মতামত

দারিদ্র্যসূচক কমেছে ভিখারি কমেনি

সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিসিএস) এক জরিপ রিপোর্টে বলা হয়েছে দেশে দারিদ্র্য কমেছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, দেশের সার্বিক উন্নয়নসূচকের অনেকটা অগ্রগতি লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

Advertisement

গত ১৭ এপ্রিল ২০২৩ বিবিএস-এর বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্টাটিস্টিকস-২০২১ এর ফল প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছয়মাস কমেছে। পুরুষের গড় আয়ু ৭০.৬ এবং নারীর গড় আয়ু ৭৪.৪ বছর। এই প্রথম বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু কমলো।

আরেক সংবাদে বলা হয়েছে, সরকারি চাকরি করেন মিরপুরের এমন একজন বাসিন্দা জীবনে প্রথমবার মেট্রোরেলে উঠে ‘উন্নয়ন অনুভব করা যাচ্ছে’ বলে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। বিষয়গুলো বিভিন্ন সংবাদে জেনে খুব খুশি লাগে। কিন্তু একই টিভিতে আরেক সংবাদে যখন একজন ভিখারি আক্ষেপ করেন যে আগে রেলস্টেশনে ভিক্ষা করতাম, ট্রেনে চড়ে হাত পাতলেই ভিক্ষা পেতাম এখন সেই উপায় নেই। আগে ইন্টারসিটি ট্রেনে চড়ে ঈদের সময় ভিক্ষা করতে করতে বাড়ি চলে যেতাম। এখন সে উপায় নেই। লোকাল ট্রেনে এত মানুষ যে ভেতরে ঢোকা যায় না। কোনোরকমে উঠতে পারলে ভিক্ষার জন্য এদিক সেদিক নড়াচড়া করার উপায় নেই। আগের মতো আমার আয়-রোজগার নাই। বাসা-বাড়িতে ভিক্ষার জন্য গেলে ভেতরে ঢোকার উপায় নাই। দারোয়ান তাড়িয়ে দেয় অথবা তালাচাবি দেখে ফিরে আসতে হয়। দোকানে ভিক্ষার জন্য হাত পাতলে একটা খুচরা পয়সা দেয়। সারাদিন যা পাই তা দিয়ে জীবন চালানো দায়।

আধুনিক যুগে যাদের স্থায়ী আয় আছে, সঞ্চয় আছে এবং ব্যাংক ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা আছে তারা বেশি বেশি উঁচু বাড়ি বানাচ্ছেন বা কিনছেন। সেগুলো ভাড়া দিচ্ছেন নতুবা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করছেন। তাপর সেগুলোতে নিরাপত্তার জন্য সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ দিয়ে তাদের হাতে একবোঝা চাবিসহ নতুন মডেলের তালা কিনে দিয়ে স্বস্তি খুঁজে পাচ্ছেন। সুসজ্জিত গেট, ডিজিটাল তালাচাবি, সিসি ক্যামেরা, কুকুর, দারোয়ান ইত্যাদি মিলে ভিখারি তাড়ানোর মহোৎসব গড়ে উঠেছে বহুতল ভবনের শহুরে মানুষদের জীবনে। এটাই এখন বিত্তশালীদের বৈভব পাহারা দেওয়া সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ।

Advertisement

অর্থাৎ, যাদের স্থায়ী আয় করার যোগ্যতা আছে তাদের কাছে উন্নয়ন অনুভবটা সুখকর। কিন্তু যারা ভাসমান, ভিখারি, বেকার অথবা উচ্চশিক্ষিত হয়েও বহু বছর ধরে একটি চাকরির জন্য পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাদের প্রকৃত অবস্থা নিয়ে কোনো ভাবনার অবকাশ নেই তাদের মধ্যে। অথচ এরা ধনাঢ্য পরিবার যাদের ৯৯ শতাংশ মুসলমান। যারা এতসব নিরাপত্তার আয়োজন সম্পন্ন করে আকাশচুম্বি অট্টালিকা, বাগানবাড়ি, সুইমিংপুল, হাল-ফ্যশনের বিলাসবহুল গাড়ি, দেশে বিদেশে বিপুল অঙ্কের অর্থ লগ্নি ও সঞ্চয় নিয়ে কালাতিপাত করেছেন তারা ঈমানদার দাবি করেন। তাদের অনেকে নিয়মিত নামাজ আদায় করেন রোজা রাখেন, আরও নানা ইবাদত করেন। কিন্তু মিসকিনকে দান-খয়রাত ও সঠিকভাবে সরকারি কর প্রদানের বেলায় দারুণ কিপ্টেমি করতে দ্বিধা করেন না। অথচ তারা ‘সাচ্চা মুসলিম’ অভিধায় নিজেকে শুনতে বেশ ভালোবাসেন।

এসব বিত্তশালীর সীমাহীন আয় ও পথে ঘুর বেড়ানো ভিখারির আয় সম্মিলন করে গড় করে গোটা দেশের মাথাপিছু আয় নির্ধারণ করা হয়। তাই অর্থনীতিবিদরা অনেকেই কোন অসম আয়ের দেশের দেশের জনগণের মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধিকে শুভঙ্করের ফাঁকি ও এক ধরনের প্রতারণা বলে মনে করেন।

তাই এসব দেশের দামী মার্কেটের কেনাকাটা বা অভিজাত রেস্টুরেন্টের আলো-আঁধারিতে বসে বঙ্গবাজরের টিনশেডের সামান্য জায়গায় হাজার হাজার ঘুপচি দোকানঘর পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়ার পর প্রকৃত দোকানদারদের সংখ্যার তালিকা ও দাবির সঙ্গে হিসেব মেলাতে হিমশিম খেতে হয়। কারণ, দরিদ্র, অতিদরিদ্র, হকার, টোকাই, দিনমজুর, উন্মাদ, ভাসমান পতিতা, পথশিশু, ভিখারি ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর সঠিক হিসাবে বড় গড়মিল লক্ষণীয়।

আরেকটি বিশেষ বিষয় হলো মুসলমানদের জন্য জাকাত প্রদানের বাধ্যবাধকতাকে উপেক্ষা করা। অনেক মুসলিম যাকাত প্রদানের বেলায় বেশ উদাসীন। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই ধনীদের সম্পদে দরিদ্রদের অধিকার রয়েছে।’

Advertisement

রাজা রেখে যেমন দেহ-মনকে পবিত্র করা হয়, জাকাত দিয়ে তেমনি সম্পদকে পবিত্র করা হয়। মহাগ্রন্থ পবিত্র আল-কোরআনে বলা হয়েছে- “অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মুমিনগণ, যারা নিজেদের নামাজে বিনয়-নম্র হয়েছে, যারা অনর্থক (অন্যায়) কাজ থেকে বিরত হয়েছে, আর যারা যাকাত দানে সক্রিয় হয়েছে”(সুরা মুমিনুন, ১-৪)। অন্যত্র বলা হয়েছে- “ আর যারা সোনা ও রূপা জমা করে রাখে এবং সেগুলো আল্লাহর পথে খরচ করে না, তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দিন”(সুরা তওবা ৩৪ আয়াতংশ)।

সুরা আদ্ব দোহায় বলা হয়েছে, ‘ওয়া আম্মাচ্ছায়েলা ফালা তানহার’অর্থ্যাৎ, ‘ভিখারিকে ধমক দিও না।’ (সূরা ৯৩: আয়াত ৯)। সুরা আল হুমাজাহ্-য় বলা হয়েছে- ‘আল্লাজি জামাআমালাওঁ ওয়াদ্দাদাহ্’ দুর্ভাগ্য এমন সেই ব্যক্তিদের জন্য, ‘যারা সম্পদ জমা করে ও বার বার গণনা করে। (সূরা ১০৪: আয়াত ২)।’

অনেকে দোজখের আগুনের লেলিহান শিখা থেকে বাঁচার জন্য পবিত্র রমজানের রোজা রাখে। অথচ, অনেক মুসলমান ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই ঘুস, দুর্নীতি ও সুদের মধ্যে বাঁচতে ভালোবাসে। তাদের দুয়ারে তৃষ্ণার্ত ভূখা-নাঙ্গা ভিখারি বা সাহায্যপ্রার্থী দেখলেই রেগে উঠে, তাড়িয়ে দেয়। অচিরেই লেলিহান শিখাযুক্ত আগুনের করাল গ্রাসের কথা সেসব সম্পদ জমাকারীদের মধ্যে কোন বোধোদয় জাগ্রত করে না।

একদিকে ধর্মীয় দিকে বিরাট ফাঁকি, অন্যদিকে তথ্যবিভ্রাট ও প্রকাশিত তথ্যের পরিসাংখ্যিক ও বৈজ্ঞানিক দুর্বলতা আমাদের দেশের গবেষণার জন্য একটি বড় লুপহোল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিসিএস) জরিপের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সন্তুষ্ট নয় সরকারি-সেরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান। তাদের অভিযোগ চাহিদামতো বিবিএস-এর তথ্য পাওয়া যায় না। তারপরও বিভিন্ন সূত্রে যা পাওয়া যায় সেসব প্রদত্ত তথ্যের উপর অস্তুষ্ট ৫৯ শতাংশ উত্তরদাতা।

পরিকল্পনা উপমন্ত্রী বলেছেন, “তাঁর প্রশ্ন, উত্তরদাতার সংখ্যা নির্বাচন নিয়ে। তিনি বলেন, ভুটানের মতো সাড়ে সাত লাখ জনগোষ্ঠীর দেশে এই ধরনের জরিপে উত্তরদাতার সংখ্যা ৯৬০। বাংলাদেশ সাড়ে ১৭ কোটি জনগোষ্ঠীর দেশ হয়েও উত্তরদাতা নেওয়া হয়েছে মাত্র ৬০৯ জন। এর ব্যাখ্যা আমরা কীভাবে দেব?”

তাঁর এই প্রশ্ন তোলার প্রেক্ষাপটে বিবিএসের মহাপরিচালক মহোদয় বলেন, ‘মাননীয় মন্ত্রী ঠিকই বলেছেন। মূল প্রশ্ন হলো, এই স্যাম্পল সাইজ পুরো জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে কি না। যদি পেশাভিত্তিক সংখ্যা পাওয়া যেত, তাহলে অংশগ্রহণভিত্তিক স্যাম্পল পাওয়া যেত। ভবিষ্যতে এসব ঠিকঠাক করে জরিপ করা হবে। প্রথমবার বলে ভুলত্রুটি রয়ে গেছে।’

বিবিএস-এর জরিপ অনুযায়ী, ‘উত্তরদাতাদের সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্ট জাতীয় আয় শাখার তথ্য-–উপাত্ত নিয়ে। আলোচিত পাঁচটি অসন্তুষ্টির সব কটিতেই অর্ধেক উত্তরদাতা এই শাখার তথ্য–উপাত্তে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। বৈদেশিক বাণিজ্যসংক্রান্ত পরিসংখ্যান তথা তথ্য–উপাত্ত নিয়ে অর্ধেক উত্তরদাতা সন্তুষ্ট নন। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের তথ্য–উপাত্তেও একই অবস্থা।’

অর্থাৎ, বিবিএস-এর এই জরিপের তথ্য নিয়ে গণমানুষের চুলচেরা বিশ্লেষণের পূর্বেই কর্তৃপক্ষ নিজেরাই দোদুল্যমানতা প্রকাশ করেছেন। সমসাময়িক দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হারানো, বেকারত্ম, ভিক্ষারিদের বিপুলসংখ্যায় দ্বারে দ্বারে ঘুরে হাত পাতা ইত্যাদি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যা বলা যায় বাস্তবতা ও বিবিএস প্রকাশিত সেমিনারে কর্তৃপক্ষের জরিপ ফলাফলের তথ্যের মধ্যে অনেক ফাঁরাক।

এছাড়া গবেষণার জন্য যাচিত হলে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত দেওয়া হয় না; তথ্য-উপাত্ত পুরোনো; প্রয়োজনীয় তথ্য থাকে না; আরও তথ্যের প্রয়োজন, তথ্যের উপস্থাপনা ব্যবহারযোগ্য নয় ইত্যাদি নানা অভিযোগ তো আছেই। জনগণ সেটাই দেখেন, যা সংবাদ হয়ে প্রতিদিন তাদের চোখের সামনে ভেসে আসে। তার সাথে দরজার সামনে, রাস্তায়, বাজারে বা বাস্তবে কি পরিমাণ মিল বা অমিল সেটার সাথে জনগণ তুলনা করেন।

অন্যান্য যা কিছু অর্জন থাক না কেন, বাজার দরের ক্রমাগত উল্লম্ফন ও ক্রয়ক্ষমতা হারানোর হতাশা এবং দান, ভিক্ষা, সাহায্য ইত্যাদি প্রাপ্তির আশায় অগণিত দরিদ্র, অসহায় ভিখারির সারিবদ্ধ চলাফেরা, মলিন চেহারার দলবল নিয়ে দরজায় কড়া নাড়া ইত্যাদির মধ্যে বিস্তর শুভঙ্করের ফাঁকি বিদ্যমান। তাই দারিদ্র্যসূচক খাতা-কলমে কমে গেছে কিন্তু বাস্তবতায় কবে কমবে সেটা সেমিনারে আশ্বাস দিতে পারলে হয়তো সেগুলোও আজকের লেখায় ফুটে ওঠানো যেত। কিন্তু সেটা সুদূর পরাহত মনে হচ্ছে।

উন্নয়ন হলে বৈষম্য বাড়ে-এটা ভ্রান্ত ধারণা। কারণ, সুষম উন্নয়ন হলে মানুষে-মানুষে আয় ব্যয়ের বৈষম্য বাড়ে না। সামান্য যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তাতে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষ সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছে। সুতরাং বাস্তবতার নিরীখে বলা যায়, দারিদ্র্যসূচক কমেছে কিন্তু ভিখারি কমেনি বরং বেড়েছে।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। fakrul@ru.ac.bd

এইচআর/ফারুক/এএসএম