ফিচার

ডাইনোসর যুগের প্রাণী তুয়াতারা

শেখ আনোয়ার

Advertisement

জুরাসিক যুগের প্রাণী ডাইনোসর। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক কল্পগল্প, বিজ্ঞানকথা প্রচলিত আছে। আছে কল্পবিজ্ঞান কাহিনি ও সিনেমা। দুর্দান্ত প্রতাপ নিয়ে সৃষ্টির ঊষালগ্নে এসব বৃহদাকার জীব রাজত্ব করতো বিশ্বজুড়ে। বাস্তবে আমরা ডাইনোসর দেখিনি। কেবল নৃতাত্ত্বিক গবেষণা আর ডাইনোসরের ফসিল থেকে পাওয়া যায় অনেক তথ্য। সত্যি-সত্যি ডাইনোসরকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ না পেলেও বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন ডাইনোসর যুগের এক অদ্ভুত জীব। নাম ‘তুয়াতারা’। তুয়াতারা নামটি নিউজিল্যান্ডের মাউরি উপজাতি ভাষা থেকে নেওয়া। যার মানে হলো ‘পিঠে কাঁটা’। বিজ্ঞানীদের ধারণা, দুশ মিলিয়ন বছরের পুরোনো সরীসৃপ পরিবারের শেষ জীবিত সদস্য এই তুয়াতারা। প্রায় ষাট মিলিয়ন বছর আগে ডাইনোসরসহ পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশ জীবনকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার বিপর্যয় থেকে বেঁচে যাওয়া একমাত্র প্রাণী এই তুয়াতারা। পৃথিবীর প্রাথমিক লগ্নে যেসব জীব-জন্তু ছিল, তার মধ্যে শুধু তুয়াতারাই এখন পর্যন্ত বেঁচে আছে। চার বাহু বিশিষ্ট প্রাণীটির আবাসস্থল বলা চলে এখন নর্থ আয়ারল্যান্ডের মাত্র ৩০টি প্রত্যন্ত দ্বীপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

খুব ধীরগতিতে চলাফেরা করে তুয়াতারা। তুয়াতারার মেরুদণ্ড মাছের মেরুদণ্ডের মতো। ফুসফুস হচ্ছে ব্যাঙের ফুসফুসের মতো। বিস্ময়কর ও রহস্যময় ব্যাপার হচ্ছে, তুয়াতারাই একমাত্র প্রাণী, যার মাথার ওপর রয়েছে তৃতীয় চোখ। গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন, এ চোখের আছে আলাদা লেন্স এবং পেরিয়্যাটাল প্লাগ। যা কর্নিয়া হিসেবে কাজ করে থাকে। স্নায়ুতন্ত্রের সঙ্গে মস্তিষ্কের সংযোগে সার্বক্ষণিক আধুনিক লাইভ ক্যামেরার মতো কাজ করে থাকে তৃতীয় এ চোখ। সাধারণত ছয় মাস বয়সী বাচ্চা তুয়াতারাদের এ তৃতীয় চোখ দেখা গেলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তুয়াতারার খুলিতে গঁজানো অসংখ্য কাঁটার মধ্যে উধাও হয়ে যায় এ তৃতীয় চোখ। তৃতীয় চোখটি তখন আর সহজে কারো চোখে পড়ে না। মাথার উপরে চামড়ায় ঢাকা পড়ে যায় চোখটি।

২২০ মিলিয়ন বছরের বিবর্তনে সামান্য কিছু পরিবর্তন হয়েছে এ দীর্ঘজীবী প্রাণীর। আকল্যান্ড ওয়ার মেমোরিয়াল মিউজিয়ামের কিউরেটর ব্রায়ান গিলের মতে, ‘তুয়াতারা একটি জীবন্ত ফসিল।’ নিউজিল্যান্ড ডিপার্টমেন্ট অব কনজারভেশনের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতিবছর এর সংখ্যা কমছে, ধীর প্রজননগত কারণে এই ক্রমহ্রাস বন্ধ করাও প্রায় দুঃসাধ্য। তুয়াতারা সাধারণত রাতে বের হয় এবং দিনে শিকড়ের আড়ালে কিংবা গর্তের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। এরা শিকারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। যা কিছুটা ব্যাঙের শিকার ধরার মতো। তুয়াতারার ফুসফুস উভচর প্রাণীর ফুসফুসের মতো এবং অক্সিজেন-ধারণ ক্ষমতা অপর্যাপ্ত, যার কারণে দৌঁড়-ঝাপ দিয়ে এর পক্ষে শিকার ধরা সম্ভব নয়। তুয়াতারার দৈহিক আকৃতিটাও অদ্ভুত, মাথাটা কিছুটা গুইসাপের মাথার মতো ঢেলা সদৃশ ত্রিকোণাকার। বাদামি বর্ণের চামড়া গলার কাছে ঝুলে পড়ে ভাঁজ ও ভাগের সৃষ্টি করেছে। আর মাঝে-মাঝে আছে সাদা দাগ। তুয়াতারার লেজটা বেশ অদ্ভুত। গোড়ার দিক থেকে শেষভাগের দিকে ক্রমশ সরল এবং বেশ শক্ত। উপরের দিকে আছে এক সারি কাঁটার মতো। এই কাঁটা পিঠজুড়ে প্রায় ঘাড় পর্যন্ত বিস্তৃত। স্ত্রী তুয়াতারার পিঠের কাটাগুলো পুরুষ তুয়াতারার চেয়ে আরও বড় হয়।

Advertisement

আরও পড়ুন: সাপের রাজা টাইটানোবোয়া 

দেড়শ বছর বয়সী তুয়াতারা দেখতে একই রকম থাকে। এরা খুব একটা বড় হয় না। একটি চল্লিশ বছরের তুয়াতারার ওজন প্রায় সাড়ে চারশ গ্রাম। এদের ওজন সাধারণত এক কেজি সর্বোচ্চ। অথবা এর থেকে কিছুটা বেশি হতে পারে। তবে একটি তুয়াতারার জীবনকাল দেড়শ বছরেরও বেশি হতে পারে। মাছের মতো এরা শীতল রক্তবিশিষ্ট এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে-সাথে এদের বিপাকক্রিয়ার মাত্রা বৃদ্ধি পায়। পনেরো ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায়ও তুয়াতারা স্বাচ্ছন্দে থাকতে পারে। এদের চামড়া হয়ে থাকে খুব নরম এবং একটি থলথলে ভাব বিদ্যমান।

স্ত্রী তুয়াতারা চার বছর পরপর বাচ্চা দেয়। এ ক্ষেত্রে স্ত্রী ও পুরুষ তুয়াতারা মিলনের ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত রোমাঞ্চকর। প্রজননক্ষম পুরুষ তুয়াতারা গর্ত থেকে বের হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। স্ত্রী তুয়াতারা কাছাকাছি এলে স্ত্রী তুয়াতারাকে ঘিরে পুরুষটি চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে পাক খায়। এতে স্ত্রীটি মোহ-মায়ায় আকৃষ্ট হলে দুটোর মধ্যে মিলন আকাঙ্ক্ষা হয়। তারপর মিলন সম্পন্ন হয়। এর প্রায় সাত মাস পরে সূর্যালোকিত কোনো স্থানে স্ত্রীটি একেবারে ছয় থেকে দশটি ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার এগারো থেকে ষোলো মাসের মাথায় ডিম থেকে বাচ্চা বেরিয়ে আসে। তুয়াতারার বড় শত্রু হচ্ছে ইঁদুর। ইঁদুরেরা এদের ডিম নষ্ট করে ফেলে। ওয়েলিংটন ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটির ড. ডঘার্টি প্রায় এক দশক ধরে তুয়াতারার ডিম থেকে বাচ্চা ফোঁটানোর গবেষণার কাজ করছেন। ধীরগতিতে প্রজননক্ষম প্রজাতিটিকে টিকিয়ে রাখাই তার কাজের উদ্দেশ্য।

এ কাজের জন্য তিনি চারটি দ্বীপকে নির্ধারণ করেছেন। এসব দ্বীপে তুয়াতারা প্রায় ধ্বংসের মুখে। চারটি দ্বীপ থেকে কিছু তুয়াতারা ধরে এনে এদের অকল্যান্ড এবং হ্যামিলটন চিড়িয়াখানায় প্রজনন ঘটানো হচ্ছে। ডিম থেকে বাচ্চা ফোঁটাতে গিয়ে দেখা দিচ্ছে আরেক বিপত্তি। এক-এক ডিমের জন্য ভিন্ন-ভিন্ন তাপমাত্রার প্রয়োজন হচ্ছে। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, আঠেরো থেকে বাইশ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যেই অধিকাংশ ডিম থেকে বাচ্চা ফুঁটে থাকে। গবেষকরা চান, অধিকহারে স্ত্রী তুয়াতারা সংগ্রহ করতে। যাতে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীটির প্রজনন গতিকে দ্রুততর করা যায়।

Advertisement

আরও পড়ুন: ডাইনোসরের অস্তিত্ব থাকলে পৃথিবী কেমন হতো? 

গত শতক পর্যন্তও বিজ্ঞানীদের মাঝে তুয়াতারা সম্পর্কে একটি বিভ্রান্তি ছিল। অনেক গবেষক, বিজ্ঞানীর ধারণা ছিল, তুয়াতারা আসলে গুঁই সাপেরই একটি প্রজাতি মাত্র। ১৮৬৭ সালের আগ পর্যন্ত প্রায় সব বিজ্ঞানী গবেষক তা-ই মনে করতেন। ভুলটা ভেঙে দেন লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামের কিউরেটর গবেষক, বিজ্ঞানী ড. আলবার্ট কার্ল লুডউইগ গুনথার। গুনথার একে দীর্ঘদিনের লুপ্ত ‘রাইনকোসেফালিয়া’ সরীসৃপের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ১৯৮৯ সালে ড. গুনথার তুয়াতারার দুটো প্রজাতি আবিষ্কার করেন। তার মতে, ডাইনোসর যুগে তুয়াতারারা ছড়িয়ে ছিল সারা পৃথিবীতে। প্রায় আশি মিলিয়ন বছর পূর্বে নিউজিল্যান্ড দক্ষিণ গোলার্ধের ভূখণ্ড থেকে পৃথক হয়ে পড়ে। তখন থেকেই ‘তুয়াতারা’ নিউজিল্যান্ডে বন্দি হয়ে যায়। নিউজিল্যান্ডে তুয়াতারাদের মূল বিলুপ্তটি শুরু হয় মূলত একশ বছর আগে।

পলিশিয়ানরা যখন নিউজিল্যান্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন; তখন সেখানে ব্যাপক কৃষিকাজ শুরু হয়। সঙ্গে উৎপাত বাড়ে ইঁদুর ও কুকুরের। ফলে তুয়াতারা তাদের অস্তিত্ব হারাতে শুরু করে। ডাইনোসর যুগের এই অদ্ভুত জীবটির অস্তিত্ব রক্ষার্থে সম্প্রতি উদ্যোগী হয়েছে বন্য জন্তু সংরক্ষণ বিভাগ। ১৯৯০ সাল থেকে এ বিভাগ কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে জীবটির দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। এদের জন্য কিছু ‘অভয়দ্বীপ’ নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে এগুলো নির্বিঘ্নে বসবাস করতে পারবে। নিউজিল্যান্ডের মুদ্রার গায়ে, টেলিফোন, বিভিন্ন কার্ডে, বইয়ের প্রচ্ছদে এখনো শোভা পায় তুয়াতারার ছবি।

তুয়াতারার বড় ভদ্র প্রকৃতিপ্রেমিক বিজ্ঞানী হ্যাজলি গড়ে তুলেছেন ‘তুয়াতারিয়াম’ গ্যালারি। হ্যাজলি সাতাশ বছর আগে তুয়াতারা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এজন্য তিনি তৈরি করেছেন স্বচ্ছ কাঁচ-নির্মিত ‘তুয়াতারিয়াম’। তুয়াতারা এখানে প্রাকৃতিক অবস্থার সবটুকু সুবিধাই ভোগ করছে। তার সংরক্ষণে আছে বিভিন্ন নামে অভিহিত তুয়াতারা। তেমনি একটি তুয়াতারার নাম হেনরি, বয়স প্রায় একশ এগারো বছর। একশ এগারো বছর পর এটি সন্তানের পিতা হয়েছে। হ্যাজলি তার নিত্যদিনের বন্ধুদের মতোই ভালোবাসেন জীবগুলোকে।

আরও পড়ুন: মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য জানলে চমকে উঠবেন! 

সৃষ্টির শুরু থেকে নীরব সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছে তুয়াতারা। বিশ্বের সব জীবের সঙ্গে হাজারো বছর ধরে বেঁচে থাকুক তুয়াতারার প্রজন্ম। তা না হলে ভবিষ্যতে ডাইনোসরের মতো তুয়াতারাও আগামী প্রজন্মের মানুষের কাছে অবিশ্বাস্য এক প্রচলিত কাহিনি হয়ে থাকবে।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক, গবেষক ও এমফিল স্কলার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এসইউ/জিকেএস