ফিচার

বাংলাদেশ যেভাবে হলো বিশ্বশান্তির রোল মডেল

তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামা চতুর্দশ বলেছেন, ‘শান্তি মানে সংঘাতের অনুপস্থিতি নয়; দ্বন্দ্ব-পার্থক্য সবসময়ই থাকবে। শান্তি মানে এই পার্থক্যগুলো শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান করা; আলোচনা, শিক্ষা, জ্ঞান এবং মানবিক উপায়ের মাধ্যমে।’ সারাবিশ্বে ঠিক এটাই হচ্ছে। দ্বন্দ্ব এবং পার্থক্য সর্বত্র, প্রায় সব জাতি ,উপজাতির মধ্যে, অঞ্চলগুলোর মধ্যে এবং দেশের মধ্যে। এই কারণেই প্রতিনিয়ত সম্প্রীতি ও শান্তির অভাব রয়েছে এবং শান্তি পুনরুদ্ধার করার জন্য একটি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের জন্য ‘মধ্যস্থতাকারী’ প্রয়োজন।

Advertisement

আশির দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশ বিশ্বের কিছু স্থান ও অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। যখন শান্তিরক্ষার কথা বলা হয়, তখন বাংলাদেশের নাম ‘শান্তি বজায় রাখার ও রক্ষার প্রধান খেলোয়াড় হিসেবে একটি ভাবমূর্তি তৈরি করে’। বর্তমানে বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে সবচেয়ে বড় অবদানকারী এবং সে কারণেই এখন পর্যন্ত এর শান্তিরক্ষীদের হতাহতের সংখ্যা ১৬০ জনেরও বেশি।

শান্তিরক্ষীদের সেবা ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতি দিতে প্রতি বছর ২৯ মে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস। নীল পতাকার নিচে কাজ করা সামরিক কর্মীদের অবদানকে চিহ্নিত করার এটি একটি সুযোগ। গত সাত দশকে শান্তির জন্য প্রাণ হারিয়েছেন এমন ৪ হাজার ২০০ জনেরও বেশি শান্তিরক্ষীর স্মৃতিকে সম্মান জানানোরও এটি একটি সুযোগ।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ইউক্রেনীয় শান্তিরক্ষী সমিতি এবং ইউক্রেন সরকারের আনুষ্ঠানিক অনুরোধের পর। ২০০২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক শান্তিরক্ষা দিবস মনোনীত হয়। দিবসটি পালন শুরু হয়েছিল ২০০৩ সালের ২৯ মে। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের যুদ্ধবিগ্রহ তত্ত্বাবধান (UNTSO) নামক একটি শান্তি মিশনের বার্ষিকীকে চিহ্নিত করে যখন নিরাপত্তা পরিষদ মধ্যপ্রাচ্যে স্বল্প সংখ্যক জাতিসংঘের সামরিক পর্যবেক্ষক মোতায়েনের অনুমোদন দেয়। ইসরায়েল এবং তার আরব প্রতিবেশীদের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি পর্যবেক্ষণ করতে সহযোগিতা করে।

Advertisement

তখন থেকে ২ মিলিয়নেরও বেশি নারী ও পুরুষ। ৭২ টি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে কাজ করেছে, লাখ লাখ মানুষকে সরাসরি সহায়তা করেছে এবং অসংখ্য জীবন বাঁচিয়েছে। আজ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা ১২টি অপারেশনে ৮৭ হাজারের বেশি সামরিক, পুলিশ এবং বেসামরিক কর্মী মোতায়েন করেছে।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা শান্তি ও নিরাপত্তার প্রচার এবং বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করার জন্য সবচেয়ে কার্যকর আন্তর্জাতিক হাতিয়ারগুলোর মধ্যে একটি। এ কারণেই অনেক দেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষাকে সমর্থন করে এবং বৃহত্তর নিরাপত্তা ও নিরাপত্তার প্রচারে নিবেদিত এই প্রচেষ্টাকে সম্মান জানায়। শান্তিরক্ষা একটি বিনিময়যোগ্য দায়িত্ব যা সব জাতি ও জনগণকে উপকৃত করে।

আরও পড়ুন: যে কারণে পালিত হয় জাতিসংঘ দিবস

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন শুধু এককভাবে সংঘাতের অবসান এবং দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত তৈরিতে সম্পূর্ণরূপে সফল হতে পারে না। এটি সদস্য রাষ্ট্র, সুশীল সমাজ, বেসরকারি সংস্থা, জাতিসংঘের সংস্থা এবং অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গে একটি অংশীদারিত্বকে সহযোগিতা করে যা সাধারণ মানুষের জীবনে মৌলিক অধিকার যেমন স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা নিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আইনের শাসন, নারীর অধিকার, মানবাধিকারের মতো ক্ষেত্রগুলোতে বাস্তব উন্নতি আনার জন্য চেষ্টা করে।

Advertisement

বর্তমানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সর্বোচ্চ সংখ্যক বাংলাদেশি সামরিক কর্মী দায়িত্ব পালন করছেন এবং তাদের প্রাণহানিও উল্লেখযোগ্য। সেনা সদর দপ্তর অনুসারে, ২৩মে, ২০২২ পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনীর ১৩৯ সদস্য এবং ২২ পুলিশ সদস্যসহ ১৬১ জন কর্মকর্তা শান্তিরক্ষা মিশনে তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। এছাড়া অন্তত ২৫২ জন কর্মী এখনো পর্যন্ত গুরুতর আহত হয়েছেন। প্রায় ৬ হাজার ৮২৫ জন কর্মকর্তা বর্তমানে ১৪টি দেশে জাতিসংঘের মিশনে দায়িত্ব পালন করছেন এবং ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৭৮ জন এ পর্যন্ত ৪৩ টি দেশে একবার বা একাধিকবার বিভিন্ন সময়ে তাদের ৫৪টি মিশন সম্পন্ন করেছেন। ছোট জনবহুল সমস্যা সংকুল এই বাংলাদেশের জন্য এটা কম গর্বের বিষয় নয়। মোটকথা বিশ্ব শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

১৯৮৮ সালে জাতিসংঘের ইরাক-ইরান সামরিক পর্যবেক্ষক গ্রুপ মিশনে ১৫ জন পর্যবেক্ষক পাঠানোর মাধ্যমে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা যাত্রা শুরু হয়। পরের বছর বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী ও পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং বাংলাদেশ বিমান বাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে যোগদান করে। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী সর্বদা তার সৈন্যদের অবদানের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি ও স্থিতিশীলতা জোরদার করার জন্য জাতিসংঘের আহ্বানে অবিলম্বে সাড়া দিয়ে আসছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজ এবং জলের মধ্যে বিচরণের নৈপুণ্য রয়েছে এবং বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার এবং ফিক্সড উইং এয়ারক্রাফ্ট বেশ কয়েকটি মিশনে মোতায়েন রয়েছে।

বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী জাতিসংঘের সকল শান্তিরক্ষা মোতায়েন প্রশংসনীয় ও সফলতার সঙ্গে কাজ করেছে। তাদের সাহসিকতা এবং প্রতিভা অন্যান্য দেশের বাহিনীকে বিস্মিত করেছিল। প্রতিটি কাজেই বাংলাদেশিদের দক্ষতায় জাতিসংঘ কর্তৃপক্ষ বিমোহিত হয়েছে। ব্যক্তিগত দায়িত্ব, সাংগঠনিক কার্যকারিতা এবং সামরিক কার্যকারিতার জন্য, বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা যে কোনো শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে প্রায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এই বিশেষ মর্যাদা ও কৃতজ্ঞতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাটালিয়নকে প্রায় ৩৪টি বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শান্তিরক্ষায় তার দক্ষতা প্রদর্শন করতে হয়েছিল।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দক্ষিণ সুদানে বৈরী আবহাওয়া, পোকা-মাকড়, সাপ ও মশার উৎপাত রয়েছে। শান্তিরক্ষী বাহিনীর তিন শতাধিক সদস্য ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। তারপরও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা দেশটির উন্নয়নে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। মানবতার সেবায় নজির স্থাপন করেছেন। বাংলাদেশ নাম শুনলেই দক্ষিণ সুদানবাসীর মুখ থেকে ‘গুড’ শব্দটি উচ্চারিত হয়।

১৯৮৮ সাল থেকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে অদ্যাবধি বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা সর্বোচ্চ পেশাদারি মনোভাব, আনুগত্য ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। তাদের অনন্য অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে এবং আমাদের শান্তিরক্ষীরা শান্তিরক্ষা মিশনে একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে। কর্তব্যরত অবস্থায় আত্মোৎসর্গকারী দুই বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীকে মরণোত্তর ‘দ্যাগ হ্যামারশোল্ড মেডেল’ প্রদান করা হয় ২০২২ সালে।

পেশাদায়িত্ব, আর্তমানবতার সেবা, চিকিত্সা সেবা, শিশুদের লেখাপড়া করতে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলাসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শান্তিরক্ষীরা জনগণের নিকটাত্মীয়ের মতো জায়গা করে নিয়েছেন। এ কারণে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা ৪৩টি দেশের মধ্যে অনেক দেশেই সরকার ও জনগণ বাংলাদেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে অর্থনৈতিক বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছে। তারা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ বর্তমানে সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ। সংঘাতপ্রবণ দেশসমূহে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও শান্তি বজায় রাখতে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা যে মিশনেই গেছেন, সেখানে জাতিসংঘের পতাকাকে সমুন্নত ও উড্ডীন রাখার পাশাপাশি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সমুজ্জ্বল করেছেন।

এ কারণেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। সব দেশের জনগণ বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের ব্যাপক প্রশংসা করেন। তারা সবচেয়ে বেশি নিরাপদ মনে করেন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের। মোদ্দাকথা বাংলাদেশ যেন বিশ্বব্যাপী শান্তির এক মডেল হয়েছে।

আরও পড়ুন: চায়ের গল্প

কেএসকে/এএসএম