বর্ষার আগেই এবার চোখ রাঙাচ্ছে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু। বছরের প্রথম পাঁচ মাসেই দেশজুড়ে আক্রান্ত ছাড়িয়েছে দুই হাজার। মৃত্যুও হয়েছে ১৩ জনের। দেশে জুন থেকে সেপ্টেম্বর ডেঙ্গুর প্রজনন মৌসুম। এবার বর্ষা মৌসুম শুরু না হতেই আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে, যা গত বছরের প্রথম পাঁচ মাসের তুলনায় ছয়গুণ বেশি।
Advertisement
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হন ৩৭২ জন। ছিল না কোনো মৃত্যু। এবছর জানুয়ারি থেকে মে মাসের ৩১ তারিখ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন দুই হাজার ২২ জন। আর মৃত্যু হয়েছে ১৩ জনের। এরই মধ্যে দেশের ৪৪টি জেলায় শনাক্ত হয়েছে ডেঙ্গুরোগী। বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই ডেঙ্গুর এই চোখ রাঙানি জানান দিচ্ছে ভর মৌসুমে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে ডেঙ্গু।
আরও পড়ুন>> ডেঙ্গু প্রতিরোধে গণ-লিফলেট বিতরণ করবে দক্ষিণ সিটি
সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে মানুষকে সচেতন থাকার আহ্বান জনিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও নানা দিকনির্দেশনা দিয়েছে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে। কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এ রোগে আক্রান্ত রোগী যদি কোমরবিডিটি বা দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগে আক্রান্ত হয়, তাদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকে।
Advertisement
ডেঙ্গু রোগের বিস্তারকে সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়হীনতা ও দায়িত্বে অবহেলাকে দুষছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। যেহেতু রোগটি সারাবছর ধরেই ছড়াচ্ছে, তাই এটি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এডিস মশা নিধন কর্মসূচি সারাবছর অব্যাহতভাবে রাখতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুবিষয়ক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি মাসের ৩১ দিনে এক হাজার ৩৬ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মারা গেছেন দুজন। গত বছর অর্থাৎ, ২০২২ সালের মে মাসে ডেঙ্গু শনাক্তের সংখ্যা ছিল ১৬৩ জন, কারও মৃত্যু হয়নি। ২০২১ সালে করোনা মহামারি চলাকালে মে মাসে ৪৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়, এই সময়ে কেউ মারা যাননি। এর আগের বছর ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ১০ জন এবং ২০১৯ সালে ছিল ১৯৩ জন। ওই বছরগুলোয়ও মে মাসে কারও মৃত্যু হয়নি।
আরও পড়ুন>> ডেঙ্গু পরীক্ষায় ৫০০ টাকার বেশি নিলে ব্যবস্থা: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে আরও ৯৫ জন রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। নতুন রোগীদের মধ্যে ৮২ জন ভর্তি ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে। ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৩ জন। বর্তমানে সারাদেশে ২৮৩ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ২৪২ এবং ঢাকার বাইরে সারাদেশে ৪১ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। চলতি বছর ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে ঢাকায় এক হাজার ৩৭৮ এবং ঢাকার বাইরে ৬৪৪ জন।
Advertisement
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ (প্রাণিবিদ্যা বিভাগ) অধ্যাপক কবিরুল বাশার জাগো নিউজকে বলেন, সম্প্রতি হওয়া বৃষ্টিপাত এর মূল কারণ হতে পারে। অনেক জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে এডিস মশার লার্ভা। এর মধ্যে রয়েছে বহুতল ভবনের ছাদ, পার্কিংয়ের জায়গা, নির্মাণাধীন ভবনের বেজমেন্ট। বাসাবাড়িতে জমিয়ে রাখা পানিতেও জন্ম নিচ্ছে ডেঙ্গু মশা।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু নিধনে সঠিকভাবে কর্ম পরিচালনা করলে এ রোগের বিস্তার রোধ করা সম্ভব। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ও ডেঙ্গু টেস্টকারীদের ডেঙ্গু ধরা পড়লে তাদের বসবাসের স্থান যাচাই করে হটস্পট নির্ধারণ করতে হবে। এরপর সেসব জায়গায় ডেঙ্গু মশার বিস্তার রোধ করতে হবে। বিশেষ করে উড়ন্ত মশারা ডেঙ্গু ছড়ায়। তাই এই হটস্পট নির্ধারণ করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মশা নিধনে জনসম্পৃক্ততা ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোয় ফগিং করে উড়ন্ত এডিস মশা নিধন কর্মসূচি জরুরি।
আরও পড়ুন>> সব হাসপাতালে পরীক্ষাসহ ১১ পরামর্শ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের
তিনি আরও বলেন, এবছর জুন মাসের শেষ দিকে ঈদুল আজহার ছুটিতে মানুষজন ঢাকা থেকে গ্রামে যাবে। এই সময়ে শহর থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ গ্রামেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই ঢাকার বাইরে আঞ্চলিক শহর ও গ্রামে ডেঙ্গু নিধনে ব্যবস্থা নিতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি মাসের প্রথম ৩০ দিনে প্রায় দুই হাজার ডেঙ্গুরোগী শনাক্ত হয়েছে। সেই তুলনায় হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা কম। এর কারণ, রোগীদের অবস্থা বেশি খারাপ না হওয়া পর্যন্ত তারা হাসপাতালে আসছেন না।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দুই সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক নাজমুল ইসলাম। তিনি বলেন, এবছর অন্য বছরের তুলনায় মৌসুম শুরুর আগেই আক্রান্ত রোগী বেশি। তাই আগের চেয়ে এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি হওয়ার আশঙ্কা আছে। এরই মধ্যে অনেক রোগী আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসছেন। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। সাধারণ মানুষকে সচেতন থাকতে হবে।
ডেঙ্গুর প্রকোপে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ পরীক্ষায় অতিরিক্ত খরচ যাতে না হয় সেজন্য মূল্য উল্লেখ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ডেঙ্গু শনাক্তের পরীক্ষার ফি বাবদ সর্বোচ্চ ৫শ টাকা নিতে পারবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো। এর বেশি নেওয়া হলে ওই হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু শনাক্তের পরীক্ষার ফি ১০০ টাকা।
ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় বাড়ার শঙ্কায় হাসপাতালগুলোকে ডেঙ্গু স্ক্রিনিংয়ের পর্যাপ্ত কিটের ব্যবস্থা, প্রাদুর্ভাব অনেক বেশি বেড়ে গেলে আবাসিক চিকিৎসক ও আরএমওর কক্ষে অতিরিক্ত মেডিসিন বিশেষজ্ঞকে দায়িত্ব দেওয়া, হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত মশারির ব্যবস্থা করাসহ ১১টি পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখা।
২০২২ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২৮১ জন। বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ডেঙ্গুতে ২৭ জনের মৃত্যু হয়। একই সঙ্গে ওই বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। ২০২১ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২৮ হাজার ৪২৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। এর মধ্যে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়। করোনা মহামারি শুরুর বছর ২০২০ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা কম ছিল।
এএএম/এএসএ/জেআইএম