দেশজুড়ে

মোখা রেখে গেছে ক্ষত, দুর্ভোগে কয়েক হাজার মানুষ

অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখার তাণ্ডবে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে দুই হাজারের বেশি ঘরবাড়ি, দোকানপাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে এক হাজার ২০০টির বেশি স্থাপনা। দ্বীপের মাঝেরপাড়া, কোনারপাড়া, গলাচিপা, দক্ষিণপাড়া, পশ্চিমপাড়া, উত্তরপাড়ার বেশিরভাগ কাঁচা ঘরবাড়ি মিশে গেছে মাটির সঙ্গে।

Advertisement

একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপের তিনটি ওয়ার্ডের প্রায় দুই হাজার বাড়িঘর। সবাই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালালেও চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে দুই ইউনিয়নের কয়েক হাজার মানুষকে।

একেবারে নিশ্চিহ্ন হওয়া বাড়ির লোকজনের কেউ কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে এবং অনেকে আত্মীয়-স্বজনের বাসায় আশ্রয় নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। এসব মানুষের জন্য খুব শিগগির সহযোগিতা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন তারা।

ঘূর্ণিঝড়ে সেন্টমার্টিন, টেকনাফ সদর, পৌর এলাকা, সাবরাং, ডেইলপাড়া, জাদিমুড়া, কোনারপাড়া ও গলাচিপা, বাহারছরা, হোয়াইক্যং, শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় প্রচুর গাছপালা এবং ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। উড়ে গেছে ঘরের চাল। ঝড় থামার পর এসব এলাকার মানুষ সড়ক থেকে গাছ সরিয়ে নিজেদের মাথা গোঁজার ঠাঁই ঠিক করার চেষ্টা করতে দেখা যায় সোমবার (১৫ মে) সকাল থেকে।

Advertisement

সেন্টমার্টিন দ্বীপের পশ্চিম তীরের বাসিন্দা কবির আহমদ বলেন, ‘ঝড়ে বাড়ির টিনের চাল উড়ে গেছে। বেড়া পড়ে গেছে। বৃষ্টির পানিতে রান্নাঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই চুলা জ্বলেনি। চাল-ডাল-তরকারি কিনতে পারলেও রান্না নিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।’

উত্তরপাড়ার হালিমা খাতুন, জালাল উদ্দিন, আলী আহমদের ঘরও ভেঙে গেছে। রোববার (১৪ মে) ঘূর্ণিঝড় মোখায় ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত জারি করা হলে পরিবার নিয়ে তারা পাশের আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেন। ঘূর্ণিঝড় কেটে যাওয়ার পর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখেন, মাটির সঙ্গে মিশে গেছে তাদের তাদের কাঁচা ঘরগুলো।

প্রায় আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনে দুপুর ২টা থেকে বিকেল সোয়া ৫টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টার তাণ্ডবে চরম ক্ষতি হয়েছে। কাঁচা ও টিনের আধাপাকা ঘরবাড়ি ভাঙার পাশাপাশি উপড়ে গেছে পাঁচ শতাধিক নারিকেলগাছসহ অন্তত কয়েক হাজার গাছগাছালি। ঝড়ে আহত হয়েছেন অন্তত ১০-১২ জন। জলোচ্ছ্বাসে দ্বীপটির উত্তরপাড়া, পশ্চিমপাড়া ও পূর্ব দিকের কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় শুরুর আগে দ্বীপের তিনটি সাইক্লোন শেল্টার, চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ৩৭টি হোটেল-রিসোর্ট-কটেজে স্থানীয় প্রায় সাত হাজার বাসিন্দাকে সরিয়ে আনা হয়েছিল। যাদের বেশিরভাগই শিশু ও নারী। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব থামার পর অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে বাড়িতে ফিরে যান। তবে, ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িগুলোর সদস্যরা স্বজনদের কাছে বা আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন।

Advertisement

৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার নাজির হোসেন বলেন, ‘বৃষ্টি হওয়ায় গৃহহীন পরিবারে দুর্ভোগ নেমে আসছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় কয়েক হাজার মানুষকে রাখা গেলেও সেখানে রান্নাবান্না, গোসল, টয়লেটের ব্যবস্থা নাজুক। গৃহহীন পরিবারে রান্না করা খাবার সরবরাহ করার মতো এনজিও বা সংস্থা সেখানে নেই।’

মোখার তাণ্ডবকে ১৯৯১ সালের ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে শক্তিশালী দাবি করে সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, মোখা যখন দ্বীপ অতিক্রম করছিল, তখন সাগরে ভাটা ছিল। মরা কাটাল থাকায় জোয়ারের উচ্চতাও কম ছিল। ভরা কাটাল আর জোয়ার থাকলে ১৮০ থেকে ১৯০ কিলোমিটার গতির মোখা ভিন্ন এক পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারতো।

চেয়ারম্যান মুজিব বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার সম্ভাব্য ভয়াবহতা নিয়ে শুরু থেকে প্রচারণা চালানোয় দ্বীপের বাসিন্দারা আতঙ্কে ছিলেন। ব্যাপক প্রচারণার ফলে দ্বীপের প্রায় সাত হাজার বাসিন্দা আগেভাগে আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠেন। গত কয়েক দশকের একাধিক ঘূর্ণিঝড়ে এত মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠতে দেখিনি। আগেই নিরাপদে থাকায় তাণ্ডবে কারও প্রাণহানি ঘটেনি।

তিনি বলেন, মোখার তাণ্ডবে দ্বীপের দুই হাজারের বেশি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় ৭০০ কাঁচা ঘরবাড়ি মাটিতে মিশে গেছে। হাজারও মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে ত্রাণসহায়তা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

সাবরাং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুর হোসেন বলেন, আমার ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপের তিনটি ওয়ার্ডের প্রায় দুই হাজার বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকে মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে চরম অসহায় জীবন কাটাচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি হচ্ছে।

জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, জেলার ৫৭টি ইউনিয়ন ও তিনটি পৌরসভা দুর্যোগকবলিত হয়েছে। এসব এলাকার ১০ হাজার ৬৬৯ ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতি হয়েছে। পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুই হাজার ২২টি ঘর। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেন্টমার্টিন ও শাহপরীর দ্বীপ। এ দুই দ্বীপের প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তিনি বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রে শুকনা ও রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় সতর্কতা সংকেত তুলে নেওয়ার পর লোকজন বাড়ি ফিরেছেন। ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্তদের আশ্রয়কেন্দ্রে রেখে ঘর মেরামতের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এসআর/জেআইএম