দেশজুড়ে

সর্বস্ব হারিয়েও আশ্বাসে কাটছে দিন

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়ার সীমান্তে পাহাড় থেকে খাবারের সন্ধানে নেমে আসা বন্যহাতির সঙ্গে চলছে মানুষের দ্বন্দ্ব। মাসের ব্যবধানে ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে, হাতির পাল নষ্ট করেছে কয়েক হেক্টর জমির ধান, ভাঙচুর করেছে অন্তত ৫০টি ঘর। প্রাণে বাঁচতে গরু-ছাগল নিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন অনেকে।

Advertisement

এদিকে, নিয়ম রয়েছে বন্য হাতির আক্রমণে ক্ষয়ক্ষতি যা হবে তার ক্ষতিপূরণ বনবিভাগ থেকে দেওয়ার। এজন্য করতে হবে আবেদন। কিন্তু আবেদন করেও গত দুই বছর কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি বলে দাবি ভোক্তভোগীদের। ফলে আশ্বাসে দিন কাটছে হাতির আক্রমণে ছেলে হারানো মা আর বাবা হারানো সন্তানের।

জানা গেছে, গত ২২ এপ্রিল ফসল রক্ষা করতে গিয়ে হাতির আক্রমণে মারা যান হালুয়াঘাট উপজেলার গাজীর ভিটা ইউনিয়নের কাটাবাড়ি গ্রামের মৃত ফজর আলীর ছেলে ফরজুল (৩৩)। এরপর ২ মে ফসল রক্ষা করতে গিয়ে হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা যান একই ইউনিয়নের কান্দাপাড়া গ্রামের মৃত তমিজ উদ্দিনের ছেলে পল্লী চিকিৎসক ইদ্রিস আলী (৫০)। এছাড়া জেলার ধোবাউড়া উপজেলার দক্ষিণ মাইজপাড়া ইউনিয়নের রাণীপুর গ্রামে হাতির আক্রমণে মারা যায় সুমন আহমেদ (১৫) নামের এক কিশোর। সে ওই এলাকার আব্দুল মোমেনের ছেলে।

কাটাবাড়ি গ্রামে গিয়ে কথা হয় নিহত ফরজুল হকের স্ত্রী রুমা আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার এক ছেলে ও মেয়ে। ঈদের দিন বিকেলে হাতির দল এসে আমার ও অন্যান্য কৃষকের ধান নষ্ট করছিল। ফসল রক্ষায় সবাই একসঙ্গে হাতি তাড়াতে যায়। একপর্যায়ে ফরজুল হাতির খুব কাছাকাছি চলে যায়। পরে উল্টো হাতির দল তাকে তাড়া করে। সে ফিরে আসতে না পেরে হাতির দলের মাঝখানে পড়ে যায়। এসময় হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে তার মৃত্যু হয়।

Advertisement

রুমা আক্তার বলেন, সংসারে তিনিই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। তার মৃত্যুর পর দুই সন্তান নিয়ে খুব বিপাকে আছি। কিভাবে সংসার চালাবো বুঝতে পারছি না। সে মারা যাওয়ার পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ১৫ হাজার টাকা দিয়েছেন এবং ক্ষতিপূরণ হিসেবে আরও তিন লাখ টাকা দেবেন বলেছিলেন। সেজন্য ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট ও আবেদন করতে বলেছিলেন। সেটাও করেছি, কিন্তু এখনো কোনো সাড়া মেলেনি। এখন আর কেউ খোঁজ নেয় না।

কথা হয় একই এলাকার কৃষক জয়নাল মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, গত দুই বছর হাতি আমাদের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। ঘরবাড়ি ভেঙেছে, ফসলেরও অনেক ক্ষতি করেছে। দুই বছর যাবত শুনে আসছি, আমরা ক্ষতিপূরণ পাবো। কিন্তু কিছুই পাইনি, আশ্বাসেই দিন কাটছে।

একই ইউনিয়নের কান্দাপাড়া গ্রামে হাতির পদতলে পিষ্ট হয়ে মারা গেছেন মৃত তমিজ উদ্দিনের ছেলে পল্লী চিকিৎসক ইদ্রিস আলী। তিনি পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ের জনক। তিনিও নিজের ফসল রক্ষায় অন্য কৃষকদের সঙ্গে হাতি তাড়াতে গিয়ে পদতলে পিষ্ট হয়ে মারা যান।

হাতির আক্রমণে নিহত ইদ্রিস আলীর ছেলে মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, বাবা মারা যাওয়ার পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসে ১০ হাজার টাকা দিয়ে গেছেন। এছাড়া স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা খোঁজ নিয়ে ১০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। এরপর আর কেউ কোনো খোঁজ নেয়নি।

Advertisement

তিনি আরও বলেন, বনবিভাগের লোকজন বলেছিলেন ক্ষতিপূরণ হিসেবে তিন লাখ টাকা দেবেন। সেই অনুযায়ী আবেদন করেছি, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া মেলেনি।

মৃত তমিজ উদ্দিনের মেয়ে উম্মে কুলসুম বলেন, প্রতিদিন হাতি দল বেঁধে এসে ফসল, ঘরবাড়ির ক্ষতি করে, মানুষও মেরে ফেলছে। চরম আতঙ্কে দিন কাটে। হাতি যেন না আসতে না পারে, সরকার তার ব্যবস্থাও করছে না। আবার হাতিকে মারাও যাবে না, মারলে ১০ লাখ টাকা জরিমানা, মামলাও হবে। আমার বাবাকে হাতি মেরে ফেলছে, আমার বাবা কি আর ফিরে আসবে? বাবা মারা যাওয়ায় সংসারে অভাব অনটন নেমে এসেছে। আমাদের দাবি সরকার যেন আমার ভাইকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়।

একই ইউনিয়নের লামছাপাড়া গ্রামের বাহেন্দ্র চিরান বলেন, এবছর হাতির আক্রমণ শুরুর পর থেকে রাতে বাড়িঘর ছেড়ে অন্য জায়গায় বসবাস করি। এবছর আমার ঘরে রাখা ১০ মণ চাল, ৫০ শতাংশ জমির ধান, গ্রামের কয়েকটা টিউবওয়েল নষ্ট করেছে। হাতির দল পাশের গ্রামেও অনেক ঘরবাড়ি ভেঙেছে। আর ফসল কত নষ্ট করেছে তারতো হিসাবই নেই। গত দুই বছর যাবত হাতি এভাবে ক্ষতি করছে, এরপরও সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। শুনে আসছি ক্ষতিপূরণ পাবো। কিন্তু দুই বছরে কোনো ক্ষতিপূরণ পাইনি।

বনবিভাগ সূত্র জানায়, ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে ময়মনসিংহ বিভাগের চার জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় হাতির আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে ৩৫ জন। দুই হাজারের অধিক হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। বসতবাড়িসহ অন্যান্য ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে আরও দুই হাজার। এসবের বিপরীতে সরকার ৯ বছরে প্রায় ৬৯ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে।

চার জেলায় ১৬০ কিলোমিটারের মতো সীমান্ত রয়েছে। এসব সীমান্তের করিডর দিয়ে ভারতের মেঘালয় থেকে শতাধিক বন্য হাতি বাংলাদেশে প্রবেশ করে। হাতির প্রবেশ বন্ধে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে শেরপুরের ঝিনাইগাতী সীমান্তে ১৩ কিলোমিটার সৌরবিদ্যুতের ফাঁদ নির্মাণ করা হয়েছিল। সেখানে আরও আট কিলোমিটার সৌরবিদ্যুতের ফাঁদ নির্মাণের কাজ চলমান। গোপালপুরে দুই কিলোমিটার সৌরবিদ্যুতের ফাঁদ নির্মাণ করা হয়েছে। আরও ২৫ কিলোমিটার সৌরবিদ্যুতের ফাঁদ নির্মাণের পাশাপাশি সীমান্তে কাঁটাযুক্ত গাছ লাগানোর প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

গাজীরভিটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মান্নান বলেন, গত কয়েক দিনে ইউনিয়নে হাতির আক্রমণে দু’জন মারা গেছে। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আমরা চাই সরকার যেন দ্রুত সীমান্ত এলাকায় ফাঁদ বসিয়ে মানুষের জানমালের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে।

হালুয়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদ হাসান বলেন, সীমান্ত এলাকায় হাতির আক্রমণে ক্ষতিপূরণ বা অন্য যেকোনো বিষয় বনবিভাগ দেখাশোনা করে। আমরা শুধু আবেদন নিয়ে বনবিভাগের কাছে পাঠিয়ে দিই।

ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আ ন ম আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, হাতির আক্রমণে ক্ষয়ক্ষতির ৪০০ আবেদন পেয়েছি। সবগুলোই পাঠানো হয়েছে। এই অর্থবছরে ৩০ থেকে ৩৫টি আবেদনের ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়া যেতে পারে। এছাড়া সম্প্রতি যারা হাতির আক্রমণে মারা গেছেন তাদের ক্ষতিপূরণের টাকা জুলাইয়ে আসতে পারে। প্রতিদিন চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছি, যাতে ক্ষতিপূরণের টাকা দ্রুত আসে।

এফএ/এএইচ/এমএস