# সরকারি সম্পদ তছরুপে দুদকে অভিযোগ করার নিয়ম থাকলেও ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে করা হয় সিআর মামলা# দুদক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি সম্পদ তছরুপের ঘটনার মামলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে করার সুযোগ নেই
Advertisement
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অংশীদারি প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (এসএওসিএল)। প্রতিষ্ঠানটির কেনা দুটি লিফট চার বছর ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে নগরীর খুলশী থানাধীন নাসিরাবাদের ন্যাশনাল পলিটেকনিক কলেজে। এ ঘটনায় অনেক গড়িমসির পর মামলা হলেও সরকারি এ সম্পদ তছরুপে জড়িতের রক্ষায় চলছে নানান তোড়জোড়।
সরকারি সম্পদ তছরুপের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মামলা হওয়ার নিয়ম থাকলেও করা হয়েছে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সিআর (নালিশী) মামলা। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অডিট অধিদপ্তরের অডিট আপত্তি সূত্রে জানা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন থেকে এসএওসিএল’র ৪১ লাখ ৭২ হাজার ৪শ টাকা মূল্যের লিফটের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট এসএওসিএলের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহেদ করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণ নেয় বিপিসি।
অডিট আপত্তির সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একটি লিফট প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ে স্থাপন করা হয়। অন্য দুটি লিফটের বিষয়ে জানতে বন্দর থেকে খালাসকারী সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান ‘হট-লাইন কার্গো ইন্টারন্যাশনাল’ ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশি এজেন্ট ও-২ এলিভেটরস কো. লিমিটেডকে ২০২১ সালের ৮ জুন চিঠি দেয় এসএওসিএল। হটলাইন কার্গো ইন্টারন্যাশনাল এসএওসিএলের চিঠির কোনো উত্তর দেয়নি। তবে চিঠির জবাব দেয় ‘ও-২ এলিভেটরস কো. লিমিটেড’। খুলশী থানাধীন নাসিরাবাদ এয়াকুব ফিউচার পার্কের ২ নম্বর গেটের ন্যাশনাল পলিটেকনিক কলেজে লিফট দুটি স্থাপন করা হয়েছে বলে প্রতিষ্ঠানটি থেকে জানানো হয়।
Advertisement
আরও পড়ুন>> এসএওসিএল: সরকারি টাকায় কেনা লিফট ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানে!
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৬৩০ কেজি ভারবহন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ও এক হাজার কেজি ভারবহন ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি লিফট আমদানির জন্য ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর যমুনা ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখায় ঋণপত্র (নম্বর-৩০৩৮১৮০১০৩০৭) খোলে এসএওসিএল। এর মধ্যে এক হাজার কেজির দুটি লিফট স্থাপন করা হয়েছে নগরীর খুলশী থানাধীন নাসিরাবাদ এয়াকুব ফিউচার পার্কের দুই নম্বর গেটের ন্যাশনাল পলিটেকনিক কলেজে। লিফট দুটির এলসি মূল্য ৩৩ হাজার ৪০০ মার্কিন ডলার। ওই সময় প্রতি ডলার ৮৩ টাকা ৯৫ পয়সা হিসেবে লিফট দুটির মূল্য ২৮ লাখ টাকার কিছু বেশি, যা লোপাট হয়েছে বলে মত অডিটরদের।
মূলত এসএওসিএলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মো. শাহেদ মারা যাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয় বিপিসি। এরপর বেরিয়ে আসতে থাকে ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এসএওসিএলে ঘটে যাওয়া নানান অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র। ন্যাশনাল পলিটেকনিক কলেজের মালিক ও অধ্যক্ষ ছিলেন প্রয়াত মহাব্যবস্থাপক শাহেদের বাবা ইঞ্জিনিয়ার বাকী। ন্যাশনাল পলিটেকনিক কলেজটি পশ্চিম খুলশী থাকলেও ২০১৭ সালে নিজেদের মালিকাধীন ৯ তলা ভবনে চলে আসে। ওই নতুন ভবনেই লাগানো হয় লিফট দুটি। পরে শাহেদ মারা যাওয়ার ১৫ দিনের মাথায় তার বাবাও মারা যান। এরপর প্রতিষ্ঠানের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান হন শাহেদের আরেক ভাই ইঞ্জিনিয়ার এবিএম আবদুল ওয়াহেদ। তিনি ন্যাশনাল পলিটেকনিক কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বও নেন।
এদিকে নিজেদের টাকায় কেনা লিফট দুটির বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এসএওসিএল পর্ষদ। এ ঘটনায় ২০২১ সালের ৪ নভেম্বর এসএওসিএলের ৪১২তম পর্ষদ সভায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ও দেওয়ানি উভয় আদালতে মামলার সিদ্ধান্ত হয়। এ নিয়ে ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর এসএওসিএলের আইন উপদেষ্টা মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিনকে মামলার সিদ্ধান্ত জানিয়ে চিঠি দেন বিপিসি ও এসএওসিএলের তৎকালীন ডিজিএম মুহাম্মদ মোরশেদ হোসাইন আজাদ।
Advertisement
ওই চিঠিতে উল্লেখ করা পর্ষদ সভার সিদ্ধান্তের মধ্যে (১১.২ এর খ) বলা হয়- ‘দুটি লিফটের অর্থ বাবদ ২৮ লাখ ৫৫ হাজার ৭শ টাকা আদায়ের লক্ষ্যে ন্যাশনাল পলিটেকনিক চট্টগ্রামের বিরুদ্ধে একটি রেগুলার মামলা স্থানীয় থানায় দায়ের এবং অন্য মামলাটি পাবলিক ডিমান্ড রিকভারি অ্যাক্ট ১৯১৩ এর আওতায় জেলা প্রশাসক চট্টগ্রামের অনুকূলে দায়ের করার প্রস্তাব পর্ষদ অনুমোদিত হলো।’
ওই সিদ্ধান্তের পরেও নানান টালবাহানায় মামলা করতে বিরত থাকেন আইন উপদেষ্টা মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন। প্রায় দেড় বছর পর গত ৩০ এপ্রিল চট্টগ্রাম চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করেন। মামলায় বাদী হন এসএওসিএলের জুনিয়র অফিসার (প্রশাসন ও নিরাপত্ত) বিজয় চন্দ্র রায়। মামলায় প্রয়াত মহাব্যবস্থাপক মো. শাহেদের বড় ভাই ন্যাশনাল পলিটেকনিক কলেজের পরিচালক ইঞ্জিনিয়র এ বি এম আবদুল ওয়াহেদ ও লিফট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও২ এলিভেটরস কো. লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেকটর মো. সাইমুদ্দিনকে আসামি করা। কোনো অজ্ঞাত আসামি নেই। মামলার অভিযোগে দণ্ডবিধির ৪০৬, ৪২০, ৪৬৭, ৪৬৮ এবং ১০৯ ধারায় অভিযোগ করা হলেও বিচারক ৪৬৭ এবং ৪৬৮ ধারা বাদ দিয়ে মামলাটি আমলে নিয়ে শিল্প পুলিশকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার আদেশ দেন।
মামলায় দুজনকে আসামি করা হলেও লিফট আমদানিতে ঋণপত্র খোলা, বন্দর থেকে খালাস, বিল পরিশোধে যারা জড়িত তাদের কাউকেই ঘটনার সহযোগী হিসেবে মামলায় আসামি করা হয়নি। লিফট খালাসের বিষয়ে সামগ্রিক বিলও পরিশোধ করা হয় এসএওসিএল থেকে। তাদেরও মামলায় আসামি করা হয়নি। এসএওসিএলের প্রকৌশল ডিপার্টমেন্ট প্রধান উপ-ব্যবস্থাপক (প্রকৌশল ও পরিচালন) মো. মোকাররম হোসেনকে মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে।
মামলাটির তদন্তের বিষয়ে শিল্প পুলিশ চট্টগ্রামের পরিদর্শক মো. শামসুদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, আমরা আদালতের নির্দেশে মামলাটি তদন্ত করছি। তবে দুদক সংশ্লিষ্টরা আইনবিদরা বলছেন, সরকারি সম্পদ তছরুপের বিষয়ে দুদক আইনে পৃথক নির্দেশনা রয়েছে।
বিষয়টিতে মতামত চাইলে চট্টগ্রাম আদালতে দুদকের পিপি অ্যাডভোকেট ছানোয়ার আহমেদ লাভলু জাগো নিউজকে বলেন, এসএওসিএল রাষ্ট্রীয় অংশীদারি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের কেনা লিফট দুটি সরকারি সম্পত্তি। সরকারি সম্পদ আত্মসাতের মামলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দাখিলের সুযোগ নেই। এ ধরনের ঘটনায় দুদকে অভিযোগ করতে হয়। দুদক অভিযোগ অনুসন্ধান করে সত্যতা পেলে কমিশনের অনুমোদন নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারাই দুদকে এফআইআর করেন। মামলার বিচারিক ক্ষমতা রয়েছে জজ আদালতের।’
এসএওসিএলের পক্ষ থেকে অভিযোগ দেওয়া না হলেও গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে দুটি লিফট বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে স্থাপনের অভিযোগটি অনুসন্ধান করছে দুদক। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা দুদক প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আহসানুল হক পলাশ জাগো নিউজকে বলেন, এসএওসিএলের লিফট বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সংযোজনের অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। বিষয়টি আমরা কমিশনকে জানিয়েছি। শিগগির আমরা অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দেবো।
এদিকে মামলা পরবর্তীসময়ে আসামিদের সঙ্গে সমঝোতার তোড়জোড় শুরু করেছেন সংশ্লিষ্টরা। বিষয়টি জানতে চাইলে এসএওসিএলের আইন উপদেষ্টা মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘লিফট দুটি ন্যাশনাল পলিটেকনিক কলেজে স্থাপনের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর এসএওসিএলের পক্ষ থেকে ন্যাশনাল পলিটেকনিক কলেজ কর্তৃপক্ষকে লিফট দুটির টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু তারা টাকা ফেরতের জন্য রাজি হননি। তাই আমরা টাকা উদ্ধারের জন্য মামলা করেছি। এসএওসিএল বোর্ডও টাকা উদ্ধারের বিষয়ে আগ্রহী। তাই বোর্ডের নির্দেশনা অনুসারে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সিআর মামলা করা হয়েছে।’
সরকারি সম্পদ তছরুপের অভিযোগ দুদকে বা থানায় না দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সবকিছুই বোর্ডের নির্দেশনা অনুসারে হয়েছে।’ আসামিদের সঙ্গে সমঝোতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মামলার পর টাকা ফেরত দিয়ে সমস্যাটি সমাধানের জন্য আসামিপক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। সিআর মামলা বা নালিশী মামলা সব সময় সমঝোতাযোগ্য।’
এ বিষয়ে এসএওসিএলের মহাব্যবস্থাপকের দায়িত্বে থাকা বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) মণিলাল দাশ জাগো নিউজকে বলেন, এসএওসিএলের টাকায় লিফটগুলো কেনা হয়েছিল। যেহেতু লিফট দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে লাগানো হয়েছে, তাই মামলা হয়েছে। এখন তারা টাকা ফেরত দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এগুলো সরকারি টাকা, আদায় হলেই হলো।
লিফট দুটির টাকা গ্রহণে আসামিদের সঙ্গে সমঝোতার জন্য এসএওসিএলের অডিট বিভাগের এক কর্মকর্তাকে মৌখিক দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ওই কর্মকর্তা মৌখিক নির্দেশে সমঝোতার অর্থ নিতে রাজি হননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসএওসিএলের আরেক কর্মকর্তা বলেন, মামলাটি যেহেতু দুদক অনুসন্ধান করছে এবং আদালতে মামলা চলছে, সেহেতু বিষয়টি সমঝোতায় আগ্রহী হচ্ছেন না দায়িত্ব দেওয়া ওই কর্মকর্তা।
এমডিআইএইচ/এএসএ/এমএস