ঢাকা দক্ষিণ সিটি নাকি দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান। এই দাবি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন করে এই দাবি করেন। তার এই দাবি কতোটা খাঁটি তার একটি নমুনা আমরা দেবো একটু পরেই। তার আগে মেয়র তাপসের বক্তব্য আমরা পড়ে দেখি।
Advertisement
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সব সরকারি সংস্থা, সরকারি অধিদপ্তর যা আছে, তার মধ্যে একমাত্র ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সবচেয়ে দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান।’
আজ মঙ্গলবার ( ১৬ মে, ’২৩) দায়িত্ব গ্রহণের তৃতীয় বর্ষপূর্তিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ফজলে নূর তাপস এমন দাবি করেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটির নগর ভবনের মেয়র হানিফ মিলনায়তনে ‘উন্নত ঢাকার উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় ৩ বছর’ শীর্ষক এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, উদ্দেশ্য ছিল সুশাসিত ও দুর্নীতিমুক্ত ঢাকা দক্ষিণ সিটি দাঁড় করানো। এই তিন বছরে আজ বলতে পারি, একমাত্র ঢাকা দক্ষিণ সিটি সবচেয়ে দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান। কারণ, প্রথম দিন থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা ‘শূন্য সহনশীল’।(প্র/আ/১৬ মে, ২৩)
Advertisement
এরকম দাবি তিনি করতেই পারেন। কারণ, তিনি তো অব্যাহতভাবে খাসজমি দখলমুক্ত করে চলেছেন। তাঁর এই চেষ্টা অব্যাহত থাকলে আমরা তো বলতেই পারি তিনি যে দাবি করেছেন, তা শতভাগ না হোক, কিছুটা তো সত্য বটেই। অবৈধ দখলদাররা তো রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা ছায়া মানুষ বা ছায়া-রাজনীতিক। ছায়া মানুষদের ধরা খুবই কঠিন। তাদের আকার নেই প্রকার নেই, পিছলা যায়।
কতোরকম সূত্র ধরে যে তারা তাদের দখলি স্বত্ব অব্যাহত রাখে, তার কি কোনো লেখাজোখা আছে। শুধু আইনি পেশায় থাকলে তিনি দখলদারদের ফোকড়গুলো দেখতে পেতেন। কিন্তু রাজনৈতিক সেক্টরে থাকলে দেখা/চেনা ফোকড়গুলো চোখে পড়লেও তা না দেখার একটি রাজনৈতিক অভ্যাস গড়ে ওঠে। এই যে তিনি দাবি করছেন যে দক্ষিণ সিটির অফিসগুলো এখন পুরোপুরিই দুর্নীতিমুক্ত- এই ঘোষণা দেওয়ার আগে কি তিনি তার অফিসের, শাখা অফিসে গিয়ে পরিবেশ পরিস্থিতি কি বিচার করেছিলেন? তিনি কি দেখে এসেছেন কি রকম অবর্ণনীয় পরিবেশে বসে তারা গ্রাহকদের সেবা দিচ্ছেন? সেই সব কর্মীরা যে বিশাল স্তূপের ফাইলের নিচে পড়ে থাকেন এবং সেবা দেন টু পাইস পাওয়ার আশায়, তা কি তিনি আঁচ করতে পারেন? না পারলে এই অভিজ্ঞতাটুকু পাঠ করুন, তাহলে বুঝতে পারবেন, সত্য কোথায় লুকিয়ে আছে।
তিনি কি জানেন দুর্নীতি কেমন করে হয়। যারা হোল্ডিং ট্যাক্স দিতে যায়, দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার ও কর্মচারীরা নানা সুযোগের পরামর্শ দেন। প্রথমেই বলেন আপনি যদি ট্যাক্স দেন, তাহলে নোটিশে বর্ণিত বিদ্যমান অংকের অর্থের ২৫ শতাংশ কম নেওয়া হবে। সেবাপ্রত্যাশী বাড়ির মালিক সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায়। বিনিময়ে ৩০-৪০ হাজার টাকা দিতে হয় ঘুস হিসেবে। ওই কাজ শেষ হলে তারা বলেন আরও ২৫ শতাংশ কর মওকুফের সুযোগ আছে, যদি ২৫ হাজার টাকা দেন। বাড়িওয়ালা রাজি হন, কারণ তা নোটিশে পাওয়া টাকার অংকের অর্ধেকে এসে ঠেকবে। বিশাল অংকের ট্যাক্স যখন অর্ধেকে নেমে আসে তখন, বাড়িওয়ালা মহাখুশি। তাই তিনি রাজি হয়ে যান।
এভাবে দক্ষিণ সিটির মাননীয় কর্তাব্যক্তিরা ঘুসের বিনিময়ে সেবা দিচ্ছেন নিয়মিত। এই ঘুসের টাকাটা যে তিনি একা নেন, তা নয়, তার সেকশনের প্রত্যেকেই এর ভাগিদার। এ কথা তারা ফিসফিসে গলায় বলেন সেবাপ্রার্থীকে। এটা ওপেন সিক্রেট। অফিসের অন্য কেউ এনিয়ে টুঁ শব্দটি করেন না।
Advertisement
যদি একদিনে একশজন সেবাগ্রহিতা সিটির একটি অফিসে আসেন তাহলে তাদের ঘুসের রোজগার নেহায়েত কম হওয়র নয়। সেই অর্থের পরিমাণ বেশ কয়েক লাখ টাকা হবে। দিন শেষে তারা সেই রোজগার নিয়ে ঘরে ফেরেন।
মাত্র একটি সেকশনের কথা বলা হলো। এরকম কতোটা সেকশন আছে, যেখানে সেবাগ্রহিতাদের যেতে হয় এবং মহাব্যস্ত কর্মকর্তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে সেবা নিতে হয়। তারা এতোটাই ব্যস্ত থাকেন যে কাজের ফাঁকে ফাঁকে আড্ডায় মশগুল হতে বাধে না তাদের। এরকম একটি সিটি অফিসের চেহারা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে অর্জন করা গেছে। হোল্ডিং ট্যাক্সের অংকটি এত বড় যে তা পরিশোধ করতে একজন বাড়িওয়ালার সামর্থ্যকে নস্যাৎ করে দেবে। তারা সিটি মেয়রের ওপরই কেবল নাখোশ হবেন না, গোটা দেশের সরকারি অফিসের ওপরও নাখোশ হয়ে পড়েন। কেন নোটিশে ৮-১০ লাখ টাকা বকেয়া ট্যাক্স ধরে তা সার্ভ করা হয়? কেন ২০১৪ সালের হোল্ডিং ট্যাক্সের নোটিশ ২০১৮/১৯ সালে পাঠানো হয়।
যদি ২০১৪ সালেই হোল্ডিং ট্যাক্স ধার্য করা হয়, তাহলে ওই বছর বাড়িওয়ালা হোল্ডিং নম্বর কেন পেলো না? আর ওই বছরের মধ্যেই কেন তা গ্রাহকের কাছে পৌঁছানো হলো না? সিটি অফিস কি এতোটাই স্লো যে সেবা পেতে গ্রাহককে তিন/চার বছর অপেক্ষা করতে হবে।
আমি বুঝতে পারি মেয়র সাহেব এতোটা নিচের দুর্নীতির খবর রাখতে পারেন না। কিন্তু এটা তাঁকে মনে রাখতে হবে যে তিনি যখন দুর্নীতিমুক্ত বলে ঘোষণা করবেন তার আওতাধীন সিটি অফিসকে তখন অফিসের আগাপাসতলা চেক করে নিয়েই তা করলে তাঁর দায়টা কমতো। পলিটিক্যাল নেতার মতো যদি আমি দুর্নীতিমুক্ত বলে আওয়াজ দেন তাহলে বুঝতে হবে যে ওই ঘোষণা রাজনৈতিক চেতনাজাত। সেখানে সত্য আছে নিকেলে গড়া। নিকেলে গড়া সত্য দুদিন পরই কালো হয়ে যায়।২.দক্ষিণ সিটি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস আরেকটি ঘোষণা দিয়েছেন। ধোলাইখাল জলাধার নির্মাণের কাজ উদ্বোধনের পর তিনি বলেন, এই জায়গা হাতিরঝিলের চেয়েও সুন্দর, নান্দনিক ও সবুজ হবে, যা আসলে পুরান ঢাকার ফুসফুস বলে খ্যাত হবে।
তার কথাগুলো শুনতে বেশ ভালো লাগলো। মনে হলো ধোলাইখাল জলাধার এরই মধ্যে হয়ে গেছে। এখন ফুসফুসটি চালু হলো। না, তা হয়নি। কাজ শুরু হলো। আমরা আশাবাদী যে আগামী একবছরের মধ্যেই পুরান ঢাকার ফুসফুসটি মেয়র সাহেব উদ্বোধন করতে পারবেন। কিন্তু বড় আকারের গাছ তো লাগাতে পারবেন না। সে রকম ব্যবস্থা বিদেশে আছে।
মাঝারি সাইজের গাছ পুরো শেকড়শুদ্ধ তুলে নিয়ে এসে নতুন জায়গায় বসিয়ে দেওয়া হয়। সেই টেকনোলজি তাদের জানা আছে, সেইরকম মেশিনারিজ আছে, আছে দক্ষ লোকবলও। এরকম করা গেলে ধোলাইখাল জলাধার ও সবুজায়নের এই কর্মসূচিটি অচিরেই পুরান ঢাকার সত্যিকারের ফুসফুস হয়ে উঠতে পারে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ তাপস ধোলাইখাল জলাধার উন্নয়ন কার্যক্রমের বিস্তারিত তুলে ধরে বলেন, এখানে যেমন সুপ্রশস্ত হাঁটার পথ থাকবে, তেমনি সাইকেল চালানোর সুযোগ থাকবে। এখানে সবুজায়ন হবে ও উন্মুক্ত মঞ্চ থাকবে। এছাড়া পর্যাপ্ত শৌচাগারের ব্যবস্থা থাকবে। এখানে ঘাটলা থাকবে, মাঠ থাকবে। শিশুদের খেলার জায়গা থাকবে। ঝরনা থাকবে এবং খাবারদাবারের ব্যবস্থা থাকবে।’
মেয়র তাপসের এই আশা পূরণ হোক এবং এর ভেতর দিয়ে পুরান ঢাকাবাসীর সত্যিকার উন্নয়নের রূপ আমরা দেখতে পাবো বলেই বিশ্বাস করি। এই বিশ্বাস তখনই পোক্ত হবে যখন ধোলাইখাল জলাধার প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়ে খুলে দেওয়া হবে। এখানে সকাল সন্ধ্যায় সাধারণ মানুষ হাঁটাচলা, সাইক্লিং করার সুযোগ পাবে এবং অক্সিজেন ফ্যাক্টরির একটি প্রাকৃতিক বনায়ন হবে।
শুধু কথায় তো চিড়ে ভিজে না। আমরা যারা পথে পথে ঘুরে জীবনের রূপ ও রস নিই তাদের কাছে ওসমানি উদ্যান একটি প্রকৃত ফুসফুস ছিল। কিন্তু পাঁচ বছর ধরে সেই ফুসফুসটি বন্ধ করে রাখা হয়েছে। কারণ উন্নয়নের কাজ চলছে। সেই উন্নয়নের জন্য ওসমানি উদ্যানের গাছ কেটে ফেলে সেখানে কিছু স্থাপনা করার কথা থাকলেও, তা গত পাঁচ বছর ধরে বন্ধ।
পত্রিকার রিপোর্ট পড়ে যা বোঝা গেলো সিটি করপোরেশনের চোখের সামনের এ উদ্যানটির এমন অবহেলা ও এর সবুজায়নকে হত্যা করার পরিকল্পনা সিটির আগের মেয়র সাহেব নিয়েছিলেন। নতুন মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস এসে সেই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রাখতে পুনরায় ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্নটি অন্য জায়গায়। এই পার্কের সবুজ গাছ কেটে ফেলে যে সব স্থাপনার নকশা করা হয়েছে, তাতে করে এর সবুজ আর সবুজ থাকবে না, তা হবে কংক্রিটে মোড়া সবুজের একটি ফুলদানি। এখান থেকে সাধারণ মানুষ অক্সিজেন যেমন পাবেন না, তার চেয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের কোলাহলে পূর্ণ হয়ে উঠবে ওই বাগানটি।
এই সিদ্ধান্তটি কি সঠিক বলে মানা যায়, না যাবে? দেশের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা এই বাগানের বৃক্ষ রক্ষায় আন্দোলন করেছিলেন বলেই আজও ভূমিখোরদের গ্রাসের বাইরে রয়ে গেছে ওসমানি উদ্যান। এখন মেয়র তাপস যদি এই নগরের পিতা হয়ে থাকেন, তাহলে তাকে বুঝতে হবে ওই উদ্যানের সৌন্দর্য ইট, সিমেন্ট, বালির কংক্রিটের মধ্যে নেই। ওর সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে সবুজায়নের ভেতরে, যেখানে সাধারণ মানুষেরা নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য দুদণ্ড ঘুরে যাবেন এখানে। ঢাকার প্রাণ কেন্দ্রের এই উদ্যানের রূপ ফিরে আসবে তার নবপর্যায়ে প্রাকৃতায়নে, কংক্রিটের স্থাপনায় নয়।
আমাদের নিঃশ্বাস নেওয়ার অক্সিজেন ফ্যাক্টরি তৈরির বিকল্প নেই। গাছ আমাদের যেভাবে বিনিময়হীন শ্বাস নেওয়ার উপাদান দেয়, তাকে হত্যা করে উন্নয়ন হতে পারে না। উন্নয়নকে প্রকৃতির সঙ্গে মিশিয়ে ডিজাইন করতে হয়। পৃথিবীর বহু দেশে এমনটা রয়েছে। আমরা সে সব দেশ থেকেও সাহায্য নিতে পারি।
সিদ্ধান্তটি মেয়র সাহেবকেই নিতে হবে। কোন পথে তিনি যাবেন। আমরা বলবো, নতুন করে এই উদ্যানের উন্নয়নের জন্য ব্যয় না করে তা ব্যয় করা হোক সবুজায়নের জন্য। এবং মানুষ যাতে বিশ্রামের সুযোগ পায়, ছায়া পায়, দুদণ্ড ছায়ার ভেতরে জীবনের স্বাদ নিতে পারে, সেই আয়োজনই প্রকৃত উন্নয়ন বলে খ্যাত হবে।
লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম