মতামত

মাঝরাতের ফোনকল এবং অতঃপর...

মাঝরাতে মোবাইল ফোন বেজে উঠল। এ সময় ফোন বেজে ওঠার কোনো কারণ নেই। গভীর রাতে তাদেরই ফোন বেজে উঠবে- যাদের ‘ফিসফাস-ফুসফাস’ জাতীয় ব্যাপার আছে। আমার এজাতীয় কোনো ব্যাপার নেই। অবাক হয়ে ঘুম-জড়ানো গলায় হ্যালো বললাম। ওপাশ থেকে ইনতাজ সাহেবের গলা ভেসে এলো।

Advertisement

কণ্ঠস্বর শুনে মনে হলো, তিনি কারও মৃত্যুসংবাদ দেবেন। প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুন্দর মায়াময় এ পৃথিবী থেকে একজন মানুষ চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন- এজাতীয় একটি দৃশ্যপট আমার চোখের সামনে তৈরি হতে না হতেই বিলীন হয়ে গেলো। ইনতাজ সাহেব কোনো মৃত্যু-সংবাদ দিলেন না। তার বদলে ভয়ার্ত গলায় যত দ্রুত সম্ভব আমাকে তার বাসায় যাওয়ার অনুরোধ জানালেন।

ইনতাজ সাহেবের বাসায় যাওয়ার পর আমাকে দেখে তিনি হায় হায় করে উঠলেন। তাকে সুস্থির হওয়ার উপদেশ দিয়ে পাশে বসা ভাবির কাছে জানতে চাইলাম-

: বিষয় কী?

Advertisement

ভাবি কথা বলতে উদ্যত হতেই ইনতাজ সাহেব তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন-

:বিষয় ভয়াবহ।

:কী রকম!

: আরিফ আর ওর মা মিলে আমারে পাগলা গারদে পাঠানোর সব ব্যবস্থা পাকা কইরা ফেলছে।

Advertisement

আরিফ ইনতাজ সাহেবের বড় ছেলে। অমায়িক ও মেধাবী। ভাবিও ধীরস্থির প্রকৃতির মহিলা। আমি কোনো সমস্যা দেখছি না। অথচ এরা দুজন মিলে কী এমন কাণ্ড করলেন যে, ইনতাজ সাহেবের মতো সুস্থ-সবল একজন মানুষ পাগল হওয়ার উপক্রম হওয়ায় তা ঠেকানোর জন্য মাঝরাতে আমাকে ডেকে আনা হয়েছে! আমি বিষাদমাখা হাসি হেসে ইনতাজ সাহেবকে বললাম-

: পাগল তো এখনও হননি!

: হইনি, তবে হওয়ার পথে...

: ঘটনা কী?

: আজ বাদে কাল পরীক্ষা। আর এখন রাত ২টার সময় আমার সুপুত্র ও তার মা মিইল্যা আমার কাছে টাকা চাইতেছে সেই পরীক্ষার ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র কেনার জন্য। চিন্তা করতে পারেন, কী ভয়ংকর ঘটনা?

: কীসের পরীক্ষা?

: চাকরির।

: প্রশ্ন ফাঁস হইছে, কে বলল?

: ওর এক বন্ধু।

: বন্ধু কোথায়?

: মমিসিং মেডিকেলের ইমার্জেন্সি বিভাগের সামনে দাঁড়াইয়া রইছে।

: বেশ তো। টাকা দিয়া দেন, প্রশ্ন নিয়া আসুক।

আমার কথা শুনে ইনতাজ সাহেব বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। সরু চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর তোতলাতে তোতলাতে বললেন-

: আপনে এইসব কী বলতেছেন! ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের জোরে আমার ছেলের চাকরি হবে? এরকম চাকরির মুখে আমি সাড়ে সাতবার থু দেই। থুঃ।

এবার ভাবি কথা বলে উঠলেন। ইনতাজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে সরোষে বললেন-

: তুমি যুধিষ্ঠির সাইজ্যা বইসা থাকলে কী হবে? অন্যরা কি বইসা থাকবে?

: অন্যরা বইসা থাকল, না শুইয়া থাকল- সেইটা আমার দেখার বিষয় নয়। আমি শুধু আমারটা দেখব।

: দেখ। দেখতে দেখতে দুনিয়া উদ্ধার করো।

এরকম একটা ডামাডোলের মধ্যে আমি আরিফের খোঁজ করলাম। তার কাছ থেকে মূল বিষয়টা আগে জেনে নেওয়া যাক। আরিফ পাশের রুমে দাঁড়িয়ে বাবা-মায়ের বাকযুদ্ধ শ্রবণ করছিল। আমি ডাক দিতেই সে ড্রয়িংরুমে এসে হাজির হলো। তাকে বললাম-

: তুমি কি সিওর, প্রশ্ন ফাঁস হইছে?

: হ্যাঁ।

: কীভাবে সিওর হইলা?

: আমার যে ফ্রেন্ডের সঙ্গে চাকরির দরখাস্ত করেছিলাম, সে আমাকে ফোন করে কনফার্ম করেছে।

: কী বলেছে সে?

: বলেছে, শিক্ষাজীবনের সব সার্টিফিকেটসহ পাঁচ হাজার টাকা জামানত হিসেবে রাখলেই প্রশ্নপত্র পাওয়া যাবে।

: সার্টিফিকেট জমা রাখতে হবে কেন।

: সিকিউরিটি হিসেবে। আর পাঁচ হাজার টাকা হচ্ছে ডাউনপেমেন্ট। প্রশ্ন কমন পড়লে পরে দশ লাখ টাকা দিতে হবে।

: টাকা না দিলে?

: সার্টিফিকেট ফেরত পাওয়া যাবে না।

এ পর্যায়ে ইনতাজ সাহেব বলে উঠলেন-

: চাকরির খাতায় নাম লেখানোর আগেই দশ লাখ খরচ। এই প্রক্রিয়ায় যারা এই প্রজাতন্ত্রের ‘সেবক’ হবে, তারা টাকা উসুল করার জন্য পাবলিকের গায়ের চামড়া তুলে নিতেও দ্বিধা করবে না। লালটু কসাই হবে এক-একজন।

প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে আরিফকে বললাম-

: তুমি যে রকম মেধাবী, তাতে নরমালি তোমার চাকরি হবে। ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র দিয়া গেটিস মারার প্রয়োজন নাই।

: আমিও প্রথমে কনফিডেন্টলি তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু পরে চিন্তা করে দেখলাম, প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ফলে আমাকে তো একটা অসম প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়তে হবে। এরকম একটা প্রতিযোগিতায় আমি যত মেধাবীই হই না কেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের সঙ্গে টিকতে পারব না।

আরিফের কথা শেষ হওয়ার পর ভাবি অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে একবার আমার দিকে, আবার ইনতাজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে যেন বুঝাতে চাইলেন- ওহে নির্বোধের দল; ভালো করে শুনে নাও, ছেলে আমার কী বলছে? হাঃ! আমরা মা-ছেলে মিলে কি এমনি এমনি রাত-দুপুরে প্রশ্নপত্র পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছি?

একটা কিছু বলা দরকার। সান্ত্বনা দেওয়ার সুরে আরিফকে বললাম-

: ইনশাআল্লাহ তোমার চাকরি হয়ে যাবে। আত্মবিশ্বাস বজায় রাখো।

: কীভাবে বজায় রাখব আঙ্কেল? প্রশ্ন আনতে যাওয়ার তাড়া দিয়ে বন্ধুটি একেকবার ফোন দিচ্ছে আর তার বিপরীতে আমার আত্মবিশ্বাস এক ডিগ্রি করে নিচে নামছে। এভাবে নামতে নামতে বর্তমানে আমার আত্মবিশ্বাস একেবারে শূন্যের কোঠায় এসে পৌঁছেছে। এখন আমার মানসিক অবস্থা এমন যে, ফাঁস হওয়া প্রশ্ন হাতে না পেলে আগামীকাল পরীক্ষার হল পর্যন্ত যেতে পারব কি না, সন্দেহ আছে।

আরিফের কথা শুনে আঁতকে উঠলাম। এ কী সাংঘাতিক ধরনের কথাবার্তা! ইনতাজ সাহেব ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। পরিবেশ হালকা করার মানসে আরিফকে জিজ্ঞেস করলাম-

: আচ্ছা, এই যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার কথা বলছো, এর জোগানদার কারা?

: আমি ঠিক জানি না। তবে আমার বন্ধু আমাকে বলেছে- আমরা প্রশ্ন আনতে যার কাছে যাব, তিনি মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক।

আরিফের কথা শুনে ইনতাজ সাহেব এমন জোরে সোফার ফোমে মুষ্ঠাঘাত করলেন- মনে হলো, সোফার ফোমগুলো সব ছাতু হয়ে হাওয়ায় উড়ে যাবে। কিছুটা সুস্থির হওয়ার পর আমাকে সাক্ষী মেনে ইনতাজ সাহেব বললেন-

: কারবার দেখছেন? ইস্টিশন কোথায় আর গাড়ি থামে কোথায়? তুই ব্যাটা করবি মাস্টারি। তা না কইরা এই ধরনের একটা কুকামের সঙ্গে যুক্ত হইছস! এনজিও খুলে দোকানদারি করা, পিএইচডি করার নাম কইরা বিদেশে গিয়ে আর ফেরত না আসা, কনসালটেন্সি ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে খ্যাপ মারা, অপরাজনীতি আর ছাত্রী নিপীড়নসহ জগতের সব অকাম করা শেষ। বাকি ছিল প্রশ্নফাঁস। এবার এইটাও পূরণ হইল।

: ঢালাওভাবে সবাইরে খারাপ বলা ঠিক নয়। শিক্ষকদের মধ্যে ভালোও আছেন অনেক।

আমার কথা শুনে ইনতাজ সাহেব গর্জে উঠলেন। কপাল কুচকে বললেন-

: ভা-লো! আপনি আগে ভালোর সংজ্ঞা নির্ধারণ করেন। তারপর সেই ভালোর খাতায় এ দেশের কয়জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের নাম ওঠে, তা আমি দেখতে চাই।

লেখক: কৃষিজীবী, মানুষ বাড়ি, কায়দাপাড়া, সদর, ময়মনসিংহ। mokamia@hotmail.com

এইচআর/ফারুক/এএসএম