দেশ এখন নির্বাচনী মুডে আছে। বিএনপি অংশ না নিলেও পাঁচ সিটি করপোরেশনেই এখন জমজমাট নির্বাচনী হাওয়া। গাজীপুরের নির্বাচন তো দোরগোড়ায়। বাকি চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ট্রেনও চলতে শুরু করেছে। তবে অংশ না নিলেও সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে বিপাকে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। নির্বাচনের আড়ালে হারিয়ে যেতে বসেছে তাদের সরকারবিরোধী আন্দোলন।
Advertisement
বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ব্যাপারে অনড় বিএনপি। পাঁচ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বিএনপির বড় কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী নেই। এটা তাদের সাফল্যই মানতে হবে। ভয় ছিল সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে নিয়ে।
তিনি আসলে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দলের অনুমোদন না পেয়ে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মেয়র পদে বিদ্রোহ ঠেকাতে পারলেও কাউন্সিলর পদে নির্বাচন থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের পুরোপুরি বিরত রাখতে পারেনি বিএনপি।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় বিএনপি ২৯ জন নেতাকে দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করেছে। বাকি চার সিটি করপোরেশনে এই সংখ্যাটা আরও বাড়বে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
Advertisement
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকার বদল হয় না। কিন্তু সাধারণ মানুষ এখানে দারুণভাবে সম্পৃক্ত থাকেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মেয়র, কাউন্সিলর, সংরক্ষিত আসনের নারী কাউন্সিলর মিলিয়ে প্রার্থী থাকেন অনেক বেশি। ফলে নির্বাচনী প্রচারণা হয় জমজমাট। প্রার্থীরা নিজেদের তাগিদেই ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চান। জাতীয় রাজনীতির চেয়ে এখানে স্থানীয় রাজনীতি বেশি গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে কাউন্সিলর প্রার্থীদের কাছে। তাই দল থেকে বহিষ্কারের ঝুঁকি নিয়েও বিএনপির স্থানীয় নেতারা দলে দলে কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
অথচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার কথা ছিল। তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। আর একতরফা নির্বাচনে উত্তাপ কম থাকবে, ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাবেন না। নির্বাচন শেষে বিএনপি বলবে, আমরা আগেই বলেছি এই সরকারের অধীনে কোনো অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচন সম্ভব নয়। সেটাই প্রমাণিত হলো।
এই অপবাদ মুছতে, সরকারি দল এবার ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নেমেছে। একতরফা নির্বাচনে তাদের জয় সুনিশ্চিত। তবে সরকারি দলের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ভোটারদের কেন্দ্রে আনা। সে ব্যাপারেও সরকারি দলের প্রস্তুতি রয়েছে। আর মেয়র, কাউন্সিলর, সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থীরা মিলে ভোটারদের আনার চেষ্টা করলে কেন্দ্রে লম্বা লাইন হওয়ার কথা। তাই ফলাফল যাই হোক, নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের আগ্রহ নেই, এমন প্রচারণা এবার সত্যি নাও হতে পারে।
তবে বিএনপির বিপদ অন্যখানে। বিএনপির আন্দোলন নিয়ে হাসিঠাট্টা হয়- কোন ঈদের পর আন্দোলন। অনেকদিন ধরেই বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। গত বছরের শেষ দিকে সভা-সমাবেশে দেশজুড়ে আলোড়ন তুলতে পারলেও রমজানে বিএনপির আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়।
Advertisement
ঈদের পর আবার নতুন করে আন্দোলন শুরুর কথা ছিল। নতুন নতুন কর্মসূচি নিয়ে বিএনপি মাঠেও নেমেছে। কিন্তু রমজানের আগে আন্দোলন যে পর্যায়ে উঠেছিল, সেখান থেকে শুরুটা করতে পারছে না। বিএনপিকে আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হচ্ছে। আন্দোলন আসলে একটা গাড়ির মতো। ধীরে ধীরে গিয়ার বদল হয়, গাড়ির গতি বাড়ে। রাজনৈতিক আন্দোলনও ধীরে ধীরে গতি পায়।
কিন্তু সমস্যাটা হলো দেশের মানুষ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভালোমন্দ নিয়ে যতটা আলোচনা করছে, বিএনপির আন্দোলন নিয়ে ততটা নয়। বিএনপির অভিযোগ, তাদের আন্দোলন থেকে জনগণের দৃষ্টি সরাতেই সরকার নির্বাচন দিয়েছে। সরকার অত পরিকল্পনা করে কিছু করেছে বলে মনে হয় না। পাঁচ সিটি করপোরেশনে স্বাভাবিক মেয়াদেই নির্বাচন হচ্ছে। কোথাও আগাম নির্বাচন হচ্ছে না। কাকতালীয়ভাবে বিএনপির আন্দোলনের সাথে নির্বাচনের টাইমিং মিলে গেছে, যা সরকারকে বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে।
আন্দোলনের টাইমিং নিয়ে বিএনপি ভালোই গ্যাড়াকলে পড়েছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ডামাডোল থামতে না থামতেই ঈদুল আজহা চলে আসবে। তখন আবার বিএনপিকে ‘ঈদের পরে আন্দোলন’র জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এর সাথে চলে আসবে বর্ষাকাল। ঝুম বৃষ্টিতে আান্দোলন জমানো মুশকিল।
বর্ষা ফুরানোর সাথে সাথেই চলে আসবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল। বাস্তবিক অর্থে আন্দোলনের জন্য বিএনপির সময়টা খুব খারাপ। আসলে বিএনপি ভুল সময়ে আন্দোলনের গাড়ির গিয়ার বদল করেছিল। যে আন্দোলনটা নির্বাচনের ঠিক আগে আগে করা উচিত ছিল, সে আন্দোলনটা বিএনপি একবছর আগেই করে ফেলেছে। যখন তীব্র আন্দোলন দরকার, তখন বিএনপি নানান ফাঁদে পড়ে গেছে। বিএনপির জন্য আন্দোলনের সময়টা সত্যি খারাপ।
গত বছর আন্দোলন পিকে তুলতে পারলেও তাতে কোনো ফল আসেনি। বরং গত বছরের আন্দোলনে বিএনপির শক্তি ক্ষয় হয়েছে। তারচেয়ে বড় ভয় হলো, গত বছরের আন্দোলনের সময় বিএনপির নেতাকর্মীদের অনেকের নামেই সত্য-মিথ্যা অনেক মামলা হয়েছে। নতুন করে আন্দোলন চাঙা করতে গেলেই সেই পুরোনো মামলায় সরকার তাদের হয়রানি করতে পারবে। হয়তো ধরপাকড়ে আন্দোলনের গতি বদলে দিতে পারবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়, এই অবস্থানে অনড় থাকতে হলে বিএনপির সামনে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। তীব্র গণআন্দোলন ছাড়া আওয়ামী লীগ তাদের দাবি মানবে, এমন বাস্তবতা নেই। আবার বিএনপি আন্দোলন করে সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায় করে ফেলবে, এমন বাস্তবতাও নেই মাঠে। গত ১৪ বছরে বিএনপি যা পারেনি, এখন দ্বাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে কয়েক মাসের মধ্যে সেটা করে ফেলবে; এমনটাও মনে হয় না।
বিএনপির শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের নিরীহ কর্মসূচি দেখে মনে হচ্ছে, তারা আন্দোলন নয়, অন্য কোনো উপায়ে দাবি আদায় করতে চাইছে। হয়তো তারা ভাবছে, বিদেশি শক্তিগুলো চাপ দিয়ে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করে দেবে। কিন্তু বিদেশি শক্তিগুলো অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বললেও, কেউ এখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেনি।
আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না মানলে বিএনপি কী করবে, সেটা নিয়ে রাজনীতিতে ব্যাপক কৌতূহল রয়েছে। কোনো একটা দাবিতে অনড় থাকা ভালো। আপসহীন খ্যাতি পাওয়া যায়। কিন্তু শুধু আপসহীন অবস্থানে থাকলেই তো হবে না। মাঠের আন্দোলন দিয়ে দাবি আদায় করে নিতে হবে। না পারলে আপসহীনতা বরং উল্টো বুমেরাং হতে পারে। সরকার দাবি না মানলে বিএনপি যদি নির্বাচনে না যায়, আর আওয়ামী লীগ যদি আরও একটি একতরফা নির্বাচনে ক্ষমতায় থেকে যায়; বিএনপি কীভাবে তা ঠেকাবে। আরও একটি নির্বাচন বর্জন করে, আরও অন্তত পাঁচ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার মতো সাংগঠনিক সক্ষমতা বিএনপির আছে কি না, আলোচনা আছে তা নিয়েও।
বিএনপি সত্যি জটিল একটা রাজনৈতিক চক্করে পরে গেছে। তাদের পক্ষে আন্দোলন করে দাবি আদায় করাও কঠিন। নির্বাচনে যাওয়াও কঠিন। আবার নির্বাচন বর্জন করাও কঠিন। বিএনপি কী করবে, সে সিদ্ধান্ত তাদের দ্রুতই নিতে হবে। হাতে সময় খুব বেশি নেই। আন্দোলন করার জন্যও বেশি সময় নেই। আবার দেশি-বিদেশি শক্তির কোনো ফর্মুলায় যদি বিএনপিকে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যেতেই হয়, তাহলে নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্যও বেশি সময় পাবে না। বিএনপি সত্যিই সময়ের ফাঁদে পড়েছে।
২১ মে, ২০২৩লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/এএসএম