থাইল্যান্ডের জাতীয় নির্বাচনের ভোট গণনা প্রায় শেষের পথে। ফলাফলে বিরোধীদলের জয়জয়কার অবস্থা দেখা গেছে। এরই মধ্যে অধিকাংশ আসনে জয় পেয়েছে তারা। এ নির্বাচনের মাধ্যমে এক দশক ধরে চলা সামরিক শাসন বা তাদের আশীর্বাদপুষ্টদের প্রত্যাখ্যান করতে যাচ্ছে দেশটির জনগণ।
Advertisement
৯৯ শতাংশ ভোট গণনা শেষে দেখা গেছে, প্রগ্রেসিভ মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি (এমএফপি) ও পপুলিস্ট ফেউ থাই পার্টি অনেক এগিয়ে রয়েছে। একক দল হিসেবে সর্বোচ্চ ১৫১টি আসন পেয়ে রীতিমতো চমকে দিয়েছে এমএফপি।
ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পেয়ে বড় জয়ের পথে থাইল্যান্ডের দুই বিরোধী দল- ফেউ থাই ও এমএফপি। মোট ৫০০টি আসনের মধ্যে সর্বোচ্চ ২৯২ টি আসন পেয়েছে এ দুই দল।
‘রিফরমিস্ট বা সংস্কারপন্থি পার্টি’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করা এ দলের নেতৃত্বে রয়েছেন ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র পিটা লিমজারোয়েনরাত। এরইমধ্যে তিনি থাইল্যান্ডের ক্যারিশম্যাটিক রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।
Advertisement
কে এই পিটা লিমজারোয়েনরাত?
থাইল্যান্ডের কৃষি ও সমবায় মন্ত্রীর সাবেক উপদেষ্টা পংসাক লিমজারোয়েনরাত ও লিন্ডা লিমজারোয়েনরাতের জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে ১৯৮০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর জন্ম নেন পিটা।
পিটা ব্যাংককের থাম্মাসাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফাইন্যান্স বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক পলিসিতে স্নাতকোত্তর এবং থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। প্রথম থাই নাগরিক হিসেবে ‘ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট স্কলারশিপ’ পেয়ে হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন পিটা লিমজারোয়েনরাত।
হাভার্ডের জন এফ. কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্ট থেকে পাবলিক পলিসি বিষয়ে স্নাতকত্তোর করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) স্লোয়ান স্কুল অব ম্যানেজমেন্ট থেকে বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশনেও স্নাতকত্তোর করেন পিটা।
Advertisement
রাজনীতিবিদ হিসেবে পিটা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী প্রাউত চান-ওচার শাসনের তুখোড় সমালোচনা করেছেন। একই সঙ্গে প্রাউতের শাসনামলকে ‘হারানোর দশক’ হিসেবে আখ্যায়িত করে জনগণের কাছে নিজেকে ‘দিন বদলের দূত’ হিসেবে তুলে ধরেছেন ৪২ বছর বয়সী এ রাজনীতিবিদ।
রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার আগে পিটা মূলত ‘টিম পিটা’ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি গ্র্যাব হোল্ডিং লিমিটেডের থাই ইউনিটের নির্বাহী পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। একটা সময় ঋণে জর্জরিত পারিবারিক মালিকানাধীন রাইস ব্র্যান অয়েল কোম্পানি টিকিয়ে রাখতে সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকে।
ব্যক্তিগত জীবনে পিটা বিয়ে করেছেন থাই মডেল ও অভিনেত্রী ছুতিমা তীপানার্টকে। তাদের এক কন্যা সন্তান রয়েছে।
মুভ ফরোওয়ার্ড পার্টির (এমএফপি) আবির্ভাবএমএফপি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালে। তবে মূলত ‘দ্য ফিউচার ফরোয়ার্ড পার্টি’র সদস্যদের নিয়েই পরবর্তী সময়ে দলটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর ২০২০ সালে ‘দ্য ফিউচার ফরোয়ার্ড পার্টি’ নিজেদের কার্যক্রমের ইতি টানে। তার পর থেকেই থাই রাজনীতিতে ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে এমএফপি।
পিটা তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন ২০১৯ সালে। সে বছর তিনি ফিউচার ফরওয়ার্ড পার্টি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিলিয়নিয়ার ও সেনাবাহিনীর কট্টর সমালোচক থানাথর্ন জুয়াংরুংরুংকিতের প্রতিষ্ঠা করা দলটি সেবারের নির্বাচনে খুব ভালো ফলাফল অর্জন করে।
কিন্তু পরের বছরই বিতর্কিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ফিউচার ফরোয়ার্ড পার্টি ভেঙে দিতে বাধ্য করা হয় ও থানাথর্নকে সংসদ সদস্য হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। তবে দলটির উত্তরসূরি হয়ে দাঁড়ায় মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি।
‘দ্য লিস ম্যাজেস্টি ল’ হিসেবে পরিচিত একটি আইন অনুযায়ী, থাইল্যান্ডের রাজা কিংবা রাজপরিবারের সদস্যদের মানহানি, অপমান কিংবা হুমকি দেওয়ার অভিযোগে থাই নাগরিকদের ১৫ বছর পর্যন্ত শাস্তির কঠিন বিধান রয়েছে। থাইল্যান্ডের মূলধারার প্রথম রাজনৈতিক দল হিসেবে এমএফপি অন্যতম কঠোর এ আইনের বিরোধিতা শুরু করে।
মূলত সংস্কারবাদী লক্ষ্য নিয়েই সর্বপ্রথম ভোটার ও তরুণ প্রজন্মের মনোযোগ আকর্ষণ করে পিটার দল। একই সঙ্গে তারা দেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাব কমানোর অঙ্গীকার করে। এছাড়া পিটা দলটির প্রধান নির্বাচিত হওয়ার পর প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট কমানোর প্রতিশ্রুতি দেন।
দলটির পক্ষ থেকে ‘ম্যারিজ ইকুয়ালিটি বিল’ পাশে সমর্থন দেওয়া, ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে একচেটিয়া বাজার বন্ধ করা ও ব্যাংককের বাইরেও বাণিজ্যিক কার্যক্রম প্রসারের মতো অবস্থান নেওয়া হয়েছে। এতে তরুণ থেকে শুরু করে সব স্তরের জনগণের মধ্যে দলটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়।
দ্য ইনস্টিটিউট অব সিকিউরিটি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো থিটিনান পংসুধিরাক বলেন, ‘এমএফপি এখন থাইল্যান্ডের নতুন এক ফ্যাক্টর। দেশটির তরুণ প্রজন্ম এখন মনে-প্রাণে সেনাবাহিনী ও রাজতন্ত্রে সংস্কার চায়।’
সূত্র: ব্লুমবার্গ, রয়টার্স, আল জাজিরা
এসএএইচ/এমএস