কৃষি ও প্রকৃতি

টাঙ্গাইলে ‘ব্ল্যাক রাইস’ চাষে সফল কলেজছাত্র নাহিদ

টাঙ্গাইলের বাসাইল পৌরসভার পশ্চিমপাড়ায় ওষুধি ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ‘ব্ল্যাক রাইস’ চাষ করে তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা নাহিদ মিয়া (২৪) সফল হয়েছেন। তিনি সরকারি সা’দত কলেজের ডিগ্রি প্রথম বর্ষের ছাত্র ও বাসাইল পশ্চিমপাড়ার নাছির উদ্দিনের ছেলে। পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি শখের বশে ৫০ শতাংশ জমিতে এ ধানের চাষ করেছেন। এতে বাম্পার ফলন হয়েছে। বাসাইল উপজেলার কাউলজানী ইউনিয়নের সেহরাইল গ্রামে নাহিদ মিয়ার ধানক্ষেতে ব্ল্যাক রাইস এখন হাওয়ায় দোল খাচ্ছে।

Advertisement

বাবার ৫০ শতাংশ জমিতে নিজ উদ্যোগে ব্ল্যাক রাইস চাষ করেছেন নাহিদ। ধানগুলো অনেকটা পরিপক্ব হয়েছে। ক’দিন পরই কেটে ঘরে তুলবেন। তার ধানক্ষেত দেখতে অনেকেই ভিড় করছেন। অনেক কৃষক ব্ল্যাক রাইস চাষ করার আগ্রহ প্রকাশ করছেন। ভিয়েতনামি এ ধানের বীজ অনলাইনের মাধ্যমে অর্ডার করে আনেন তিনি।

জানা যায়, কালো চাল (বেগুনি হিসেবেও পরিচিত) হচ্ছে ধানের এক জাতীয় বিশেষ ধরনের প্রজাতি। এ ধরনের ধান কৃষি মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত নয়। পৃথিবীতে ৭-৮ জাতের ব্ল্যাক রাইস চাষ হয়। এর বিভিন্ন প্রকরণের মধ্যে কয়েকটি বেশ আঠালো বা চটচটে চাল উৎপাদন হয়। বিভিন্ন ধরনের প্রকরণের মধ্যে আছে- ইন্দোনেশীয় কালো চাল, ভিয়েতনামি চাল, ফিলিপাইনের বালাতিনা চাল, চায়না ব্ল্যাক রাইস এবং থাই জুঁই (জেসমিন) কালো চাল। মণিপুরে এ জাতীয় কালো চাল চক-হাও নামে পরিচিত। সে অঞ্চলে কালো চাল থেকে তৈরি নানা জাতীয় মিষ্টান্ন অনুষ্ঠানে মূল ভোজনপর্বে পরিবেশন করা হয়।

আরও পড়ুন: ব্রি’র ৩ জাতের ধান চাষে কৃষকদের মুখে হাসি

Advertisement

কালো চাল অনেকের কাছে অপরিচিত হলেও এর ইতিহাস প্রাচীন। হাজার বছর ধরে এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ চালের চাষ হচ্ছে। চীনের ইতিহাসে এ চাল নিয়ে অদ্ভুত নিয়ম লোকমুখে শোনা যায়। আগে চীনে শুধু রাজ পরিবারের সদস্যরাই এ চাল খেতে পারতেন। সাধারণ মানুষের জন্য এ চাল নিষিদ্ধ ছিল। অনেকের ধারণা, পুষ্টিগুণ বিবেচনা করে এ চালকে রাজকীয় খাবার হিসেবে সংরক্ষণ করাই ছিল এ নিয়মের মূল উদ্দেশ্য। দেশের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোয় কয়েক ধরনের কালো ও বাদামি ধানের চাষ হয়। কৃষকরা এতকাল এর গুরুত্ব অনুধাবন করে চাষ করছেন। এ ধরনের উচ্চ আঁশযুক্ত চালের ভাত সাধারণত বাংলার কৃষকেরা খেতেন। এ ভাত খেলে অনেকক্ষণ পেট ভরা থাকে। ফলে শুধু সকালে আর বিকেলে খেলেই তাদের চলে যেতো।

ব্ল্যাক রাইসের পুষ্টিগুণ সাধারণ চালের চেয়ে প্রায় তিনগুণ। এ চাল কালো হওয়ার মূল কারণ অ্যান্থোসায়ানিন নামক এক প্রকার উপাদান। এটি মূলত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। যা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। অন্য চালের তুলনায় এর আমিষের পরিমাণ বেশি। এতে চিনির পরিমাণ কম এবং আঁশের পরিমাণ বেশি। এ ছাড়া ভিটামিন-ই যুক্ত থাকায় এ চালের বিশেষ রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা আছে। এতে ফাইবার অনেক বেশি থাকে। তাই এ চালের ভাত শরীরে খুব ধীরগতিতে গ্লুকোজ তৈরি করে। ফলে শরীরে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। এ কারণে এ চালকে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুব কার্যকর বলা হয়। এ ধান বছরে শীত ও গ্রীষ্ম কালে একই জমিতে দুবার চাষ করা যায়।

বাসাইল পৌরসভার তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা নাহিদ মিয়া বলেন, ‘ইউটিউবে প্রথম এ ধান চাষাবাদের বিষয়ে দেখে বিস্তারিত জানতে পারি। পরে অনলাইন থেকে ধানের বীজ সংগ্রহ করি। ৫০০ টাকা কেজি দরে ভিয়েতনামি ব্ল্যাক রাইসের ৫ কেজি বীজ সংগ্রহ করি। ৫০ শতাংশ জমিতে এ ধানের চাষ করতে মোট খরচ হয়েছে ৬-৭ হাজার টাকা। এ ধান তিন মাসের মধ্যে ঘরে তোলা যায়। আশা করছি ৫০ শতাংশ জমিতে ৪০-৪৫ মণ ধান পাবো।

আরও পড়ুন: জমিতেই নষ্ট হচ্ছে কৃষকের সোনালি স্বপ্ন

Advertisement

তিনি বলেন, ‘পড়াশোনার পাশাপাশি শখের বসে এ ধান প্রথমবারের মতো চাষ করেছি। প্রথমবার চাষ করে সাফলতা পেয়েছি। বাম্পার ফলন হয়েছে। আশা করি এ ধান চাষ করে লাভবান হবো। সামনের বছর আরও বেশি করে চাষ করবো। এলাকার অন্য কৃষকেরাও এ ধান চাষ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। অনেকেই এ ধানের বীজের জন্য অগ্রিম অর্ডার করেছেন। তাই এ ধান বীজ হিসেবে সংরক্ষণ করে কম দামে কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিতে চাই।’

স্থানীয় কৃষক কাদের মিয়া, মফিজ ও রহিজ উদ্দিন বলেন, ‘কালো ধানের নাম আগে শুনেছি। এবারই প্রথম দেখলাম। ধানগুলো পরিপক্ব হয়েছে। সাধারণ ধানের চেয়ে প্রায় দেড়গুণ ফলন হয়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকে দেখতে আসছেন। নাহিদের কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছি। কম খরচে বেশি ফলন হওয়ায় এ ধানের বীজ সংগ্রহ করে আগামিতে চাষ করবো।’

বাসাইল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহজাহান আলী বলেন, ‘কালো ধানের এ জাত দেশে সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত নয়। তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা নাহিদকে অফিসে ধানের নমুনা নিয়ে আসতে বলা হয়েছে। ধান চাষে তাকে উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে সার্বিক সহায়তাসহ সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।’

আরও পড়ুন: কালীগঞ্জে নেক ব্লাস্টে নষ্ট হচ্ছে ধান

টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আহসানুল বাসার বলেন, ‘খুবই ভাল উদ্যোগ। তরুণরা এগিয়ে এলে দেশের কৃষিখাত অনেক এগিয়ে যাবে। এ ধান অনুমোদিত বীজ থেকে উৎপাদন করা হয়নি বলে এখনই কিছু বলতে পারছি না।’

(এআরটি)আরিফ উর রহমান টগর/এসইউ/জেআইএম