দেশজুড়ে

সকাল ১০টার আগে খোলে না হাসপাতালের বহির্বিভাগ

সকাল ঠিক ৯টা বাজে। হাসপাতালের বহির্বিভাগের সব চিকিৎসকের রুমে ঝুলছে তালা। এক নারী পরিচ্ছতাকর্মী মাত্র ঝাড়ু দেওয়ার কাজ শুরু করেছেন। বেশ কয়েকজন নারী রোগী চিকিৎসকের জন্য অপেক্ষা করছেন।

Advertisement

সোমবার (৮ মে) সকাল ৯টায় ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়। তবে, ওই সময় জরুরি বিভাগ খোলা ছিল। তখন রোগীদের চিকিৎসা দিতেও দেখা গেছে।

এদিকে, সঠিক সময়েই হাসপাতালে উপস্থিত হয়েছেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মুনীর আহমেদ।

সকাল সাড়ে ৮টার দিকে হাসপাতালে সব চিকিৎসক, কর্মকর্তা, কর্মচারী উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও সকাল ৯টার দিকে হাসপাতালের বহির্বিভাগের চিকিৎসকের রুমে তালা ঝোলার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, সকাল ৯টায় তো রোগী আসে না। তাই সকাল ১০টা থেকে বহির্বিভাগে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হয়।

Advertisement

তবে, সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বেশ কয়েকজন নারী রোগীকে বহির্বিভাগে চিকিৎসকের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।

হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, পুরুষ ওয়ার্ডের সংস্কার কাজ চলায় বারান্দায় বেড এনে চিকিৎসা কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে। তখন হাসপাতালের এক নারী চিকিৎসক রোগী দেখছিলেন।

পুরুষ ওয়ার্ড ঢুকতেই কয়েকজন রোগী ও তাদের স্বজনরা অভিযোগ করেন, হাসপাতালে নিয়মিত ছোট এক টুকরা পাঙাশ মাছ ও ডাল খেতে দেওয়া হয়। যে পরিমাণ ভাত দেওয়া হয়, তাতে পেট ভরে না। আবার ভাত চাইলে বাজে আচরণ করা হয়। কিছু ওষুধ হাসপাতাল থেকে দিলেও বেশির ভাগ বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়।

মহিলা ওয়ার্ডে জ্বর ও পেটের অসুখ নিয়ে ভর্তি আছেন উপজেলার গাবরাখালী ইউনিয়নের নূরজাহান বেগম। তিনি বলেন, ডাক্তার আসেন, রোগীও দেখেন। তবে ওষুধ নামমাত্র হাসপাতাল থেকে দিলেও বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়।

Advertisement

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুরুষ রোগী অভিযোগ করে বলেন, আমি প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে ভর্তি আছি। ১৫ দিনই দুইবেলা পাঙাশ মাছ ও ডাল খেতে দিয়েছে। মাছ ও ডাল খেতে দিলেও রেজিস্টার খাতায় লিখে রাখে মাংস। আমার মনে হয় বছরেও একদিন মাংস খেতে দেয় না রোগীদের।

হাসপাতালের পুরুষ ওয়ার্ডে ভর্তি শফিকুল ইসলাম। তিনি হাতে প্লেট নিয়ে ছুটছেন। তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাচ্ছেন, জানতে চাইলে বলেন, সকালের নাশতায় একটি ডিম ও রুটি দিয়েছিল। ডিম ভেঙে দেখি পচা। তাই পাল্টে আনতে যাচ্ছি। পাল্টে না দিলে সকালের নাশতা না খেয়েই থাকতে হবে।

হাসপাতালের বহির্বিভাগের দোতলায় অপারেশন থিয়েটার। স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মুনীর আহমেদের নির্দেশে একজন চিকিৎসক এই প্রতিবেদককে অপারেশন থিয়েটার দেখাতে নিয়ে যান। দোতলায় উঠতেই দেখা যায়, ফ্লোরে পড়ে আছে নোংরা বেডশিট। তিনতলায় ওঠার সিঁড়িতে কাঠের টুকরা, হাসপাতালের পরিত্যক্ত জিনিসপত্র পড়ে আছে। ঠিক অপারেশন থিয়েটারের দরজার সামনেই বিভিন্ন প্যাকেটের স্তূপ।

এদিকে, হাসপাতালের এক্সরে রুমে গিয়ে তালা ঝুলতে দেখা যায়। এই তালা ঝুলছে ২০০৫ সাল থেকে। আবার আলট্রাসনোগ্রাফি রুমও বন্ধ দেখা যায়। সেটিও অকেজো হয়ে পড়ে আছে দেড় বছর। এক্সরে রুমে ঢুকলে মনে হবে এটি পরীক্ষাগার নয় যেন স্টোর রুম।

কাজ শেষ করে বের হতেই ফোন করে বিভিন্ন অনিয়মের কথা জানান হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারী। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, হাসপাতালের নার্সিং ইনচার্জ জেসমিন মান্দা নিজের প্রভাব খাটিয়ে বাইরে থেকে ভাড়াটে আয়া এনে ডেলিভারির কাজ করিয়ে চার থেকে পাঁচ হাজার করে টাকা নেন। ওই টাকা থেকে জেসমিন মান্দা নিজেও ভাগ নেন। অভিযোগকারী কর্মচারী এসবের প্রতিবাদ করায় তাকে মারধর করার হুমকিও দেন।

সম্প্রতি ওই হাসপাতালে হালুয়াঘাট পৌর শহরের পাগলপাড়া এলাকার লাইলী বেগম নামে এক নারী তার ভাগনির ডেলিভারি করাতে আসেন। ডেলিভারি করার পর বকশিস চান সামলা নামের এক আয়া। পরে তিনি ৯০০ টাকা বকশিস দেওয়ায় বাজে আচরণ করেন এবং বলেন, ‘অন্য হাসপাতালে তো ঠিকই ২০ হাজার টাকায় ডেলিভারি করাতেন। এখানে আসলেই আপনাদের টাকা থাকে না।’ পরে ওই ৯০০ টাকা ফেরত দেন ওই আয়া।

ওই হাসপাতালের খাবারের ঠিকাদার স্থানীয় পৌরসভার কাউন্সিলর কবিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) যা চাহিদা দেন, আমি সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা করি। পরে তারা রান্না করে রোগীদের মাঝে বিতরণ করেন।

হাসপাতালের স্টোর ইনচার্চ মাহবুব আলম বলেন, হাসপাতালের এক্সরে মেশিন ২০০৫ সাল থেকে অকেজো। ডিজিটাল এক্সরে মেশিনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। তবে, এখনো আসেনি। আলট্রাসনোগ্রাফি মেশিনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আলট্রাসনোগ্রাফি মেশিনটাও দেড় বছর ধরে অকেজো হয়ে পড়ে আছে।

হাসপাতালের নার্সিং ইনচার্জ জেসমিন মান্দা বলেন, আগের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা অবৈতনিক একজন আয়া নিয়োগ দিয়েছিলেন। তিনি এখনো আছেন। আমরা নিজের বেতন ও বকশিসের টাকায় তার বেতন দেওয়া হয়। তবে, নরমাল ডেলিভারি করে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।

হালুয়াঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মুনীর আহমেদ বলেন, সকাল সাড়ে ৮টা থেকে অফিস টাইম হলেও রোগী না আসায় ১০টা থেকে চিকিৎসা কার্যক্রম চালু হয়। আমি এখানে যোগদান করেছি তিন বছর। আমি আসার আগে থেকেই এক্সরে মেশিন নষ্ট। এক্সরে মেশিনের চাহিদা পাঠানো হয়েছে।

অবৈতনিক আয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা একজন আয়া নিয়োগ দিয়েছিলেন। হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে আয় করা টাকা ও নরমাল ডেলিভারিতে রোগীর বকশিসের টাকায় তার বেতন দেওয়া হয়।

জেলা সিভিল সার্জন ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ওই হাসপাতালের এক্সরে মেশিনের চাহিদা পাঠানো হয়েছে। অল্প কিছুদিনের মাঝেই চলে আসবে। হাসপাতালের ডেলিভারি রোগীদের বকশিসের টাকায় আয়ার বেতন দেওয়ার বিষয়টি জানা নেই। খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এছাড়া সকাল ১০টা থেকে রোগী দেখার বিষয়টি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানান সিভিল সার্জন।

এমআরআর/জিকেএস