প্রায় চার বছর আগে, ২০১৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশ সচিবালয়ের চারপাশ ‘নীরব এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। যানবাহনে হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ করার পর চার বছর চলে গেলেও এলাকাটিতে এখনো হর্ন বাজানো বন্ধ হয়নি। এমনকি সচিবালয়ের সামনের ফাঁকা রাস্তায়ও অকারণে প্রতিদিন অহরহ হর্ন বাজাচ্ছে অসংখ্য যানবাহন। যানবাহনের চালকদের আচরণ দেখে মনে হয়, তারা যেন ফাঁকা রাস্তায় হর্ন বাজানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছেন।
Advertisement
নিষিদ্ধ এলাকায় এভাবে প্রতিনিয়ত হর্ন বাজলেও তা দেখার যেন কেউ নেই। যানবাহানের হর্ন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতেও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। চালকরা তাদের ইচ্ছামাফিক সচিবালয়ের চারপাশের রাস্তায় যানবাহন চালাচ্ছেন। এরমধ্যে ব্যক্তিগত যানবাহন, মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে গণপরিবহনও। এমনকি অধিকাংশ পরিবহনের চালকের আচরণ এমন, তারা জানেন না এ এলাকাটিতে হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ।
রোববার (২১ মে) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তিন দফায় সচিবালয়ের চারপাশের রাস্তা সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, সবদিকেই চালকরা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে হর্ন বাজাচ্ছেন। তবে অধিকাংশ চালকই বাজাচ্ছেন প্রয়োজন ছাড়া।
আরও পড়ুন: ঢাকায় বায়ু-শব্দদূষণ রোধে অভিযানে নামছেন ২৫ ম্যাজিস্ট্রেট
Advertisement
মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার ও গণপরিবহনের ১৩ জন চালকের সঙ্গে কথা বললে মাত্র একজন জানান, তিনি জানেন এলাকাটিতে হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ। তবে অন্যরা বাজাচ্ছেন, তাই তিনিও হর্ন বাজাচ্ছেন। হর্ন বাজালে তার জন্য কেউ কোনো পদক্ষেপও নেয় না।
২০১৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশ সচিবালয়ের চারপাশ ‘নীরব এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তখন জানানো হয়, জিরো পয়েন্ট, পল্টন মোড় ও সচিবালয় লিংক রোড হয়ে জিরো পয়েন্ট এলাকায় চলাচলকারী কোনো যানবাহন হর্ন বাজাতে পারবে না। বাজালে শাস্তির মুখে পড়তে হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে প্রণীত ‘শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬’ অনুযায়ী ‘নীরব এলাকা’ বলতে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত বা একই জাতীয় অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এবং এর চারদিকে ১০০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাকে বোঝায়।
আরও পড়ুন: বাড়তি শব্দের হর্ন খুলে নিলো প্রশাসন
Advertisement
বিধিমালা (শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা) অনুযায়ী ‘নীরব জোন’ এলাকায় হর্ন বাজালে প্রথমবার সর্বোচ্চ এক মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই অপরাধ পরবর্তীসময়ে করলে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
রোববার দুপুর ১২টার দিকে জিরো পয়েন্ট মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা আকাশ পরিবহনের একটি বাস থেকে বারবার হর্ন বাজতে থাকে। হর্ন বাজানোর কারণ জানতে চাইলে পরিবহনটির চালক মো. খায়রুল বলেন, হর্ন বাজালে সিগন্যাল দ্রুত ছাড়ে, তাই হর্ন বাজাচ্ছি। রাস্তায় অনেক যানজট, এত সময় রাস্তায় আটকে থাকতে বিরক্তি লাগছে।
এ এলাকায় হর্ন বাজানো নিষেধ, এটি জানেন কি না, এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, কে বললো? প্রায় ১০ বছর গাড়ি চালাচ্ছি, এ কথা তো আগে শুনিনি। হর্ন বাজানো ছাড়া গাড়ি চালাব কীভাবে। কেউ তো কোনোদিন এসে হর্ন বাজানো যাবে না, এমন কথাও বলেনি। আর হর্ন বাজালে কেউ কিছু বলে না।
সচিবালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ফাঁকা রাস্তায় হর্ন বাজানো একটি প্রাইভেটকারের চালক মো. জামাল হোসেন বলেন, হঠাৎ যাতে কোনো গাড়ি বা ব্যক্তি গাড়ির সামনে চলে না আসে সেজন্য হর্ন বাজিয়েছি। এতে সমস্যা কী? হর্ন বাজালে রাস্তার আশপাশের সবাই সতর্ক হয়ে যাবে। তখন দুর্ঘটনা ঘটবে না।
আরও পড়ুন: শব্দদূষণের বিরুদ্ধে ‘শব্দত্রাস’ প্রচারণা দুরন্ত বাইসাইকেলের
এলাকায় হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ, এটি জানেন কি না? উত্তরে তিনি বলেন, জানি। যখন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল প্রথম কয়েকদিন বেশিরভাগই হর্ন না বাজিয়ে গাড়ি চালিয়েছে। কিন্তু অল্প কয়েক দিনের মধ্যে যা, তাই হয়ে গেছে। এখন এই রাস্তায় সবাই হর্ন বাজায়। হর্ন বাজালে কেউ কিছু বলে না। কে হর্ন বাজাচ্ছে, কে বাজাচ্ছে না, তা দেখার কেউ এখানে নেই।
সচিবালয়ের সামনে ফাঁকা রাস্তায় হর্ন বাজানো মোটরসাইকেল চালক মো. সুলাইমান বলেন, এখানে হর্ন বাজানো যাবে না, এটি আমার জানা ছিল না। সবাই হর্ন বাজাচ্ছে। আমিও বাজিয়েছি। তবে এখন থেকে চেষ্টা করবো, এ এলাকায় এলে হর্ন না বাজিয়ে মোটরসাইকেল চালানোর।
পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (যুগ্ম সচিব) কাজী আবু তাহেরের সঙ্গে জাগো নিউজের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
তিনি বলেন, বিষয়টি দেখার দায়িত্ব পরিচালক (যুগ্ম সচিব) সৈয়দা মাছুমা খানমের।
সৈয়দা মাছুমা খানমের টেলিফোন (অফিস) নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তা কেউ রিসিভ করেননি।
পরিবেশবিদ ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমাদ কামরুজ্জামান মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, ২০১৯ সালে সচিবালয়ের চারপাশ যখন নীরব এলাকা হিসেবে কার্যকর করা হয়, সে সময় আমরা একটি সার্ভে করেছিলাম। নীরব এলাকা কার্যকর করার আগের তিন দিন এবং কার্যকর করার পরের তিন দিন। তাতে আমরা দেখেছি নীরব এলাকা কার্যকর করার পর শব্দ দূষণ ১১ গুণ বেড়ে যায়।
তিনি বলেন, নীরব এলাকায় দিনে শব্দের পরিমাণ থাকবে সর্বোচ্চ ৫০ ডেসিমেল। রাতে ৪০ ডেসিমেল। কিন্তু ঢাকার চারটি এলাকা নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ২০২২ সালে এই চার এলাকায় আমরা সার্ভে করি, তাতে দেখা গেছে, চার এলাকায় শব্দের গড় ৯৭ ডেসিমেল। অর্থাৎ সহনীয় মাত্রার প্রায় দ্বিগুণ বেশি শব্দ নীরব এলাকায়।
তিনি আরও বলেন, নীরব এলাকার রাস্তা বিশেষ চিহ্নের মাধ্যমে চিহ্নিত করতে হবে। যাতে বাহির থেকে কেউ এলে বুঝতে পারে। এক্ষেত্রে নীরব এলাকার রাস্তার রং সাদা করে দেওয়া যেতে পারে।
এমএএস/এমএইচআর/এএসএম