আ.স.ম আল আমিন
Advertisement
আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে সৃষ্টি করে তাদের জন্য ইসলামকেই একমাত্র দ্বীন হিসাবে মনোনীত করেছেন। তিনি বলেন ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে মনোনীত দ্বীন হলো ইসলাম।’ (আল-ইমরান: আয়াত ১৯) সেমতে অর্থনীতিও জীবন ঘনিষ্ঠ একটি ক্ষেত্র।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আধুনিক যুগে অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার ১০ টি মুলনীতি বর্ননা করেছেন। তার মধ্যে একটি হলো- হালাল পন্থায় উপার্জন এবং হারাম বর্জন করা। ইসলাম মানুষকে হালালভাবে সীমাহীন উপার্জন করার পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। তবে হারাম পথে একটি পয়সাও উপার্জন করার অধিকার ইসলাম কাউকে দেয়নি।
ইসলাম পূর্ব যুগে তো দূরের কথা, বর্তমান সভ্য যুগেও অন্যান্য মতাদর্শের ভিত্তিতে উপার্জন করে ভোগ- বিলাসের বৈধতা দেননি। তবে যে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সিল রয়েছে বা লাইসেন্স করে নিলে উপার্জন বৈধ। এবং রাষ্ট্রের ধার্যকৃত কর পরিশোধ করার মাধ্যমে যে কোনো আয় ব্যক্তি মালিকানা সাব্যস্ত হবে।
Advertisement
আধুনিকযুগে মানুষ তিনটি দর্শনে অর্থ উপার্জন করে-
১. পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা
২. সমাজতন্ত্র অর্থব্যস্থা
৩. ইসলামি অর্থ ব্যবস্থা
Advertisement
পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা
অর্থনীতির বুনিয়াদি চার বিষয় সমাধান করার একমাত্র পথ। তাহলো- সমাজের প্রত্যেককে বানিজ্যিক ও উৎপাদনের কার্যক্রমে পূর্ণ স্বাধীন ছেড়ে দাও। তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে দেওয়া হবে যে, সে বেশির থেকে বেশি মুনাফা অর্জনের জন্য যে পদ্ধতিকে সংগত মনে করবে তা গ্রহণ করবে।
সমাজতন্ত্র অর্থব্যবস্থা
সমাজতন্ত্র অর্থব্যবস্থার মূলনীতি হলো তিনটি- ১. ব্যক্তি মালিকানা ২. লাভের প্রবর্তনা ৩. রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্তি। এই তিন মূলনীতির মাধ্যমে যত খুশি ব্যক্তি মুনাফা অর্জন করতে পারবে।
ইসলামি অর্থব্যবস্থা
সর্বাগ্রে একটি বিষয় জানা দরকার, ইসলাম শুধু কোনো অর্থব্যবস্থার নাম নয়। বরং এটি একটি দ্বীন, অতএব কোরআন হাদিসে প্রচলিত অর্থে বর্তমান যুগের অর্থনৈতিক পরিভাষায় পেশ করার মতো, কোনো অর্থ ব্যবস্থা উপস্থাপন করেনি। আমাদের আরেকটি বিষয় অস্পষ্ট রয়ে গেলো। অর্থনীতির বুনিয়াদি বিষয়। তাহলো চারটি- ১. প্রয়োজন নিরূপণ ২. উপকরণ নির্ধারণ ৩. আয়ের বণ্টন ৪. উন্নয়ন ইত্যাদির শিরোনামে কোরআন-সুন্নাহ ও ইসলামি ফিকহের মাঝে সরাসরি কোনো আলোচনা বিদ্যমান নেই।
তবে জীবনের অন্য শাখাগুলোর মতো অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইসলাম যেই বিধানাবলি নির্দেশ করেছে। তা অনুযায়ী অর্থ উপার্জন করাতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। ইসলাম এবং অন্যান্য অর্থ ব্যবস্থার মাঝে পার্থক্য হলো- পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্র অর্থব্যবস্থার ক্ষেত্রে সীমা ছাড়া উপার্জন করার অনুমতি দিয়েছে, সে ক্ষেত্রে হালাল-হারামের তারতম্য করেনি।
ইসলামি বিধানে ব্যবহারিক জীবনে কিছু কাজকে হালাল এবং কিছু কাজকে হারাম বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্র অর্থ ব্যবস্থায় হালাল হারামকে চিহ্নিত না করার কারনে ইসলামি অর্থব্যবস্থা উপরোক্ত দুটি অর্থব্যবস্থা কে বৈধতা দিতে কোনোভাবে সমর্থন করে না।
এখন পর্যন্ত আমরা অর্থ উপার্জন করলাম, তবে বৈধভাবে উপার্জনের কারণে যে যেখানে সেখানে আমরা খরচ করবো ইসলাম ব্যক্তিকে একেবারে স্বাধীন ও বাধা-বন্ধনহীনভাবে ছেড়ে না দিয়ে অর্জিত অর্থের উপর ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইসলাম বিধি-নিষেধ জারি করেছেন।
হালালভাবে উপার্জিত অর্থ মাত্র তিনটি উপায়েই ব্যবহার করার জন্য ইসলাম অনুমতি দিয়েছে। তাহলো-
১. হালাল পন্থায় ভোগ
২. বৈধ ব্যবসায় বিনিয়োগ
৩. আল্লাহর পথে ব্যয়
হালাল পন্থায় ভোগ
মানুষের হালাল পথে অর্থ উপার্জন শুধু বৈধ পথেই খরচ করতে পারবে। অবৈধভাবে ব্যয় করার কোনো সুযোগ নাই। এমনকি টাকা আছে দেখি বেশি অপচয় করবো তাও নয়, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
اِنَّ الۡمُبَذِّرِیۡنَ کَانُوۡۤا اِخۡوَانَ الشَّیٰطِیۡنِ ؕ وَ کَانَ الشَّیۡطٰنُ لِرَبِّهٖ کَفُوۡرًا
‘যারা অপব্যয় করে, তারা তো শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রবের প্রতি অতি অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা বনি ইসরাঈল: আয়াত ২৭)
তাছাড়া ইসলামে অপব্যয় ও অপচয় নিষিদ্ধ। তবে অপচয়কারীর তুলনায় অপব্যয়কারী অধিক পাপী। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা অপব্যয়কারীকে শয়তানের ভাই বলে ঘোষণা করেছেন। অন্যদিকে অপচয়ের কারণে মানুষের জীবন থেকে বরকত কমে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَّ کُلُوۡا وَ اشۡرَبُوۡا وَ لَا تُسۡرِفُوۡا ۚ اِنَّهٗ لَا یُحِبُّ الۡمُسۡرِفِیۡنَ
‘আর তোমরা আহার করো ও পান করো; কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা আরাফ: আয়াত ৩১)
ইসলামি সমাজে মানুষ তার বৈধ ইনকামও এমনভাবে খরচ করতে পারে না যা নিজের চরিত্রের ও সমাজের ক্ষতির কারণ হয়। এই জন্য নাচ-গান, রং-তামাসা, মধ্যপান, জুয়া, বাজি ও লটারী নৈতিকতা বিরোধী বিলাসিতা। তাই এ সব কিছু ইসলামে নিষিদ্ধ।
এসব নিষিদ্ধ পথ ত্যাগ করে নিজের ও পরিবার-পরিজনের জন্য স্বাভাবিক ব্যয় নির্বাহ ও মধ্যম ধরনের জীবন যাপন করার জন্যই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাগিদ দিয়েছেন।
বৈধ ব্যবসায় বিনিয়োগ
নিজের প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ব্যয় নির্বাহের পর উদ্বৃত্ত ধন-সম্পদকে ব্যবসায়, কৃষি-শিল্প কিংবা এই ধরনের অন্যান্য কাজে বিনিয়োগ করার জন্য ইসলামে অনুমতি রয়েছে। নিজের পক্ষে এককভাবে সম্ভব নাহলে অন্যের সঙ্গ লাভ-লোকসানের অংশীদারিত্বের অর্থাৎ বাইয়ে মুদারাবার ভিত্তিতে এই জাতীয় কাজে অর্থ বিনিয়োগ করার সুযোগ রয়েছে।
মুসলমানের কর্তব্য হলো, সব সময় আল্লাহকে স্মরণ করা এবং হালাল পদ্ধতিতে আয়-উপার্জনের চেষ্টা করা। হাদিসে পাকে এসেছে, ‘সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী; কেয়ামতের দিন নবি, সত্যবাদী ও শহিদদের সঙ্গে থাকবে।’ (তিরমিজি ১২০৯)
ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য শুধু মুনাফা অর্জন নয় বরং এর দ্বারা মানুষের সঙ্গে পরিচিতি বাড়বে। তখন তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা। আন্তরিকতা দেখানো এবং হাস্যোজ্জ্বলভাবে কথা বলা উচিত। যাতে অন্যদের অন্তরে আপনার ইজ্জত-সম্মান এবং ভালোবাসাও ঠিক থাকে।
তারা আপনার কোনো কথা সহজে মান্য করে। তাহলে ইসলামের সৌন্দর্য অন্যদের কাছে তুলে ধরা সহজ হবে। ঈমানদারীর সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করার মধ্যমে আল্লাহপাক অগণিত রিজিক দানের ওয়াদা করেছেন।
আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয়
নিজস্ব ও পারিবারিক খরচ মিটিয়ে ও ব্যবসা বিনিয়োগের পর উদ্বৃত্ত অর্থ আল্লাহর পথে ব্যয় করা উত্তম। তাছাড়া আল্লাহর পথে দান করার দ্বারা বিপদ মুছিবত দূর হয়। এই জন্য মুসিবত আসার আগে আল্লাহর পথে দান করা আমাদের সবার উচিত। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَنۡفِقُوۡا مِمَّا رَزَقۡنٰکُمۡ مِّنۡ قَبۡلِ اَنۡ یَّاۡتِیَ یَوۡمٌ لَّا بَیۡعٌ فِیۡهِ وَ لَا خُلَّۃٌ وَّ لَا شَفَاعَۃٌ ؕ وَ الۡکٰفِرُوۡنَ هُمُ الظّٰلِمُوۡنَ
‘হে মুমিনগণ! আমি তোমাদের যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে দান করো, সে দিন আসার আগে, যে দিন কোনো বেচাকেনা থাকবে না, কোনো বন্ধুত্ব থাকবে না, কোনো সুপারিশ থাকবে না। আর অবিশ্বাসীরাই সীমালঙ্ঘনকারী।’ (সুরা বাকারা: আয়াত ২৫৪)
লেখক: কেন্দ্রীয় আহবায়ক, বাংলাদেশ কওমী ছাত্রপরিষদ।
এমএমএস/এএসএম