দেশজুড়ে

১৬ বছরে এবারই প্রথম, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়েনি সাতক্ষীরায়

প্রায় প্রতিবছরই বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে দেশের উপকূলে। বিশেষ করে সাতক্ষীরা উপকূলে বিগত প্রায় সব ঘূর্ণিঝড়েই কমবেশি প্রভাব পড়েছে। তবে ঘূণির্ঝড় মোখা উপকূল অতিক্রম করার সময় এর কোনো প্রভাব পড়েনি সাতক্ষীরা উপকূলে।

Advertisement

আগের ঘূর্ণিঝড়গুলোর কোনোটি সরাসরি আঘাত হেনেছে সাতক্ষীরায়। প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যেগুলো সরাসরি আঘাত করেনি তার প্রভাবে ঝোড়ো হাওয়া, বৃষ্টি কিংবা বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয় প্লাবিত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু গত ১৬ বছরের মধ্যে এবারই প্রথমবার তার ব্যতিক্রম হলো। অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখার কোনো প্রভাবই পড়েনি সাতক্ষীরায়। ঝোড়ো বাতাস, বৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস বা জোয়ারের পানি বৃদ্ধির কোনোটিই না হওয়ায় স্বস্তিতে ছিলেন মানুষ।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে আঘাত হানলে বাংলাদেশ সীমান্তের উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায়ও তার কমবেশি প্রভাব পড়ে। আবার আম্পান, ফণী, বুলবুলসহ একাধিক ঝড় সরাসরি আঘাত হেনেছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বরাবর। ফলে সাতক্ষীরা-খুলনাসহ উপকূলীয় এলাকায় কমবেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিশেষ করে ঝড়েে প্রভাবে নদ-নদীর পানি বাড়ার কারণে বেড়িবাঁধ ভেঙে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। কিন্তু এবার ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।

রোববার (১৪ মে) সাতক্ষীরায় তেমন কোনো ঝোড়ো বাতাস হয়নি। সকালের দিকে আকাশ কিছুটা মেঘলা থাকলেও হয়নি বৃষ্টি। মোখার প্রভাবে জেলার নদ- নদীর পানিও তেমন একটা বাড়েনি।

Advertisement

আবহাওয়া অফিসসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গত ১৬ বছরে কমপক্ষে ১৪টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত করেছে দেশের উপকূলে। এর মধ্যে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার বেগে বাতাসের সঙ্গে ১০-১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস নিয়ে আঘাত করেছিল ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’। এতে ব্যাপক প্রাণহানির পাশাপাশি লোকালয় ও সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদিও সিডরে সাতক্ষীরায় ক্ষয়ক্ষতি হয় তুলনামূলক কম।

এরপর ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’য় খুলনায় নিহত হয়েছিলেন ৫৭ জন, সাতক্ষীরায় ৬৭ জন এবং বাগেরহাটে ৮ জন। প্রাণহানির পাশাপাশি বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। বাঁধ ভেঙে সাতক্ষীরার গাবুরা ও পদ্মপুকুর ইউনিয়নের বহু মানুষ স্থায়ীভাবে আশ্রয়চ্যুত হন।

২০১৩ সালের ১৬ মে দেশের নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত করে ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’। এর প্রভাবে খুলনা-সাতক্ষীরা উপকূলে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়। ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই ঘূর্ণিঝড় ‘কোমেন’ চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত করে। সাতক্ষীরা-খুলনায় ছিল ঝোড়ো বাতাস ও বৃষ্টি।

২০১৬ সালের ২১ মে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত করে। এর প্রভাবে সাতক্ষীরা-খুলনায় ব্যাপক বৃষ্টি হয় এবং সঙ্গে ছিল ঝোড়ো বাতাস। ২০১৭ সালের ৩০ মে কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’। এর প্রভাবে সাতক্ষীরা-খুলনায় বৃষ্টির সঙ্গে ছিল ঝোড়ো বাতাস।

Advertisement

২০১৯ সালের ৩ মে ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’র আঘাতে সাতক্ষীরা ও খুলনায় প্রায় ১০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০১৯ সালের ১০ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’র আঘাতে সাতক্ষীরা ও খুলনায় গাছচাপায় বেশ কয়েকজন নিহত হন। সুন্দরবনের ৪ হাজার ৫৮৯টি গাছ ও সাড়ে ৯ হাজার ঘরবাড়ি, ২ হাজার ৭৭২টি চিংড়ি ঘের ও পুকুর প্লাবিত, ২৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়।

২০২০ সালের ২০ মে ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’র আঘাতে বেড়িবাঁধ ভেঙে সাতক্ষীরা ও খুলনায় লোকালয় এবং জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনের বনভূমি প্লাবিত হয়। লোকালয়ের ৮৫ হাজার ঘরবাড়ি ও সুন্দরবনের প্রায় ১২ হাজার ৩৫৮টি গাছপালা ভেঙে যায়।

২০২১ সালের ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’র আঘাতে সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি ও খুলনার কয়রায় বেড়িবাঁধ ভেঙে বহু গ্রাম প্লাবিত হয়। প্রায় ৬ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত, ৪-৫ ফুট উচ্চতার জোয়ারে তলিয়ে যায় সুন্দরবনের বনভূমি। মারা যায় চারটি হরিণ। ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর ঘূর্ণিঝড় ‘জাওয়াদ’র প্রভাবে খুলনার কয়রায় বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয় প্লাবিত হয়।

২০২২ সালের ৯ মে ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’র প্রভাবে সাতক্ষীরা ও খুলনায় ভারী বৃষ্টি হয়। ২০২২ সালের ২৪ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’র আঘাতে কয়রায় বেড়িবাঁধ ধসে যায় এবং ১ হাজার ৬০০টি ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বিভাগ-২) নির্বাহী প্রকৌশলী শাহানেওয়াজ তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, মোখার প্রভাবে সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায় কোনো নদীতে জোয়ারের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পায়নি। উচ্চতা স্বাভাবিক ছিল। এ কারণে কোনো এলাকায় বেড়িবাঁধের ক্ষতি হয়নি।

তিনি আরও বলেন, আগে থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কারের কাজ চলছে। এছাড়া গাবুরা ইউনিয়নের চারপাশে নতুন করে টেকসই বেড়িবাধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।

সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ জুলফিকার আলী রিপন জাগো নিউজকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখা ছিল অন্যবারের ঘূর্ণিঝড় থেকে একটু আলাদা। আগের ঘূর্ণিঝড়গুলোতে ঝড়ের অগ্রভাগে মেঘ ছিল। অগ্রভাগের মেঘ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে বৃষ্টি হতো। এবার মেঘ ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ওপরে সীমাবদ্ধ ছিল। সে কারণে এটি চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে আঘাত করলেও এর প্রভাবে সাতক্ষীরা-খুলনায় অঞ্চলে বৃষ্টি হয়নি।

তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাতক্ষীরায় তাপমাত্রা আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। মঙ্গলবার (১৬ মে) থেকে বৃষ্টি হতে পারে।

এসআর/এমএস