অর্থনীতি

১২ কোটির নাগরদোলা কিনতে ৪৯ কোটি টাকা আবদার

জামালপুরের একটি প্রকল্পের জন্য বিদেশ থেকে ফেরিস হুইল (নাগরদোলা) কিনতে প্রায় ৪৯ কোটি টাকা চেয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। একই মানের নাগরদোলা কিছুদিন আগে ফরিদপুরের একটি প্রকল্পের জন্য কেনা হয় ১২ কোটি টাকায়। একই বিদেশি রাইড কিনতে ৩৭ কোটি টাকা বাড়তি আবদার করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। একই সঙ্গে ব্যয় কমানোর সুপারিশ করেছে।

Advertisement

জামালপুরে শেখ হাসিনা সাংস্কৃতিক পল্লি নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় এ আবদার করেছে এলজিইডি। চলমান প্রকল্পটি ১২৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে অনুমোদিত হয়। পরবর্তীসময়ে ব্যয় প্রায় ৮০ শতাংশ বাড়িয়ে ২২৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে প্রথম সংশোধিত প্রকল্প অনুমোদিত হয়। এখন পর্যন্ত ব্যয়ের অগ্রগতি ১৩০ কোটি টাকা। কাটছাঁট করে ২৩৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে নতুন প্রস্তাবে। এ বিষয়ে সভায় আলোচনা করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছে পরিকল্পনা কমিশন।

আরও পড়ুন>>মেগা প্রকল্প পরিদর্শনে যোগ হচ্ছে ড্রোন

পরিকল্পনা কমিশন জানায়, প্রকল্পের অন্যতম খাত নাগরদোলা স্থাপন। যেহেতু এটি একটি সম্পূর্ণ আমদানি পণ্য সেহেতু বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ডলার ব্যবহার করে নাগরদোলা কেনার যৌক্তিকতা আলোচনা করা যেতে পারে। এ নাগরদোলা কেনার জন্য চার দশমিক এক মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৪৯ কোটি টাকার প্রয়োজন। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিলাসবহুল এ রাইড কেনার বিষয়ে অর্থ বিভাগের মতামত চাওয়া যেতে পারে।

Advertisement

পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্পের বিষয়ে মতামত দিয়ে জানায়, আউটসোর্সিং ও অন্য খাতগুলোর ব্যয় বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। আরবান রোড/ফুটপাত এবং ড্রেনেজ/ব্রিজ অনুমোদিত আরডিপিপিতে (সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) অন্তর্ভুক্ত থাকলেও প্রস্তাবিত আরডিপিপি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এতে পরিপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো প্রকার সমস্যা হবে কি না এ বিষয়ে সভায় আলোচনা করা যেতে পারে।

এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জাগো নিউজকে বলেন, ‘নাগরদোলার দাম বেশ কম আছে। তবে একই নাগরদোলা আগে ১২ কোটি টাকায় কেনা হলেও বর্তমানে কেন ৪৯ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হলো বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখবো। আমরা সরকারের টাকার সর্বোত্তম ব্যবহার করবো। একটি টাকা যাতে অপচয় না হয় সে কাজ আমরা করবো।’

এলজিইডি প্রকল্পটি সংশোধনের দাবি করে জানায়, শেখ হাসিনা সাংস্কৃতিক পল্লির মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী প্রকল্পের অপরিহার্য খাত হিসেবে নাগরদোলাকে নির্ধারণ করা হয়েছে। এটা স্থাপন করার জন্য মোট পাঁচবার দরপত্র আহ্বান করেও ডিপিপির (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) বরাদ্দ অর্থের মধ্যে দরপত্রদাতা পাওয়া যায়নি। এটা সম্পূর্ণ আমদানিভিত্তিক পণ্য এবং আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় ডিপিপির বরাদ্দ অর্থে কেনা সম্ভব নয় বিধায় প্রকল্পে ব্যয় বেড়েছে। নাগরদোলা স্থাপনের কাজ বাস্তবায়নের জন্য ন্যূনতম ৯ থেকে ১০ মাস সময়ের প্রয়োজন হওয়ায় প্রকল্পের সময়কাল এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পের সময়কাল এক বছর বাড়ার কারণে বেতন-ভাতাসহ অফিস ব্যবস্থাপনা ব্যয়ও বেড়েছে।

আরও পড়ুন>>৬৭ লিফটে ৯৬ কোটি টাকার প্রস্তাব, কমিশনের প্রশ্ন

Advertisement

এলজিইডি জানায়, শেখ হাসিনা সাংস্কৃতিক পল্লি নির্মাণ প্রকল্প মূলত জামালপুর শহরের নগর স্থাপত্যের পুনঃসংস্কার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র উন্নয়ন প্রকল্প। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ও জামালপুর জেলার আটটি পৌরসভা এটা বাস্তবায়ন করছে।

প্রকল্পের উদ্দেশ্যজামালপুর শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বিদ্যমান পরিত্যক্ত লেক ও লেক সংলগ্ন পুরাতন ধর্মীয় এবং অন্য অবকাঠামোর সংস্কার, উন্নয়নের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও বিনোদন সুবিধার সম্প্রসারণ করা হবে। নগরবাসীর জন্য উন্মুক্ত স্থান তৈরির মাধ্যমে বাড়ানো হবে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। এলিভেটেড বেদিসহ নির্মাণ করা হবে শহীদ মিনার। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক আন্ডার গ্রাউন্ড আঞ্চলিক জাদুঘর নির্মাণ ও সেখানে ইন্টেরিয়র আইটেম স্থাপন, নয় তলাবিশিষ্ট সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও বহুমুখী হল নির্মাণ করা হবে।

এছাড়া ছয়তলা বিশিষ্ট একটি বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ, অ্যাম্পিথিয়েটার, পুকুর পুনঃখনন, বোট ক্লাব, মেলার স্থান ও ১১শ মিটার সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করা হবে। নাগরদোলা স্থাপন, মেকানিক্যাল, বৈদ্যুতিক ও আগুন নির্বাপক যন্ত্রপাতি স্থাপন, ওয়াটার ফাউন্টেন, থ্রিডি সিনেপ্লেক্স, নাইন ডি থিয়েটার হল স্থাপনসহ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকবে।

ব্যয়ের সঙ্গে বেড়েছে সময়

মূল প্রকল্পটি মার্চ ২০১৬ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১৯ মেয়াদে বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারিত ছিল। ব্যয় বাড়িয়ে প্রথম সংশোধিত প্রকল্পে এক বছর অর্থাৎ, ফেব্রুয়ারি ২০২০ নাগাদ মেয়াদ বাড়ানো হয়। এরপর ফেব্রুয়ারি ২০২১ সাল নাগাদ আবারও সময় বাড়ে। পরে আবার জুন ২০২২ ও জুন ২০২৩ দুই ধাপে সময় বাড়ানো হয়। চারবার মেয়াদ বাড়িয়েও প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। নতুন করে পরিকল্পনা কমিশনে জুন ২০২৪ সাল নাগাদ মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রকল্পের প্রধান প্রধান কার্যক্রম১৮ হাজার ৩১০ বর্গমিটার অনাবাসিক ভবন ও ০ দশমিক ৩৬ একর ভূমি অধিগ্রহণ এবং কেনা হবে।

প্রকল্পের অগ্রগতিফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখ পর্যন্ত প্রকল্পটির ব্যয় ১৩০ কোটি ২৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, যা মোট অনুমোদিত ব্যয়ের ৫৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

আরও পড়ুন>>সহজ শর্তে মিলবে ২৭৫ কোটি ডলার বিশ্বব্যাংক ঋণ

প্রকল্প গ্রহণের যৌক্তিকতা তুলে ধরে এলজিইডি জানায়, জামালপুর জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। জামালপুর পৌরসভা একটি ‘ক’ শ্রেণির পৌরসভা। জেলা শহরের কেন্দ্রস্থলে সরকারি পরিত্যক্ত জমির ওপর দুটি জলাধার ও পুরাতন ধর্মীয় উপাসনালয়সহ (মসজিদ ও মন্দির) সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতের বিভিন্ন স্থাপনা এখানে রয়েছে। বিগত সময়ে দেশে গ্রামীণ জনপদের উন্নয়নে সীমিত আকারে প্রকল্প নিলেও জামালপুর জেলার জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের তেমন উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়নি।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জামালপুর শহরের ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। বেড়েছে জনসংখ্যার ঘনত্ব। কিন্তু শহরের অবকাঠামো সুবিধা বিশেষ করে পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্রের সম্প্রসারণ ঘটেনি। জামালপুর শহরের মধ্যবর্তী স্থানে পরিত্যক্ত জলাধার ও অন্য স্থাপনার পরিকল্পিত উন্নয়ন, নগর জনগোষ্ঠীর জন্য একটি সাংস্কৃতিক, বিনোদন ও উন্মুক্ত স্থান তৈরির লক্ষ্যে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে।

এমওএস/এএসএ/জিকেএস