আন্তর্জাতিক

সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে গেছেন ইমরান খান

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, যখন ইমরান খানকে মনে হতো এমন এক নেতা যিনি পাকিস্তানের সর্বময় ক্ষমতাধর জেনারেলদের কর্তৃত্ব অস্বীকার করছেন এবং এরপরও রক্ষা পেয়ে যাচ্ছেন। গত ৯ মে আধাসামরিক বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর তার বিক্ষুব্ধ সমর্থকরা সারাদেশে সামরিক স্থাপনায় হামলা চালায়। তবু সুপ্রিম কোর্টের আদেশে মুক্ত হন পাকিস্তানের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।

Advertisement

তখন দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ হিসেবে, দৃশ্যত সেনাবাহিনীর প্রতি যার কোনো ভয় নেই এবং অধীনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কর্মীদের একটি দল রয়েছে, ইমরান খান চলতি বছরের শেষের দিকে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনে সহজেই জয়ী হতে চলেছেন বলে মনে করা হচ্ছিল।

আরও পড়ুন>> গ্যালাপের জরিপ: পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা ইমরান খান

কিন্তু তিন সপ্তাহ পরে দৃশ্যপট পুরোপুরি বদলে গেছে। রাজনৈতিক দেয়াল চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে তাকে। ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফকে (পিটিআই) কার্যত ভেঙে দিয়েছেন সামরিক জেনারেলরা। অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা দলত্যাগ করেছেন, হাজার হাজার সমর্থককে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফের সরকার প্রকাশ্যে পিটিআই’কে নিষিদ্ধ করার কথা বলছে।

Advertisement

ইমরান নিজেও দুর্নীতি-ধর্মানুভূতিতে আঘাতসহ কয়েক ডজন মামলার মুখে। সম্ভবত সামরিক আদালতে তার বিচার হবে এবং দীর্ঘদিনের জন্য রাজনৈতিক নির্বাসনে যেতে পারেন তিনি। আপাতত পাকিস্তানের বেসামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ দৃঢ়ভাবে ফিরে আসতে দেখা যাচ্ছে।

আরও পড়ুন>> হুইলচেয়ার ছুড়ে ফেলে ধাক্কাতে ধাক্কাতে গাড়িতে তোলা হয় ইমরানকে

সেনাবাহিনীর নির্দেশেই হোক বা সুযোগের সদ্ব্যবহারের জন্যই হোক, শাহবাজ শরীফের সরকার পিটিআই’র ভাঙনকে সমর্থন করছে। তারা পাকিস্তানে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার জরুরি বলে উল্লেখ করেছে।

গত এক বছরে দেশটির অর্থনীতি খুব সামান্য বেড়েছে। ডলারের বিপরীতে রুপির দরপতনের পরিপ্রেক্ষিতে মাথাপিছু বার্ষিক আয় প্রায় ২০০ ডলার কমে ১ হাজার ৫৬৮ ডলারে নেমে এসেছে। মে মাসে বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ৩৭ শতাংশ ছুঁয়েছে বলে ধারণা করা হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার যে রিজার্ভ রয়েছে, তা দিয়ে মাত্র এক মাসের আমদানিমূল্য মেটানো যাবে। দেশটির মাথার ওপর ঘুরপাঁক খাচ্ছে ঋণখেলাপি হওয়ার ঝুঁকি।

Advertisement

আরও পড়ুন>> দেশ ছাড়ছেন শিক্ষিত পাকিস্তানিরা

পরিহাসের বিষয় হলো, একসময় এই ইমরান খানই পাকিস্তানি জেনারেলদের সমর্থন পেয়েছিলেন। তাকে ব্যবহার করে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে দমনের কৌশল নিয়েছিল সেনাবাহিনী। ২০১৮ সালে ইমরান প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তার সরকারকে সামরিক-বেসামরিক ‘হাইব্রিড’ বলে বর্ণনা করেছিলেন কিছু পর্যবেক্ষক।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত জেনারেলরা ইমরানের আত্মপ্রচারণা ও আত্মমুগ্ধতায় বিরক্ত হয়ে পড়েন, যার ফলে গত বছর অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় তাকে।

আরও পড়ুন>> দলে পদত্যাগের হিড়িক, ঘরে ‘সংযোগবিচ্ছিন্ন’ ইমরান খান

গত ৯ মে সামরিক স্থাপনাগুলোতে যে হামলার ঘটনা ঘটে, তা ছিল নজিরবিহীন এবং এটি এখন স্পষ্ট যে, জেনারেলদের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছেন ইমরান খান। ওই সহিংসতার ‘পরিকল্পনাকারী, প্ররোচনাদাতা, অনুপ্রবেশকারী এবং অপরাধী’ সবার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সেনাবাহিনীর মুখপাত্র।

এরপর থেকেই ‘অনুতপ্ত’ পিটিআই নেতারা ইমরান খানের কাছ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিতে থাকেন এবং সেনাবাহিনীর প্রতি আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দেন। তাদের অনেকেই রাজনীতি থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছেন। অধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ করেছে, সরকার এই অভিযানে কথিত দাঙ্গাবাজদের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ বিরোধীদেরও আটক করছে।

আরও পড়ুন>> ইমরান অযোগ্য ঘোষিত হলে পিটিআই’র নেতৃত্বে কোরেশি

পাকিস্তানের সামরিক জেনারেলরা এখন কী কৌশল নেবেন? বেসামরিক রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে তাদের অতীত পদক্ষেপের অভিজ্ঞতা বলছে, ইমরান খানকে জেলে ঢোকানো, তাকে নির্বাসনে পাঠানো বা রাজনীতিতে অযোগ্য ঘোষণা করা হতে পারে। কিংবা দলের যতটুকু অবশিষ্ট রয়েছে তা নিয়ে নির্বাচনে লড়ার অনুমতি দেওয়া হতে পারে, যদিও এর সম্ভাবনা খুবই কম। অথবা কোনো নির্বাচনই হবে না- এমন সিদ্ধান্তও নিতে পারেন জেনারেলরা। গুঞ্জন রয়েছে, তারা পাকিস্তানে একটি টেকনোক্র্যাটিক সরকার গঠন করতে চান।

আরও পড়ুন>> ওরা আমাকে ১০ বছর জেলে রাখতে চায়: ইমরান খান

ইমরান খান অবশ্য এখনো এসবের বিরুদ্ধে। সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে আগাম নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন তিনি। তবে যা-ই হোক না কেন, পাকিস্তানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা যে এত শিগগির ফিরছে না, সেটি স্পষ্ট।

ইমরানকে সাইডলাইনে বসালেই তার জনপ্রিয়তা কমে যাবে না। সেক্ষেত্রে শাহবাজ শরীফ বা জেনারেলরা যাকেই দেশ পরিচালনার জন্য বেছে নেবেন, তাকে বিপুল সংখ্যক পিটিআই সমর্থকের বিপক্ষে লড়তে হবে। চাপ সামলাতে হবে জেনারেলদেরও। অবিরত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ তাদের সাধারণ পাকিস্তানিদের কাছে ক্রোধের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে।

আরও পড়ুন>> ইমরান খানসহ ৮০ পিটিআই নেতার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

রাজনৈতিক ভাষ্যকার জাহিদ হুসেন বলেন, সেনাবাহিনী নিজেকে আটকাতে পারবে না। এর হস্তক্ষেপ করার তাগিদ অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু তাদের আগে কখনো এতটা আত্মপরাজিত বলে মনে হয়নি।

কেএএ/