শিক্ষা

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ হরিলুট, ইউজিসির ৫৫ দফা সতর্কবার্তা

দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ লুটের মচ্ছব চলছে। ড্রাইভারকে দেওয়া হচ্ছে পঞ্চম গ্রেড বা যুগ্ম সচিবের সমান বেতন। বয়স পার করার পরও ‘সেশন বেনিফিটের’ নামে পরের জুন পর্যন্ত রাখা হচ্ছে চাকরিতে। বাংলোতে বসবাসের পরও উপাচার্য নিচ্ছেন বাড়ি ভাড়া। এভাবে অন্তত ২০টি খাতের আড়ালে উপাচার্য থেকে শুরু করে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সরকারি অর্থ লুটে নিচ্ছেন।

Advertisement

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) দীর্ঘ অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

দেখা গেছে, দেশে বর্তমানে ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। কয়েকটি বাদে প্রায় সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই ঘটনা ঘটছে। এ ক্ষেত্রে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ও পিছিয়ে নেই। আর্থিক প্রশাসনে শৃঙ্খলা আনতে দু-একদিনের মধ্যে এসব প্রতিষ্ঠানকে ৫৫ দফা সতর্কপত্র পাঠানো হচ্ছে। রোববার সংস্থাটির পূর্ণ কমিশনের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলমগীর জাগো নিউজকে বলেন, কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অযাচিত ব্যয় করা হচ্ছে। এটি বন্ধে ও কৃচ্ছ্রসাধন করতে নতুন করে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেই মোতাবেক কমিশনে সভা করে বাজেট নির্ধারণ করা হয়েছে।

Advertisement

আরও পড়ুন: দুর্নীতির মামলায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন কর্মকর্তা গ্রেফতার 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ড্রাইভারদের ‘টেকনিক্যাল অফিসার’ দেখিয়ে উপ-সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার সমান বেতনভাতা দেওয়া হয় ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৃষি, মওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুয়েটে। বুয়েট, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, ইসলামী এবং শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা কেউ বিশেষ ভাতা, কেউ দায়িত্ব ভাতার নামে বেতনের অতিরিক্ত ২০ শতাংশ হারে অর্থ নিচ্ছেন। বাংলো থাকার পরও বাড়ি ভাড়া নিচ্ছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।

‘নিয়োগের দিন থেকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নয়ন বা উচ্চতর স্কেল নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে বুয়েট এবং রুয়েটে। সহকারী রেজিস্ট্রারের নবম গ্রেডে বেতন পাওয়ার কথা। কিন্তু নিচ্ছেন ৫ম বা ষষ্ঠ গ্রেডে। আর উপ-রেজিস্ট্রারের ৭ম গ্রেডে নেওয়ার কথা। নিচ্ছেন চতুর্থ ও পঞ্চম গ্রেডে। এমন ঘটনা ঘটে চলেছে ঢাকা ও রাজশাহীসহ ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে। নানান কারণ দেখিয়ে অনর্জিত ইনক্রিমেট হিসেবে সর্বোচ্চ ৬টি পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষক-কর্মচারীদের পূর্ণ বাড়ি দেওয়ার পর বর্গফুটে কম ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ২০ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরমধ্যে ঢাকা, বাকৃবি, জাহাঙ্গীরনগর, ইসলামী এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় আছে। আছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নতুন প্রতিষ্ঠানও।’

আরও পড়ুন: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রসঙ্গ উঠলেই কেন ছি ছি? 

Advertisement

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, ইউজিসির উল্লিখিত অনুসন্ধানে কেবল অর্থ ব্যয় সংক্রান্ত অনিয়ম ও দুর্নীতি বেরিয়ে এসেছে। এর বাইরে নিয়োগ, নির্মাণ, সংস্কারসহ আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়ম আছে। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে লিফটসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৫ কোটি টাকার অনিয়মের তথ্য সম্প্রতি বেরিয়ে এসেছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে যে দুর্নীতি হয় তার সঙ্গে ইউজিসিরও কেউ কেউ জড়িত বলে অভিযোগ আছে। সম্প্রতি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ওই নিয়োগ বোর্ডে সদস্য ছিলেন ইউজিসির সচিব নিজে। এভাবে তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ কমিটির সদস্য ছিলেন। আর যথরীতি ওইসব নিয়োগ নিয়ে প্রশ্নও আছে।

এছাড়া অভিযোগ আছে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন আয় নিয়ে। সেসব আয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাজেটে দেখায় না বলে অভিযোগ আছে। এছাড়া এক খাতের টাকা অন্য খাতে ব্যয় এবং টেন্ডার ছাড়া কেনাকাটা এবং পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। ঢাকার বাইরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুৎপাদনশীল ব্যয়ের বড় একটি খাত হচ্ছে ঢাকায় রেস্ট হাউজ বা লিয়াঁজো অফিস স্থাপন। উপাচার্যরা ঢাকার বাইরে না যাওয়ার লক্ষ্যে লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে এগুলো স্থাপন করে থাকেন। আবার ঢাকায় অবস্থানের সুবিধার্থে শিক্ষক-জনবলের জন্য রেস্ট হাউজ রাখা হয়েছে।

আরও পড়ুন: করোনায় থেমে আছে ১৪ ভিসির অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত 

সবমিলে অনেকটা বেপরোয়াভাবেই শিক্ষক-কর্মচারীদের অবৈধ উপায়ে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতির ক্ষেত্রে একশ্রেণির ভিসি প্রধান ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করে থাকেন। তারা এতটাই বেপরোয়া যে, তাদের সরকার স্পর্শ করতে পারবে না এমন কথাও প্রকাশ্যে বলে থাকেন।

৫৫ দফা সতর্কতা: পরিপত্রে আগামী ১০ জুনের মধ্যে ৫৩ বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের চলতি অর্থবছরের সংশোধিত ও নতুন বছরের প্রাথমিক বাজেট পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হবে। পরিপত্রে উল্লেখযোগ্য নির্দেশনার মধ্যে আছে- প্রথম বর্ষ ভর্তি পরীক্ষার আয়ের সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ ব্যয় করা যাবে। বাকি ৪০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা করতে হবে। এই আয় নিজস্ব আয়ের মধ্যে অবশ্যই দেখাতে হবে। এছাড়া ভর্তি, টিউশন, পরীক্ষা, ল্যাব টেস্ট, বিশেষ কোর্স, বেতন থেকে কর্তনাদি, সম্পত্তি থেকে লব্ধ অর্থ অবশ্যই নিজস্ব আয় হিসেবে বাজেটে দেখাতে হবে। বিভিন্ন প্রকার ব্যয়ে প্রযোজ্য হারে ভ্যাট ও কর আদায় করতে হবে।

শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়িত্বভাতা বেতনের ১০ শতাংশ বা দেড় হাজার টাকার মধ্যে যেটি কম সেটি দেওয়া যাবে। অগ্রিম দেওয়া অর্থ সংশ্লিষ্ট অর্থবছরের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। এক খাতের অর্থ অন্য খাতে কিংবা মূল খাতের অর্থ অভ্যন্তরীণ কোনো খাতেই সমন্বয় করা যাবে না।

বলা হয়েছে, কমিশনের অনুমতি ছাড়া কোনো খাতে বরাদ্দের অতিরিক্ত ব্যয় করা যাবে না। কোনো খাতে বাড়তি অর্থের দরকার হলে ইউজিসিকে অবহিত করতে হবে। অনুমোদিত জনবলের বাইরে কোনো প্রকার নিয়োগ করা যাবে না। বিধিবহির্ভূত নিয়োগে ব্যয়ের জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়নি। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্তরা অবসরপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান থেকেই উৎসব ও নববর্ষভাতা গ্রহণ করবেন। চুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রহণ করতে হলে তাকে অঙ্গীকারনামা দিতে হবে যে, তিনি অবসরপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান থেকে এসব ভাতা নেন না। এ ধরনের জনবলকে চুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে কনসোলিডেট পেমেন্ট ফিক্সেশনের সময়ে কোনোভাবেই উল্লিখিত দুই ভাতা অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। ইউজিসির অনুমোদন ছাড়া অ্যাডহক, দৈনিকভিত্তিক বা আউটসোর্সিং করা যাবে না। আর শূন্যপদে অনুমোদনের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ অনুমোদন সাপেক্ষে নিয়োগ করা যাবে।

পরিপত্রে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টার বা ডরমেটরিতে বসবাসরত শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বাসাভাড়া, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকারের প্রচলিত নিয়মে আদায় করতে হবে। সুবিধাভোগীর কাছ থেকে অন্যান্য (পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস) প্রকৃত বিল আদায় করতে হবে। কোনো ভর্তুকি দেওয়া যাবে না। পুরাতন যানবাহন পুনঃস্থাপন, জমি/ফ্ল্যাট ক্রয় কিংবা বাড়ি ভাড়া, পেনশন-বিধি ও আর্থিক বিষয়ে প্রণীত নীতিমালাসহ অন্যান্য অর্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো অনুমোদনের জন্য ইউজিসিতে পাঠাতে হবে।

এমএইচএম/এমএইচআর/জিকেএস