‘আমাদের মেরো না, আমরা তোমাদের কোনো ক্ষতি করিনি। এমন অত্যাচার ভগবান সইবে না। এভাবেই আর্তনাদ ও কাকুতি-মিনতি করে বাঁচতে চেয়েছিলেন অমূল্য কুণ্ডের বৃদ্ধা মা। কিন্তু তিনি শেষ রক্ষা পাননি। ১৯৭১ সালের ১৯ মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাকে পুড়িয়ে হত্যা করে। পাশের ঝোপে প্রাণ বাঁচাতে লুকিয়ে ছিলেন অমূল্য কুণ্ড। মায়ের বাঁচার আর্তনাদ শুনে ঝোপের ভেতর থেকে বেড়িয়ে এসেছিলেন তিনিও। এরপর অমূল্য কুণ্ডের আর কোনো খোঁজ কেউ পাননি। হয়তো সেইদিন হানাদার বাহিনী তাকেও পুড়িয়ে মেরেছে। এমনভাবেই লোমহর্ষক ঘটনার স্মৃতিচারণ করেন সেদিন প্রাণে বেঁচে যাওয়া প্রতিবেশী সচিন বারিকদার (৮০)।
Advertisement
সচিন বারিকদার বলেন, এ পর ঘটে আরেক মর্মস্পর্শী ঘটনা। চারদিকে শুধু হানাদার বাহিনীর গুলিতে নিহত মানুষের লাশ আর লাশ পড়ে আছে। ঘটনার সময়ে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া চার মাসের শিশু প্রভাষের রক্তাক্ত উঠোনে হামাগুড়ি দিয়ে নিহত মায়ের বুকের দুধ খাওয়ার ঘটনা আজও সেনদিয়ার মানুষের মুখে মুখে।
১৯৭১ সালের ১৯ মে এমন অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের সেনদিয়া, পলিতা, ছাতিয়ানবাড়ী ও খালিয়া গ্রামের বাসিন্দারা। সেদিন প্রায় দেড়শ মুক্তিকামী মানুষ প্রাণ রক্ষায় আশপাশের আখক্ষেত, ঝোপঝাড় ও জঙ্গলে আশ্রয় নেন। কিন্তু হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী ১২৭ জন মুক্তিকামী বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
এ ব্যাপারে একাধিক মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে— স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনী মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার টেকেরহাট বন্দরে ক্যাম্প স্থাপন করেছিলেন। সে সময় রাজৈর অঞ্চলে যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ছিল নৌপথ। হানাদার বাহিনী লঞ্চে গোপালগঞ্জ জেলার ভেন্নাবাড়ী ঘাটে নেমে চরমাচটা নামক এলাকা থেকে গুলি বর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে। এরপর তারা কৌশলে রাজৈরের সেনদিয়া গ্রামে ঢুকে পড়ে। তখন সেনদিয়া, পলিতা, ছাতিয়ানবাড়ী ও খালিয়া গ্রামের শিশু থেকে বৃদ্ধরা বাঁচার জন্য ছুটোছুটি করতে থাকেন। অনেকেই জীবন বাঁচানোর জন্য পশ্চিম সেনদিয়া গ্রামের একটি আখক্ষেতে আশ্রয় নেন। ততক্ষণে হানাদার বাহিনী অসংখ্য নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধকে নির্বিচারে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পশ্চিম সেনদিয়া ফকিরবাড়ির ভিটায়, সেনদিয়া বাওয়ালী ভিটায়, বারিকদার বাড়ির উত্তর বাঁশ বাগানে, সচীন বারিকদারের বাড়ির দক্ষিণ খালপাড় এবং ছাতিয়ানবাড়ির পুকুর পাড়ে। কারও চোখ বেঁধে, হাত-পা বেঁধে, বাবা-মায়ের সামনে সন্তানকে, সন্তানের সামনে বাবা-মাকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। আবার কাউকে পুড়িয়ে হত্যা করে।
Advertisement
দীর্ঘসময় এ নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে পশ্চিম সেনদিয়া গ্রাম দিয়ে যেতেই আখক্ষেতে মানুষের শব্দ পেয়ে ব্রাশফায়ার করে। নিমেষেই প্রাণ হারায় শতাধিক মানুষ।
মুক্তিযোদ্ধারা আরও জানান, মুক্তিযুদ্ধ শেষে গোপালগঞ্জ জেলার বানিয়ারচরের মিশনারি ফাদার মারিনো রিগন বেঁচে যাওয়া চার মাসের শিশু প্রভাষকে লালন-পালনের দায়িত্ব নেন। পরবর্তী সময়ে ফাদার মারিনো রিগনের সঙ্গে প্রভাষ আমেরিকা চলে যান। বর্তমানে তিনি আমেরিকার প্রবাসী এবং মোশী বাড়ৈ নামে পরিচিত।
বীর মুক্তিযোদ্ধা খলিলুর রহমান খান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় মাদারীপুরের সেনদিয়ার গণহত্যার কথা জেলার মানুষ আজও ভোলেনি। তবে, এ গণহত্যার ঘটনা তেমন প্রচার হয়নি। তাই নতুন প্রজন্মের অনেকেই তা জানেন না। তবে নতুন প্রজন্মের কাছে এ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরতে হবে।
মাদারীপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ইউনিট কমান্ডের সাবেক ইউনিট কমান্ডার মো. শাহজাহান হাওলাদার বলেন, হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে খালিয়ার সেনদিয়া, পলিতা, ছাতিয়ানবাড়ী ও খালিয়া গ্রামের প্রায় দেড় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। হত্যার পর লাশগুলো ৬টি স্থানে গণকবর দিয়ে রাখা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার এবং মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের পক্ষ থেকে গণকবরগুলো চিহ্নিত করে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সাবেক নৌ পরিবহন মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা শাজাহান খান ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় স্মৃতিসৌধ নির্মিত হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসী খুশি। তবে, দিবসটি সরকারিভাবে পালনের জন্য মাদারীপুরবাসী ও মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হবে।
Advertisement
সেদিন সেনদিয়ায় হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে যারা প্রাণ হারান তারা হলেন— শহীদ পরান শিকারী, পুলিন শিকারী, সুধন্বী শিকারী, বড়বুড়ি শিকারী, বিনোদিনী শিকারী, প্রথমা শিকারী, সুবাশী বেপারী, কুমদী বেপারী, এলোকেশী কুন্ডু, সুমিত্রা বৈরাগী, শোভারানী বৈরাগী, মালতী বৈরাগী, তরঙ্গী বৈরাগী, সুলতা বৈরাগী, ফেলু সরদার, প্রশান্ত সরদার, প্রসেন সরদার, বিরেন বাড়ৈ, মনিমালা বাড়ৈ, দিপালী বাড়ৈ, ঘ্রান্তি রানী মন্ডল, বেনী মাধবী মন্ডল, যশোদা মন্ডল, জ্ঞানদা মন্ডল, ব্রজবাসী মন্ডল, মৌরী রানী মন্ডল, বিমল বাওয়ালী, ঘাঘরী বাওয়ালী, রাইসোনা মোহন্ত, ঘাঘরী মজুমদার, পার্শ্বনাথ বারিকদার, গৌরী বারিকদার, কুসুম রানী বারিকদার, মধুমালা বারিকদার, আলোমতি বারিকদার, ধন্যচন্দ্র বারিকদার, যতীন বারিকদার, আন্না রানী বারিকদার, আয়না রানী বারিকদার, ময়না রানী বারিকদার, সাধন বারিকদার, ভগবতী বারিকদার, পূজা রানী বারিকদার, পুষ্প রানী বারিকদার, রতিকান্ড বারিকদার, জিতেন বারিকদার, লক্ষ্মী-রানী বারিকদার, মালতী বারিকদার, সুশীল বারিকদার, শান্তিলতা বারিকদার, সুলতা রানী বারিকদার, জ্ঞানদা বারিকদার, লেবু বারিকদার, শান্তিলতা বারিকদার, মালতী বারিকদার, সুমল বারিকদার, মনিন্দ্র নাথ বারিকদার, দুখীরাম বারিকদার, মালতী বারিকদার, দোলা বারিকদার, মাধবী বারিকদার, মধুমালা বারিকদার, নেমু মল্লিক, মালতি মল্লিক, সুমী মল্লিক, পাঁচি মল্লিক, বিরাট মল্লিক, সাধু মল্লিক, কুটি মল্লিক, অনি মল্লিক, কুরি মল্লিক, সরস্বতী মল্লিক, মধুমালা মল্লিক, ভুবন মল্লিক, ক্ষ্যান্ত মল্লিক, সূর্যকান্ত মল্লিক, কুটিবুড়ি মল্লিক, সুধা কীর্তনিয়া, রাজু বাড়ৈ, মাখন বাড়ৈ, রসিক বাড়ৈ, সৌদা বাড়ৈ, মনিমালা বাড়ৈ, মঙ্গল বাড়ৈ, সুমতী বাড়ৈ, জৈলাশ গোলদার, কোকরা গোলদার, সুরেন বৈরাগী, চিত্ত বৈরাগী, কমলা মন্ডল, জগতীশ বারুবী, গোপাল বারুবী, ঐমুনা বালা, যামিনী বারুবী, মৃতঞ্জয় রায়, রাজ্যেম্বর রায়, মইফুল রায়, জগবন্ধু বালা, পাচু বালা, রঞ্জন বালা, ফুলমালা বালা, ঘ্রান্ত বেপারী, পরিমল বেপারী, আনন্দ বেপারী, নারায়ন বেপারী, বিজয় বাড়ৈ, চন্ডীচরণ বালা, কেনারাম মন্ডল, মহানন্দ সরকার।
আয়শা সিদ্দিকা আকাশী/এমএএইচ/জিকেএস