‘উদহিয়াহ’ বা কোরবানির দিনসমূহে আল্লাহর সান্নিধ্য পাওয়ার আশায় জবাইযোগ্য উট, গরু, ছাগল বা ভেঁড়াকে বলা হয়। কোরবানি জবাই করার উত্তম সময় হল ১০ জিলহজ। কুরবান হলো প্রত্যেক সেই বস্তু, যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন-فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ‘অতএব তুমি নামাজ পড় তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে এবং কোরবানি করো।’ (সুরা কাউসার: আয়াত ২)এ আয়াতে মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নামাজ ও কোরবানি করা নির্দেশ দিয়েছেন। এ দুটি ইবাদতই বড় আনুগত্যের নিদর্শন। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোরআনের এ আদেশ যথাযথভাবে পালন করেছেন। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন বেশি নামাজ প্রতিষ্ঠাকারী ও বেশি কোরবানিদাতা। হাদিসে এসেছে-হজরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, ‘নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দশ বছর মদিনায় অবস্থানকালে কোরবানি করেছেন।’ (মুসনাদ আহমাদ, তিরমিজি)
Advertisement
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দীর্ঘ (ও সুন্দর) দুই শিংবিশিষ্ট সাদা-কালো মিশ্রিত (মেটে বা ছাই) রঙের দু’টি দুম্বা কোরবানি করেছেন।’ (বুখারী, মুসলিম)নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনো বছর কোরবানি ত্যাগ করতেন না। (যাদুল মাআদ ২/৩১৭)
যেমনি নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কর্ম দ্বারা কোরবানি করতে উম্মতকে অনুপ্রাণিত করেছেন, তেমনি তিনি তাঁর বাক্য দ্বারাও উদ্বুদ্ধ ও তাকীদ করেছেন। যেমন তিনি বলেন-‘যে ব্যক্তি (ঈদের) নামাজে আগে জবাই করে সে নিজের জন্য জবাই করে। আর যে নামাজের পরে জবাই করে তার কোরবানি সিদ্ধ হয় এবং সে মুসলমানদের তরিকার অনুসারি হয়।’ (বুখারি ৫২২৬)তিনি আরও বলেন, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কোরবানি করে না, সে যেন অবশ্যই আমাদের ঈদগাহের কাছাকাছি না হয়।’ (মুসনাদ আহমাদ ২/৩২১, ইবনে মাজাহ ২/১০৪৪, মুসতাদরাকে হাকেম ২/৩৮৯)
সকল মুসলিমগণ কোরবানি বিধেয় হওয়ার ব্যাপারে একমত। এ ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু কোরবানি করা ওয়াজিব না সুন্নাত-এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। দুটি মতের পক্ষেই প্রায় সমানভাবে বলিষ্ঠ দলিল রয়েছে। যার কোনো একটার প্রতি পক্ষপাতিত্ব সহজ নয়। তবে কিছু সংস্কারক ও ইসলামি চিন্তাবিদ ওলামা কোরবানী ওয়াজিব হওয়ার পক্ষ সমর্থন করেন। তাঁদের মধ্যে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি অন্যতম। কিন্তু অধিকাংশ সাহাবি, তাবেঈন এবং ফকিহগণের মতে কোরবানি সুন্নাতে মোয়াক্কাদাহ (তাকীদপ্রাপ্ত সুন্নাত)। অবশ্য মুসলিমের জন্য মধ্যপন্থা এই যে, সামর্থ্য থাকতে কোরবানি ত্যাগ করা উচিত নয়।
Advertisement
অপরের দান বা সহযোগিতা নিয়ে কেউ হজ বা কোরবানি করলে তা পালন হয়ে যাবে এবং দাতা ও কর্তা উভয়েই সওয়াবের অধিকারী হবে। তবে ঋণ করে কোরবানি দেওয়া জরুরি নয়। যেমন- সামর্থ্যবান কোনো অসিয়তকারীর বা মুআক্কেলের কোরবানি জবাই করলে, তার নিজের তরফ থেকে কোরবানি মাফ হয়ে যাবে না।
সবার উচিত নিজের ও পরিবার-পরিজনের তরফ থেকে কোরবানি করা। যাতে আল্লাহর আদেশ পালনে এবং নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুকরণে কোরবানি করে বিরাট সওয়াবের অধিকারী হওয়া যায়।
সাদকায় কোরবানি আদায় হয় নাহজ না করে তার খরচ সদকা করলে হজের ফরজ আদায় হয় না, তেমনি কোরবানি না করে তার মূল্য সদকা করলেও নির্ধারিত সুন্নত/সুন্নতে মোয়াক্কাদাহ/ওয়াজিব আদায় হয় না। যেহেতু কোরবানির পশু জবাই হলো আল্লাহর তাযিম সম্বলিত একটি ইবাদত এবং তাঁর দ্বীনের এক নিদর্শন ও প্রতীক। আর মূল্য সদকাহ করলে তা বাতিল হয়ে যায়।
পক্ষান্তরে কোরবানি করা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ এবং সমগ্র মুসলিম জাতির এক আমল। আর কোথাও কথিত নেই যে, তাঁদের কেউ কোরবানির পরিবর্তে তার মূল্য সদকাহ করেছেন। আবার যদি তা উত্তম হতো তাহলে তাঁরা নিশ্চয় তার ব্যতিক্রম করতেন না। (ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ ২৬/৩০৪)
Advertisement
আল্লাহ ইবনুল কাইয়্যেম রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘জবাই তার সবস্থানে কোরবানির মূল্য সাদকা করা অপেক্ষা উত্তম। যদিও সে মূল্য কোরবানির চেয়ে পরিমাণে অধিক হয়। যেহেতু কোরবানি নামাজের সঙ্গে যুক্ত ইবাদত তাই এখানে আল্লাহর জন্য পশু জবাই প্রকৃত উদ্দেশ্য। যেমন- আল্লাহ তাআলা বলেন-فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ‘অতএব তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামাজ পড় এবং কোরবানি করো।’ (সুরা কাউসার: আয়াত ২)
আল্লাহ তাআলা অন্য আয়াতে ঘোষণা করেন-قُلْ إِنَّ صَلاَتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ للهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ‘(হে রাসুল! আপনি) বলুন, অবশ্যই আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মৃত্যু বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যই।’ (সুরা আনআম: আয়াত ১৬২)
কোরবানি যথাসময়ে জীবিত ব্যক্তির তরফ থেকেই প্রার্থনীয়। অবশ্য সে ইচ্ছা করলে তার সওয়াবে জীবিত অথবা মৃত আত্মীয়-স্বজনকেও শরিক করতে পারে। যেহেতু নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবিদের নিজেদের এবং পরিবার-পরিজনদের তরফ থেকে কোরবানি করতেন।
একটি কোরবানিতে একাধিক মৃতব্যক্তিকে সওয়াবে শরিক করাও বৈধ। যদি তাদের মধ্যে কারও উপর কোরবানি ওয়াজিব (নজর) না থাকে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের তরফ থেকে, পরিবার-পরিজনের তরফ থেকে এবং সেই উম্মতের তরফ থেকে কোরবানি করেছেন; যারা আল্লাহর জন্য তাওহিদের সাক্ষ্য দিয়েছে এবং তাঁর জন্য রিসালাত বা প্রচারের সাক্ষ্য দিয়েছে। (মুসনাদ আহমাদ ৬/৩৯১-৩৯২, বায়হাকি ৯/২৬৮)
মনে রাখতে হবেএকটি কোরবানিকে নিজের তরফ থেকে না দিয়ে কেবল মৃতের জন্য নির্দিষ্ট করা ঠিক নয় এবং এতে আল্লাহ তাআলার দেওয়া সীমাহীন করুণা থেকে বঞ্চিত হওয়াও উচিত নয়। বরং করণীয় এই যে, নিজের নামের সাথে জীবিত-মৃত অন্যান্য আত্মীয়-পরিজনকে কোরবানির নিয়তে শামিল করা। যেমন আল্লাহর নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোরবানি জবাই করার সময় বলেছেন-‘হে আল্লাহ! এ (কোরবানি) মুহাম্মদের তরফ থেকে এবং মুহাম্মদের বংশধরের তরফ থেকে।’সুতরাং তিনি নিজের নাম প্রথমে নিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে বংশধরদেরকেও তার সওয়াবে শরিক করেছেন।
মৃতব্যক্তির কোরবানিপক্ষান্তরে মৃতব্যক্তি যদি তার এক তৃতীয়াংশ সম্পদ থেকে কাউকে কোরবানি করতে অসিয়ত করে যায়, অথবা কিছু (সম্পদ) ওয়াকফ করে তার অর্জিত অর্থ থেকে কোরবানির অসিয়ত করে যায়; তবে অসিয়তকারীর জন্য তা কার্যকর করা ওয়াজিব। কোরবানি না করে ঐ অর্থ সদকাহ খাতে ব্যয় করা বৈধ নয়। কারণ, তা সুন্নাহর পরিপন্থী এবং অসিয়তের রূপান্তর। এমনকি যদি কোরবানির জন্য অসিয়তকৃত অর্থ সংকুলান না হয়, তাহলে দুই অথবা ততোধিক বছরের অর্থ একত্রিত করে কোরবানি দিতে হবে। অবশ্য যাদের কাছে অসিয়ত করে যাওয়া হয় তারা তাদের নিজের তরফ থেকে বাকি অর্থ পূরণ করে কোরবানি করলে তা সর্বোত্তম। মোটকথা যাকে অসিয়ত করা হয়, তার উচিত, সূক্ষ্ণভাবে অসিয়ত কার্যকর করা এবং যাতে মৃত অসিয়তকারীর উপকার ও লাভ হয় তারই যথার্থ প্রয়াস করা।
উল্লেখ্য, মুসাফির হলেও তার জন্য কোরবানি করা বিধেয়। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিনায় থাকাকালে নিজ স্ত্রীগণের তরফ থেকে গরু কোরবানি করেছেন। (বুখারি ২৯৪, ৫৫৪৮, মুসলিম ১৯৭৫, বায়হাকি ৯/২৯৫)আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ফজিলতপূর্ণ ইবাদত কোরবানি যথাযথভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এমএস