দেশজুড়ে

বরিশালের ‘ছিটমহল’ চর জাগুয়া

 

তিন মেয়ের মা রাহিমা বেগম। তিনি বরিশাল নগরীর ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের জাগুয়া এলাকার চর জাগুয়া এলাকার বাসিন্দা। ওয়ার্ডের বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে সব ট্যাক্স-খাজনা নিয়মিত পরিশোধ করেন সিটি করপোরেশনকে। কিন্তু সিটির প্রায় সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত তিনি।

Advertisement

শুধু রাহিমা বেগম নন, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের জাগুয়া এলাকার চর জাগুয়া সড়কের দুপাশে ৪০টির মতো পরিবারের বসবাস। যারা সবাই কাগজে-কলমে বরিশাল নগরীর বাসিন্দা। কিন্তু কার্যত তাদের নগরী থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে সুগন্ধা নদী। এর চারপাশ ঘিরে রয়েছে ঝালকাঠির নলছিটির দপদপিয়া ইউনিয়নের তিমিরকাঠি গ্রাম।

বুধবার (২৪ মে) নগরীর বিচ্ছিন্ন জনপদ চর জাগুয়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায় এমন দৃশ্য।

ওই এলাকায় যাওয়ার একমাত্র সড়কটির বেহাল দশা। প্রায় তিন কিলোমিটার ওই সড়কের কোথাও নেই সড়ক বাতি। তীব্র সুপেয় পানির সংকট। সাপ্লাইয়ের পানির ব্যবস্থা না থাকায় ২২ পরিবার মিলে ব্যবহার করছে একটি নলকূপ। তাও ঠিকমতো পানি ওঠে না বলে জানান সেখানকার বাসিন্দারা। ফলে তারা বাধ্য হয়ে দূর থেকে পানি টেনে আনছেন নয়তো নদীর পানি দিয়েই প্রয়োজন মেটাচ্ছেন।

Advertisement

ওই এলাকার বাসিন্দারা জানান, নির্বাচন ছাড়া কোনো জনপ্রতিনিধিদের দেখা মেলে না ‘বরিশালের ছিটমহল’ খ্যাত চর জাগুয়ায়। নির্বাচন আসে নির্বাচন যায়; কিন্তু এলাকার রাস্তাঘাটের কোনো উন্নয়ন হয় না। এমনকি কোনো জনপ্রতিনিধি প্রতিবন্ধী, বয়স্ক, বিধবা ভাতার ব্যবস্থাও করেননি।

স্থানীয় বাসিন্দা রাহিমা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভোট আইলেই দেহি খালি লোকজন আয়। ভোট শেষ হেরাও উধাও। পরে আর হেগো খবরও থাহে না। দীর্ঘ কত বছর হইছে এই এলাকার রাস্তাঘাট নাই। হে কেউ একটু ফিররাও দেহে না।’

তিনি বলেন, ‘সবাই সিটিতে থাহো কইয়া খোঁচা মারে। মোরা কিসের সিটিতে থাহি (থাকি)? এউক্যা রাস্তা হেই কবে হিরন মেয়া কইর্যা থুইয়া গ্যাছে। এরপর আর কেউ এইডারে ঠিক করে নাই। এহনতো এই রাস্তায় পায়ে হাইট্টা চলাডাও কঠিন। নদী পার হওয়ার লইগ্যা সিটি দিয়া একটা ট্রলার দেছে। কিন্তু হেতো সপ্তায় দুইদিন ছাড়া চলে না। বাহি দিনগুলা মোগো ব্যাডারা কি ঘরে ঘুমাইয়া ইনকাম করবে?’

রাহিমা বেগম বলেন, ‘জরুরি দরকার অইলে (হলে) ফোন দেলেওতো ট্রলার আলায় ধরে না। ধরেন রাইতে। কেউ অসুস্থ হইয়া পড়ছে, হ্যারে হাসপাতালে নেতে অইবে। ট্রলার আলায় ফোন ধরবে না। আর ধরলেও কইবে আইতে পারবে না। তয় এই ট্রলার দিয়া লাভ কী? মোগো ঘুইর্যা (ঘুরে) বরিশাল যাইতে যাইতে তো রুগী মইর্যাই যাইবে।’

Advertisement

‘মোগো এহানেতো সব মানুষ গরিব। হ্যার পরও মোরা খাজনা দি (দিই), কর দি। কিন্তু সিটির কোনো সুযোগ-সুবিধা পাই না। এরচাইয়া ইউনিয়নে থাকলে একটা ঘরতো পাইতাম। ২২ পরিবারের লইগ্যা এউক্যা চাপকল (গভীর নলকূপ) বহাইয়া দিছিলো পারুলে (সাবেক নারী কাউন্সিলর)। এহন আর হেডা দিয়াও পানি ওডেনা ঠিকমতো,’ আক্ষেপ করে বলেন চর জাগুয়ার এ নারী বাসিন্দা।

টিউবওয়েলে পানি না থাকায় নদী আর পুকুরের পানি ফুটিয়ে পান করতে হয় জানিয়ে রেকসোনা বেগম নামের আরেক গৃহবধূ বলেন, ‘কলসে কইর্যা নদী দিয়া পানি টাইনা আনতে হয়। এরপর ফুডাইয়া খাই। এসব সমস্যার কারণে এখন পোলাপান এখানে থাকতে চায় না।’

ষাটোর্ধ্ব কুলসুম বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘যারা যেডু ইনকাম হরে (যারা একটু আয় করে) হেইয়া দিয়া (তা দিয়ে) পোলাপান পড়ালেহা করানের চেষ্টা হরে (করে) যাতে হ্যারা ভালো চাকরি পাইয়া এই জায়গা ছাড়তে পারে। তয়, মোগোতো বয়স হইয়া গ্যাছে। এরহম হরতে হরতেই (করতে করতেই) মোরা এহানে জীবনডা পার হরমু।

তিনি বলেন, ‘মোগো এহানে মুইসহ কয়েকজন বয়স্ক ও বিধবা নারী আছে। আছে বয়স্ক পুরুষও। আবার মোর একটা পোলার চোহে (চোখে) সমস্যা। কিন্তু সব মিলাইয়া মোগো এহানে একলগে এই ৪০ পরিবারের কেউ বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতার কিছুই পায় না। চেয়ারম্যান (কাউন্সিলর) ও হ্যার অফিসের কারো কাছে গিয়ে চর জাগুয়ার কথা কইলে আর কথা হোনতে (শুনতে) চায় না।’

শুধু এসব ভাতা না, মাতৃকালীন কিংবা শিশুদের জন্য বরাদ্দ থাকা কোনো ভাতাই চর জাগুয়ার মায়েরা গত কয়েক বছরে পাননি বলে জানান লিজা ও শিউলি নামের দুই গৃহবধূ।

লিজা বলেন, ‘ভাতা দিয়া আর কী করমু? মোগো বাচ্চাগো কোনো টিকা দিতে হইলে নলছিটি বা নদীর ওপার শহরে যাওয়া লাগে। এফারে টিকার কর্মীরা কেউ আইতে চায় না। শিক্ষকরা পর্যন্ত মোগো পোলাপানরে ঠিকমতো পড়াইতে চায় না।’

‘এহানে চরজাগুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও সেখানে সন্তানদের পাঠান না’ জানিয়ে শিউলি বলেন, ‘ওহানেতো পোলাপানও পড়তে চায় না। এহনতো বাস্তবে ছাত্রছাত্রী নাই বললেই চলে। আবার শিক্ষকরা ঠিকমতো আসেও না, ক্লাসও নেয় না। পোলাপান দিয়া নানান কাম করায়। তাই পোলাপানরে নলছিটির কুমারখালী বা তিমিরকাঠির স্কুল মাদরাসায় পড়ায় সবাই।’

এ বিষয়ে আলাপকালে নিজের অসহায়ত্বের কথা স্বীকার করেন স্থানীয় কাউন্সিলর হুমায়ুন কবির। তিনি জাগো নিউজে বলেন, ‘বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ নির্বাচিত হওয়ার পর এলাকায় কিছু করতে পারিনি। কারণ তিনি সব কিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে করেছেন। আমরা নামেমাত্র কাউন্সিলর ছিলাম। তাছাড়া গভীর নলকূপের ত্রুটির বিষয়ে আমাকে কেউ কিছু জানাননি। সড়ক বাতি বসানো, সেতু ও রাস্তা সংস্কারের বিষয়ে প্রকল্প দেওয়া রয়েছে। তবে কবে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে তা জানি না।’

তিনি বলেন, ‘কালিজিরা থেকে চর জাগুয়ায় পারাপারে খেয়া ও স্টাফ দিয়েছে সিটি করপোরেশন থেকে। খেয়ার মাঝি সিটি থেকে বেতন নিলেও তার কোনো হাজিরার ব্যবস্থা স্থানীয় কাউন্সিলরের কার্যালয়ে নেই। আর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি বাপ্পীকে বাদ দেওয়ার আগে তিনি এটা দেখাশুনা করতেন। এখনতো তাও নেই। তাই তার খেয়াল-খুশি মতো চলছে।’

এসআর/জিকেএস