প্রবাস

প্রবাসীর বোবাকান্না মুছবে কে?

‘৬ বছর আগে কুয়েতে আসা। ভাবছিলাম এবার নতুন আকামা (কাজের অনুমতিপত্র) লাগলে দেশে ফিরবো। অনেকদিন দেশে যাই না, পরিবারের মুখ দেখি না। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা হয় না। বোনটার কোথায় বিয়ে হলো একটু দেখা দরকার। একটানা আর কত! কিন্তু পরিবারকে যখনই জানালাম দেশে যাওয়ার কথা ঠিক তখনই তারা বললো আগে তোর ছোট ভাইকে বিদেশে নিয়ে যা, তারপর তুই দেশে আসিস। এ কথা শুনে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো!’

Advertisement

আবেগঘন পরিবেশে, মায়া জড়ানো কণ্ঠে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন চাঁদপুরের করিম হাওলাদার (ছদ্মনাম)। ২০১৭ সালে ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে কুয়েতে যান তিনি।

করিম বলেন, থাই অ্যালুমিনিয়ামের কাজ জানা থাকায় তেমন কষ্ট করতে হয়নি বিদেশে। একটা দোকানে কাজ করছেন। ১২ ঘণ্টা ডিউটি। সকালের নাস্তা এবং দুপুরের খাবার হোটেলে খেতে হয়। কাজ শেষে বাসায় গিয়ে আবার রাতের রান্না-বান্না। এভাবেই পুরো সময়টা কাজে চলে যায় তার।

কেন আর কীভাবে কুয়েতে আসা বলছিলেন করিম, ‘৮ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশ যান করিম হাওলাদার। মানুষের কাছ থেকে ধার-দেনা করে ভিসার টাকা তুলেছেন। মায়ের অসুস্থতা, ছোট দুইভাই ও এক বোনের পড়াশোনা, বাবার পকেট খরচ সব মিলিয়ে নিজেই কাঁধে তোলে নেন পরিবারের দায়িত্ব। বোনটাকে তো বিয়ে দিতে হবে। পড়ালেখা বিদেশ আসার অনেক আগেই বন্ধ করে দিতে হয়েছে পরিবারের কথা চিন্তা করে।’

Advertisement

তিনি বলেন, ‘কুয়েতে খুব পরিশ্রম করতে শুরু করলাম। প্রথম অবস্থায় বেতন কম ছিল, পরে ধীরে ধীরে বেতন বাড়ছে। যে কাজ করতাম এটা খুব কষ্টের। আগে থেকে যে অভিজ্ঞতা আছে তা দিয়ে নিজেকে মানিয়ে নিতাম। বিদেশ আসার পাঁচ বছরের মধ্যে নতুন ঘর দিলাম। ছোট বোনটাকে অনেক বড় অনুষ্ঠান করে বিয়ে দিলাম। সংসারের পাশাপাশি দুই ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ এখনো চালাচ্ছি। ছোট ভাইটা বিদেশ আসার জন্য পাগল হয়ে আছে। সে আর পড়ালেখা করবে না। দেশে নাকি পড়ালেখা করে কিছুই করতে পারবে না।’

‘আমার অনেক ধার-দেনা ছিল সেগুলো আস্তে আস্তে পরিশোধ করলাম। এতদিন পর একটু স্বস্তি অনুভব হলো। ঠিক করলাম এবার দেশে যাবো। যদি সুযোগ পাই বিয়েটাও করে আসবো। অনুষ্ঠান না হয় পরে করলাম আর কি। কিন্তু সেই ব্যাপারে বাবা মাকে কিছু জানায়নি। ভাবলাম দেশে যাওয়ার পর বলবো।’

তিনি আরও বলেন, ‘যখনই বাড়িতে জানালাম দেশে যাওয়ার কথা তখনই সবার মুখ কালো হয়ে গেছে। বাবা বললেন তোর ছোট ভাইটারে আগে বিদেশ নিয়ে যা, তারপর তুই দেশে আসিস। চিন্তা করলাম কার জন্য এতকিছু! একটিবার নিজের কথা ভাবি নাই। নিজের ভবিষ্যতের জন্য কিছুই করি নাই। যাদের জন্য করলাম আজ তারাই আমারে দেশে না যাওয়ার জন্য বারণ করে।’

করিম আরও বলছিলেন, ‘টাকার জন্য কুয়েত এসে প্রচুর কষ্ট করেছি। এমন অনেকদিন গেছে দুপুরে শুধু খুবুজ (রুটি) খেয়ে দিন কাটিয়েছি। ভাই-বোনরা যখন যেটা আবদার করছে সেটা পূরণ করেছি। কখনো তাদের অভাববোধ করতে দেইনি। বাবা টাকার কথা বলার আগেই টাকা পাঠায় দিতাম। এরপরেও তাদের চাহিদার শেষ নেই। বাবার কথা শুনে খুব মন খারাপ হয়ে গেছে। এটা শোনার পর চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু আমার এই কান্না তো অনর্থক। কেউ শুনবে না।’

Advertisement

করিম হাওলাদার বলেন, দেশের মানুষ মনে করে প্রবাসীরা টাকার মেশিন। কখনো তার পরিবার খেয়েছে কি না জিজ্ঞেস করবে না। জানতে চায় না প্রবাসে কেমন আছি? শুধু প্রয়োজনের সময় প্রবাসীদের মনে পড়ে। যেখানে নিজের পরিবার তাদের বোঝে না সেখানে অন্য কেউ বুঝবে কি করে? যেই দেশের অর্থনীতি প্রবাসীদের ঘামে সচল সেই দেশও তাদের মূল্যায়ন করতে জানে না। এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে সব জায়গায় হয়রানি আর হয়রানি। প্রবাসীদের বোবাকান্না মোছার আসলেই কেউ নেই।

চলবে...

এমআরএম/এসএনআর/জেআইএম