গাজীপুর সিটি নির্বাচনে শাসক দল নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা খান হারলেন এক ৭০ বছরের অরাজনীতিক নারীর কাছে, এক মায়ের কাছে। নির্বাচনে জিতেছেন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন। ভোটের ব্যবধান ১৬ হাজার হলেও একে শোচনীয় পরাজয়ই বলতে হচ্ছে। এতে আবার অনেকে গণতন্ত্রের পরাজয় দেখছেন, কারণ গণতন্ত্র নাকি এমন করে যাকে তাকে নির্বাচিত করে দেয়। তাই তাদের ভাষায় আজমতের অবমাননা গণতন্ত্রেরই অবমাননা।
Advertisement
অনেকে আজমতের মনোনয়ন ও তার নেতৃত্বের সমালোচনা করছেন, কেউ কেউ বলছেন আওয়ামী লীগের ভেতরকার দ্বন্দ্বই এমনটি করেছে। এমন সব প্রশ্ন ব্যথিত করবে ঠিকই। নেতৃত্বের সংজ্ঞা কী, গণতন্ত্রে প্রতিনিধিত্ব বলিতে কী বোঝায়, তা নিয়ে তাত্ত্বিক বিতর্কের সূত্রপাতও হয়েছে ফেসবুকে, টকশোতে। কিন্তু সত্য কঠিন।
ভুল মানুষ করেনি। এটাই নির্বাচনী গণতন্ত্রের মৌলিক চেহারা। ভুল করেছেন আজমত। শাসক দলের প্রতীক পেয়েই তিনি ভেবেছেন সব পেয়েছেন, কারণ দল তাঁকে মনোনয়ন দিয়ে সম্মানিত করেছে। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে ভোট জিনিসটি পুরস্কার নয়। ভোট দিলে কী পাব, সে বিচার করে নাগরিকরা ভোট দেয় না। যদি প্রশ্ন করা হয়, কী দেওয়ার অঙ্গীকার করে আজমত ভোট লড়েছেন?
তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট ছিল এবং তিনি মূলত সদ্য বিদায়ী মেয়র, জনগণের রায় পাওয়া জায়েদা খাতুনের ছেলের গীবত গেয়েছেন শুধু। কোনো নির্দিষ্ট কর্মসূচি তাঁর ছিল না। নিজের সিনিয়রিটি, জাতীয় স্তরে পরিচিতি, এ সবের উপর নির্ভর করেই তিনি তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। প্রমাণিত হয়েছে, বাস্তবে গাজীপুরে তাঁর কোনো প্রভাব নেই।
Advertisement
জনমত সংগঠন, জন-আন্দোলন কর্মসূচি রূপায়ণের মতোই, সরকারি ও বেসরকারি নানা পক্ষের উপর প্রভাব খাটাবার সামর্থ্য নেতা ও তাঁর দলের গ্রহণযোগ্যতা নির্ণয় করে। আজমত সেই নেতা নন। জায়েদা খাতুন প্রার্থী ছিলেন ঠিকই যেহেতু জাহাঙ্গীরের মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছিল। একটি বহুধাবিভক্ত দলীয় পরিসরে নির্বাচন নামক যুদ্ধটি কীভাবে লড়তে হয়, তা যে উত্তম রুপে শিখেছেন জাহাঙ্গীর সেটা আবার বোঝা গেল। গত নির্বাচনেই যেখানে জাহাঙ্গীর ছিলেন দলীয় বিজয়ী প্রার্থী এবার তাঁর অনেক সমালোচনা। কিন্তু এবার চরম বৈরি পরিস্থিতিতেও তিনি বুঝিয়ে দিলেন তাঁর সাফল্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।
প্রশ্ন হলো গাজীপুর নির্ববচন কী নূতন দিশা? এটা তখনই বলা যাবে যখন সরকারি দল আপন পরাজয় শিরোধার্য না করবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, বর্তমান সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব, তা গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। তিনি এও বলেছেন, গাজীপুর সিটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জিতলে মানুষ যত না খুশি হতো, তার চেয়ে বেশি খুশি হয়েছে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ায়। কিন্তু খোদ আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে বলা হচ্ছে যে, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তার দায় আছে এই পরাজয়ে, কারণ দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা এখন প্রকাশিত। এগুলো সবই প্রতিক্রিয়া। এই পরাজয়ের পেছনে কোন্দল, ভুল প্রার্থী নির্বাচন এসব আজগুবি অজুহাত দেখিয়ে আওয়ামী লীগের কোনো লাভ নেই। এই পরাজয়কে গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করে সেখান থেকে শিক্ষা না নিলে আওয়ামী লীগকে ভবিষ্যতে আরও বড় মূল্য চুকাতে হবে। সেটা অবশ্য এই দলে চিন্তা করা কতটা হয় সেটা বড় প্রশ্ন।
গত তিন মেয়াদে টানা দলটি ক্ষমতায়। কিন্তু যেকোনো সংবেদনশীল রাজনৈতিক সচেতন মানুষই বলবে যে, এই পুরো সময়টায় দল হিসেবে আওয়ামী লীগ, তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো এবং তাদের নেতারা যতটা ক্ষমতা চর্চা করেছে, ততটা রাজনৈতিক চর্চা করেনি। করেনি বলেই ওরা কেবল দল দেখছে, প্রতীক দেখছে, প্রার্থী দেখছে কিন্তু মানুষ দেখছে না।
দেখেনি বলেই ওরা মানুষের শক্তি দেখেনা। নিজে স্বতন্ত্র দাঁড়ানো এক কথা, কিন্তু ঘর থেকে বৃদ্ধা গৃহিণী মাকে এনে দাঁড় করিয়ে আজমত উল্লা খানের মতো ঝানু নেতা, নৌকার মতো সুপরিচিত মার্কা আর আওয়ামী লীগের মতো শক্তিশালী দলকে গাজীপুরের মতো শক্ত ঘাঁটিতে হারিয়ে দলীয় মূর্খরা এই পরাজয়কে কেবল দেখছে জাহাঙ্গীরের টাকার জোর হিসেবে।
Advertisement
গাজীপুরের নির্বাচনের পুরো ক্রেডিট যদিও জাহাঙ্গীর আলম নিবেন, কিন্তু নৌকার এই পরাজয়টা খুব বড় বিষয়। মানুষ জানে যে জায়েদা খাতুনের কোনো অভিজ্ঞতা নেই, জানে যে সরকারি নেতাকে নির্বাচিত না করলে উন্নয়ন হবে না। তবুও তারা দলে দলে ভোট কেন্দ্রে এসে জায়েদা খাতুনের মতো একজন অনভিজ্ঞ নারীকে বিজয়ী করেছেন।
মানুষ কী পরিমাণ ক্ষুব্ধ, কী পরিমাণ বিরক্ত সরকারি দলের ওপর সেটা কী শাসক দল বুঝবে? বলা হচ্ছে নারী ভোটাররা নৌকায় ভোট দেয়নি, তাহলো তো আরও বড় ভাবনার বিষয়। নারীদের জন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর এত এত কর্ম এবং অবদানের পরও যদি এ কথা শুনতে হয় তাহলে দলের সাংগঠনিক কর্ম ও সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই হয়।
আজমত উল্লা খান অমলিন, স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মানুষ। কিন্তু তিনি কি জনদরদী এবং সংস্কারপ্রিয় মানুষ? সেটা কেউ বলবে না। তাহলে এই রাজনীতিক ভোটারদের মন জয় করবেন কেমন করে? সম্ভবত ভোটার মন জয় করবার মতো প্রার্থী এখন খুব কমই আছে দলে।
সারাদেশে একের পর এক দলের নেতা ও তাদের স্বজনদের ক্ষমতায় দেখতে দেখতে মানুষ আসলে ক্লান্ত। দুর্নীতি, স্বজনপোষণ এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণ – এ কথাগুলো তো মানুষকে বোঝাতে হয় না। দলের ভেতরও মানুষ সেই মানুষকে খোঁজে যার নিজস্ব গোষ্ঠী নেই, পরিবার নেই কায়েমি স্বার্থচক্র নেই।
গাজীপুরের নির্বাচনের প্রাক্কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি এসেছে। সে নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। তার ব্যাখ্যা নানারকম হতে পরে। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, বাংলাদেশের গণতন্ত্র একটি সচল, দুর্নীতিমুক্ত, গতিশীল সরকারের অন্বেষণ করে চলেছে।
স্বজনপোষণ ঠেকাতে এবং দুর্নীতি ঘুচাতে না পারলে আমরা কোথায় যাবে সেটা ভবিষ্যৎই বলবে। কিন্তু গাজীপুর নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করলে এ সত্যই নূতন করে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, গণতন্ত্রের বহু ত্রুটি এবং অপূর্ণতা থাকলেও তার অনুশীলনের মধ্য দিয়েই সাধারণ মানুষ তার কথা বলে বা বলতে পরে। এখানেই গণতান্ত্রিক কাঠামোর প্রকৃত ভরসা। আবার, এখানেই গণতান্ত্রিক শাসকদের গুরুদায়িত্বও।
লেখক: সাংবাদিক।
এইচআর/এমএস