কক্সবাজারে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যার পর নতুন করে আলোচনায় আসে পুলিশের ওসি প্রদীপের নাম। এ হত্যাকাণ্ডে তার সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ হওয়ায় এরই মধ্যে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। বহুল আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের পর প্রকাশ্যে আসতে থাকে ওসি প্রদীপের নানা অপকর্ম। যদিও এ ঘটনার আগে থেকেই দুদকের জালে ছিলেন প্রদীপ। অবৈধ সম্পদ অর্জনে জড়িয়ে যায় তার স্ত্রীর নামও।
Advertisement
দীর্ঘদিন অনুসন্ধান চালিয়েও ওসি প্রদীপের অবৈধ সম্পদের কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি তদন্ত সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। শেষমেশ ওসি প্রদীপের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে সাত দেশের দিকে তাকিয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমনে কাজ করা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি।
দুদক বলছে, দেশে ওসি প্রদীপের নামে কোনো অবৈধ সম্পদের অস্তিত্ব মেলেনি। তবে ওসি প্রদীপ নিজের নামে সম্পদ না গড়লেও স্ত্রী চুমকি কারণের নামে গড়েছেন অঢেল সম্পদ। দুদকের মামলায় চুমকি কারণকে সাজাও দিয়েছেন আদালত। স্ত্রীর অবৈধ সম্পদ অর্জনে সহযোগিতার জন্য প্রদীপেরও সাজা হয়েছে একই মামলায়।
আরও পড়ুন>> ‘পা দিয়ে গলা চেপে সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করেন ওসি প্রদীপ’
Advertisement
দুদক সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সাল থেকে স্ত্রীসহ ওসি প্রদীপের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। প্রাথমিক পর্যায়ে অবৈধ সম্পদ অর্জনের সত্যতা পেয়ে কমিশনে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এরপর কমিশনের অনুমোদনের পর ২০১৯ সালের শুরুর দিকে ওসি প্রদীপ ও তার স্ত্রী চুমকিকে সম্পদ বিবরণী জমার নোটিশ দেয় দুদক। সম্পদ বিবরণী জমার পর চুমকির বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, দুদকে দেওয়া সম্পদ বিবরণীতে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার প্রমাণ মেলে। তবে মেজর সিনহা রাশেদ হত্যার আগে ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি দুদক।
২০২০ সালের ৩১ জুলাই মেজর সিনহা রাশেদ হত্যাকাণ্ডের পর গ্রেফতার হন ওসি প্রদীপ। আর এর ২৩ দিনের মাথায় ২০২০ সালের ২৩ আগস্ট তড়িঘড়ি করেই ওসি প্রদীপের স্ত্রীর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা করে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি নিরোধক প্রতিষ্ঠানটি। ওই মামলায় ওসি প্রদীপকে স্ত্রীর অবৈধ সম্পদ অর্জনের সহযোগী হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
তবে সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার চার বছর পেরিয়ে গেলেও ওসি প্রদীপের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়টি দালিলিকভাবে নিশ্চিত হতে পারছে না দুদক। অনুসন্ধানে নিয়োজিত কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে ওসি প্রদীপের নামে কোনো অবৈধ সম্পদের হদিস মিলছে না। বিদেশে সম্পদ গড়েছেন কি না, সে বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মাধ্যমে সাত দেশের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটকে চিঠি দেয় দুদক।
আরও পড়ুন>> সিনহা হত্যায় প্রদীপ-লিয়াকতের মৃত্যুদণ্ড
Advertisement
দুদক প্রধান কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ওসি প্রদীপের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর সহকারী পরিচালক নুরুল ইসলাম গত ১৬ এপ্রিল দুদকের পরিচালক (মানি লন্ডারিং) বরাবর চিঠি দেন। এরপর চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি দুদকের পরিচালক (মানি লন্ডারিং) গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরী বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউর অপারেশন হেড বরাবর চিঠি দেন। ওই চিঠিতে প্রদীপ কুমার দাশের দাখিল করা সম্পদ বিবরণী যাচাই এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিষয়টি অনুসন্ধান প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করার অনুরোধ করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর উপ-পরিচালক আতিকুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ওসি প্রদীপের সম্পদ অনুসন্ধান চলমান। দেশে তার স্ত্রীর নামে অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। মামলাও হয়েছে। ওই মামলায় এরই মধ্যে আদালত রায় দিয়েছেন। রায়ে সাজাও হয়েছে। কিন্তু দেশে ওসি প্রদীপের অবৈধ সম্পদের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তাই বিদেশে সম্পদ গড়েছেন কি না, সে বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউর মাধ্যমে সাতটি দেশে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তথ্য পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন>> প্রত্যাহার হতে পারে প্রদীপের ‘বিপিএম-পিপিএম’
এদিকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় ওসি প্রদীপের স্ত্রী চুমকিকে ২১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি স্ত্রীর অবৈধ সম্পদ অর্জনে সহযোগিতার অপরাধে ওসি প্রদীপ কুমার দাশকেও ২০ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। ২০২২ সালের ২৭ জুলাই চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্পেশাল জজ মুন্সী আব্দুল মজিদের আদালত এ রায় দেন।
রায়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ২৬(২) ধারায় প্রদীপকে খালাস দেওয়া হলেও তার স্ত্রী চুমকি কারণকে এক বছরের কারাদণ্ড এবং এক লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ২৭(১) ধারায় দুজনকেই আট বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অন্যদিকে ক্ষমতার অপব্যবহার আইনের ৫(২) ধারায় এ দম্পতিকে দুই বছর করে কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও দুই মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। রায়ে ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং আইনে প্রদীপ ও তার স্ত্রীকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড এবং চার কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। দুই আসামিই বর্তমানে কারাগারে।
আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের ২৩ আগস্ট দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর তৎকালীন সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন বাদী হয়ে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও স্ত্রী চুমকি কারণের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় প্রদীপ ও চুমকির বিরুদ্ধে তিন কোটি ৯৫ লাখ পাঁচ হাজার ৬৩৫ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, সম্পদের তথ্য গোপন ও অর্থপাচারের অভিযোগ আনা হয়।
আরও পড়ুন>> অবৈধ সম্পদ অর্জন : ওসি প্রদীপ ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা
২০২১ সালের ২৮ জুলাই মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। ওই বছরের ১ সেপ্টেম্বর আসামি প্রদীপের উপস্থিতিতে শুনানি শেষে অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন আদালত। ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রদীপ ও চুমকি দম্পতির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। মামলার পর থেকে অভিযোগ গঠন পর্যন্ত প্রদীপ আদালতে উপস্থিত থাকলেও তার স্ত্রী পলাতক ছিলেন।
২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি চুমকির অনুপস্থিতিতে তার বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। মামলায় প্রদীপের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর উচ্চ আদালতে রিভিশন আবেদন করেন। ৪ এপ্রিল রিভিশন আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ায় ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। মামলার সাক্ষ্য নেওয়ার শেষ পর্যায়ে চুমকি কারণ আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।
এমডিআইএইচ/এএসএ/জিকেএস