আয় কম আবার ব্যয় বেশি তাই রাজকোষ ঘাটতি, বিনিয়োগে হযবরল অবস্থা ইত্যাদি নিয়ে খামখা রাতের ঘুম নষ্ট করে কে? এবারের বাজেটে ঠিক এমনটাই ঘটেছে। সাধারণ মানুষের আগ্রহ একদম কম ছিল না, কারণ তারা জানে তাদের কথা ভাববার শাসন ব্যবস্থা বাংলাদেশে নেই। এমনকি নির্বাচনী বছরের বাজেটেও জনতুষ্টির চেষ্টা করেন নি অর্থমন্ত্রী।

Advertisement

বাজেট মানে সরকারের জমা-খরচের হিসাব। বাজেট মানেই, কিছু বাড়লে অন্য কিছু কমবে। সেই নিরীখেই বিচার করতে হবে বাজেটকে। বাংলাদেশের কর প্রথা ভয়ংকর নির্বতনমূলক। পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল রাজস্ব ব্যবস্থায় গরিব মানুষকে কর দিতে হয় এবং হিসেব করলে ধনীদের চাইতে বেশিই দিতে হয়। উৎপাদন শুল্ক, বিক্রয় কর, ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন করের মতো পরোক্ষ কর গরিব-বড়লোক দেখে না।

গরিব মানুষ যখনই প্যাকেজড পণ্য কেনেন, যেমন ওষুধ, সাবান, চাল বা আটা অথবা মোবাইল ফোন রিচার্জের মতো কোনো সেবা নেন, তখন প্রত্যেক বার তাদেরও পরোক্ষ কর দিতে হয়। বড়লোকের তুলনায় গরিব নিজেদের রোজগারের অনেক বেশি অংশ নানা পণ্য কিনতে ব্যয় করেন, ফলে হিসাব কষলে হয়তো দেখা যাবে, আয়ের শতাংশ হিসেবে বড়লোকদের তুলনায় গরিবই বেশি কর দিচ্ছেন।

মনে রাখা দরকার, দেশের মাত্র এক শতাংশ মানুষ আয়কর দেন। বড় পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিকদের মতো বহু মানুষ প্রকৃত রোজগার চেপে যেতে পারেন। যদি ভর্তুকির কথা বলি তাহলে দেখব দরিদ্র থেকে কোটিপতি, সবাই জ্বালানি খাতে সমান ভর্তুকি পান। সরকারি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বড়লোকের ছেলেমেয়েরাও নামমাত্র খরচে পড়াশোনা করে। বলতে গেলে সেগুলো ওদেরই দখলে চলে গেছে। ধনী চাষি অনেক বেশি মাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন, ফলে এই সারের ভর্তুকি গরিবের তুলনায় বড়লোক চাষিদের পকেটেই পৌঁছে অনেক বেশি।

Advertisement

বরাবরের মতোই বাজেটে চাওয়া অনেক, কিন্তু তা বাস্তব সম্মত না। বাজেটে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭,৬১,৭৮৫ কোটি টাকা, অন্যদিকে আয় ধরা হয়েছে ৫,০০,০০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ অর্থ বছরের শুরুটাই হচ্ছে ২,৬১,৭৮৫ কোটি টাকার বিশাল ঘাটতি নিয়ে। অথচ এই সাত লাখ কোটি টাকা জিডিপির মাত্র ১৫ শতাংশের কিছু বেশি। এবং বছর শেষে তাও বাস্তবায়িত হয় না। কোনো বছরই ব্যয় অনুযায়ী আয় করতে পারছে না সরকার।

এবারও সরকার মোট রাজস্ব প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে ৫ লাখ কোটি টাকা, যা প্রাক্কলিত জিডিপির ১০ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড- এর জন্য ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা যা গত অর্থ বছরের চেয়ে ১৬ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি। অথচ গত এপ্রিল পর্যন্ত চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছে মোট লক্ষ্যের মাত্র ৬১ শতাংশ। এখানে জবাবদিহিতার প্রশ্ন জড়িত। এই যে কোনো বছরই এনবিআর তার লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনা, এর জন্য কোথাও জবাবদিহিতা নেই। কেন পারছে না তার কোন স্বচ্ছ ব্যাখ্যাও নেই।

অর্থমন্ত্রী বাজেট দলিলে যে মধ্যমেয়াদী সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি দিয়েছেন, সেখানে বলেছেন, “বাংলাদেশে কাঙ্খিত পরিমাণের চেয়ে অনেক কম রাজস্ব আহরণের পেছনে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো, অনেক বড় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত, কর অব্যাহতি, কাঠামোগত দুর্বলতা, জটিল কর ব্যবস্থাপনাএ তথ্য বৈষম্য এবং কর প্রদানে অনীহার সংস্কৃতি প্রভাবক হিসেবে কাজ করে”।

কিছু কথা নিজেই বলেছেন, রাজস্ব প্রশাসনের ডিজিটালাইজেশন ও অটোমেশনের ব্যাপ্তি বাড়ানো, কর আদায়ে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছ ও প্রগ্রেসিভ কর ব্যবস্থাপনা করা দরকার যেখানে ধনী লোক বেশি কর দিবেন। কিন্তু এগুলো কোনোটাই করতে সরকার পারছে না এবং তার জন্য দৃশ্যমান কোনো প্রচেষ্টাও নেই।

Advertisement

অর্থমন্ত্রী জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরেছেন সাড়ে সাত শতাংশ এবং বলেছেন মূল্যস্ফীতি থাকবে ছয় শতাংশ। ডলার নেই, তাই আমদানি কম। বিনিয়োগে স্থবিরতা। এমনিতেই এখন ৯ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ দিশেহারা। ফলে এই হিসেব পুরোটাই শুধু কল্পনা, বাস্তবের সাথে যার কোনো মিল নেই।

ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ নিবে সরকার। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকেই নিবে ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা এবং উচ্চ সুদের সঞ্চয়পত্র থেকেও নিবে। এতে করে ব্যক্তিখাতে ঋণের প্রবাহে বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। নতুন অর্থবছরে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ করার যে লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে, তা প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি, ফলে সুদ পরিশোধের চাপ নিয়ে অর্থনীতিকে চলতে হবে।

চলতি অর্থবছরে জিডিপির তুলনায় বেসরকারি বিনিয়োগের হার ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরে ছিল ২৪ দশমিক ৫২ শতাংশ। ডলার–সংকট, আমদানি হ্রাস, জ্বালানি সংকটে উৎপাদন কমসহ নানা কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে গেছে। তারপরও কী করে অর্থমন্ত্রী নতুন অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ বেড়ে ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ হবে বলছেন তা বোধগম্য নয়।

আয় নেই, কিন্তু ব্যয় বাড়ছেই। বিশেষ করে সরকার পরিচালনায় ব্যয় অত্যধিক বাড়ছে। কর-জিডিপি অনুপাত বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বে প্রায় সর্বনিম্নে। ফলে সরকার চালাতে হয় ধার করে। বাজেটের প্রায় ২০ শতাংশ ব্যবহার করতে হচ্ছে সুদ পরিশোধে। এ ছাড়া বেশি অর্থ ব্যয় হয় ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে সাড়ে ২০ শতাংশ। ব্যয়ের আরেকটি বড় খাত হচ্ছে সরকারি খাতে বেতন ও ভাতা—এর হার প্রায় ১৭ শতাংশ। অন্যান্য বছর না বললেও এবার অর্থমন্ত্রীকে বাজেটে বারবার কর-জিডিপির অনুপাত বাড়ানোর কথা বলতে হয়েছে। অন্য সময় হলে হয়তো অর্থমন্ত্রী এ বিষয়ে কথাই বলতেন না। কিন্তু আইএমএফের চাপে এখন বলছেন।

করযোগ্য আয় না থাকলেও আগামী বছর থেকে আয়কর দিতে হবে। রিটার্ন জমার স্লিপ বা প্রাপ্তি স্বীকারপত্র পেতে শূন্য রিটার্ন জমা (করযোগ্য আয় না দেখিয়ে রিটার্ন জমা) দিলেও দুই হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে। এ বিধানের কারণে সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হতে হবে। সরকারি-বেসরকারি সেবা পেতে যারা স্লিপের জন্য রিটার্ন জমা দেবেন, তারা নিশ্চয় সাধারণ মানুষ। দুই হাজার টাকা কর দিতে গিয়ে তাদের পাঁচ হাজার টাকার হয়রানি হতে হবে। নির্বাচনী বছরে সাধারণত সরকার সাধারণত জনতুষ্টিমূলক বাজেট করে। এবার তারও দিশা পাওয়া গেল না।

উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখা, রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়ানো, টাকার বিনিময় মূল্য স্থিতিশীল রাখা, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত, কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি, ব্যবসায়ীদের আস্থা প্রতিষ্ঠা, শিল্পের সম্প্রসারণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির বাস্তবতা নেই বাজেটে। কর ও ভ্যাটের চাপ প্রশমনের মাধ্যমে মধ্যবিত্তকে কিছুটা স্বস্তি দিলেও পারতেন অর্থমন্ত্রী।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।

এইচআর/এমএস