আজ একজন কিংবদন্তি নায়ক আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেলেন। একজন নায়ক, বীর মুক্তিযোদ্ধার শারীরিক প্রস্থান ঘটলো। না ফেরার দেশে চলে গেলেন বাংলা চলচ্চিত্রের মিয়াভাই খ্যাত নায়ক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ঢাকা-১৭ আসনের সংসদ সদস্য আকবর হোসেন পাঠান (ফারুক)। আজ সোমবার (১৫ মে) স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় সিঙ্গাপুর মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন তিনি (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
Advertisement
অসুস্থ হয়ে অনেকদিন ধরেই তিনি ভর্তি ছিলেন সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে। মাঝে তার মৃত্যুর গুজবও উঠেছিল কিন্তু সেসব গুজব গুজব হিসেবেই রয়ে গিয়েছিল। তিনি ছিলেন আমাদের মাঝে। কিন্তু আজকের সংবাদটা আর গুজব নয়। সত্য হয়েই এসেছে আমাদের কাছে।
একটা সময় আমাদের দেশের বাংলা সিনেমার গল্প শুনতাম। আমার আম্মা বাংলা সিনেমার একজন নিয়মিত দর্শক ছিলেন। সিনেমা হলে গিয়েই সিনেমা দেখতেন তিনি। এমনকি বিয়ের পরেও পাশের বাসার পাতানো বান্ধবীর সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে হলে গিয়ে সিনেমা দেখার কত গল্প শুনেছি আম্মার কাছে। কবরী, সুজাতা, রাজ্জাক, শাবানা, ফারুক, সুভাষ দত্ত এমন অনেক নায়ক নায়িকার নাম শুনতে শুনতে বড় হওয়া। আমরা বড় হলাম। সেসব নামের সাথে এবার নিজের মতো করে পরিচিত হওয়ার পালা।
আমাদের সময়ও সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখার প্রচলন ছিল অনেক। এটা অনেকটা নিয়মিত বিষয় ছিল। হলে ভালো কোনো সিনেমা আসা মানেই আমরা ভাইবোনরা দল বেঁধে বড় কারও হাত ধরে সিনেমা দেখতে যেতাম।
Advertisement
নায়ক রাজ রাজ্জাক চলে গেলেন আমরা শোকগাথা লিখলাম। আজ ফারুক চলে গেলেন আবারও শোকগাথা লেখা হচ্ছে। নিয়ম করে কিছু বার্তা আসবে। কিছুদিন পরে হয়তো আরও কোনো বিখ্যাত নায়ক আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন আবারও শোকগ্রস্ত হবো। কিন্তু একজন রাজ্জাক বা একজন ফারুকের চলে যাওয়ার পর থেকে যাচ্ছেন কারা? শোকগাথা লেখার মতো আর কেউ কি তৈরি হচ্ছেন যার মৃত্যুতে আমরা আফসোস করবো বা তাদের অভিনয়ের গল্প করতে পারবো? আমি অন্তত খুঁজে পাচ্ছি না। এই আফসোস আমাদের কি পোড়ায় না?
নায়ক ফারুকের অভিনয় ক্ষমতা কতটা ছিল সেটা বিচার করার মতো কারিগরি শিক্ষা আমার কাছে নেই কিন্তু একজন অভিনেতা বা অভিনয় শিল্পী যদি তার অভিনয় গুণ দিয়ে দর্শকের মনে স্থায়ী দাগ ফেলতে পারে তবেই তার সার্থকতা বলে আমি মনে করি। নায়ক ফারুকের অভিনয় আমি হলে গিয়ে দেখেছি কি না মনে করতে পারছি না কারণ আমরা বড় হতে হতে তিনি আধুনিক ধারার বাণিজ্যিক ছবিতে অভিনয় করেছেন যার কোনোটাই নায়কের ভূমিকায় ছিলেন না। তবে তার অনেক ছবি টেলিভিশনে দেখেছি। আলোর মিছিল ছবিটি যতবার দেখেছি ততবারই একজন জুনিয়র ও সুদর্শন ফারুককে পেয়েছি। সাহেবও দেখা হয়েছে টিভিতেই। গোলাপী এখন ট্রেনে তো ফারুকের অভিনীত একটি বিখ্যাত ছবি।
আব্দুল জব্বারের সেই কালজয়ী গান ‘ওরে নীল দরিয়া, আমায় দে রে দে ছাড়িয়া’ – আহা!! কী মধুর সেই গান। আজও সেই গান আমাদের আড্ডায় থাকে। মুখে মুখে গেয়ে উঠি আমরা। ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া, মরি আমি ধর ফড়াইয়া রে’ ফারুকের মুখে সেই গান, সেই টান, সেই অভিনয়। ভাবা যায় না যে এখনও একজন বিরহে থাকা প্রেমিকের হৃদয়ের হাহাকারকে কতটা উসকে দেয়।
গানের কণ্ঠ আব্দুল জব্বারের হলেও সিনেমায় কিন্তু ফারুকের অভিনয়ের গুণেই গানের মধ্যে লুকিয়ে থাকা দরদকে দর্শকরা টের পায়। একজন সদ্য বিবাহিত স্বামী যে পেশায় সারেং দিনের পর দিন ঘরে ফিরতে পারছে না, এদিকে তার নববিবাহিত আদুরে স্ত্রী ঘরে অপেক্ষায় কবে আসবে তার প্রিয় কবে ফিরবে তার আত্মার খাবার। একজন ফারুকের অভিনয় সেখানে না বললেই নয়।
Advertisement
এই তো আমরা একটা প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষা পেলাম মাত্র। এমন প্রচুর ঘূর্ণিঝড় এসে আমাদের গ্রাম বাংলাকে ধ্বংস করে দিয়ে যেত। উপকূলীয় মানুষের সেই যে লড়াই, সেই যে ঝড়ের আতঙ্কের মাঝে বসবাস আবার সেই লড়াইয়ে ফিরে আসা। মরতে মরতে বেঁচে থাকা। এসব তো একটা সময়ে বা এখনও আমাদের অনেক অঞ্চলের নিত্য ঘটনা।
সেই ঘটনাকে বাস্তবের মতো দর্শকের কাছে পৌঁছে দেয়াই তো একজন অভিনয় শিল্পীর কৃতিত্ব আর এই কৃতিত্বের কাজটুকু নায়ক ফারুক করতেন অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে। তার প্রায় অনেক ছবির গল্পই তৈরি হতো গ্রামীণ গল্পের ওপর নির্ভর করে। সাহেব থেকে সারেং বৌ সব সিনেমায়ই ফারুকের অভিনয় ছিল চরিত্রের সাথে একাকার হয়ে যাওয়া।
‘মিয়া ভাই’ আমাদের গ্রামাঞ্চলের একটি স্বাভাবিক ডাক। পরিবারের বড় ভাইকে ডাকা হতো মিয়া ভাই বলে। এখনকার মতো এতো ফ্যাশনের ডাক ছিল না। সেই ডাকে ছিল মায়া আর শ্রদ্ধার মিশেল। ‘মিয়া ভাই’ সিনেমায় ফারুকের অভিনয় এতটাই বাস্তব ছিল যে এরপর থেকে তিনি মিয়াভাই বলেই পরিচিত ছিলেন।
আমি ভুল না করলে আমাদের বাংলা সিনেমার আর কোনো নায়ক সিনেমার চরিত্র দিয়ে বাস্তব জীবনে পরিচিত হননি। বোম্বের সালমান খানকে এখন সবাই ‘ভাইজান’ বলে ডাকেন। অথচ আমাদের ফারুক সেই ভাইজান আগেই হয়ে গেছেন। মিয়া ভাইয়ের আরেকটি সংস্করণই হচ্ছে ভাইজান।
একাত্তরের রণাঙ্গনের অকুতোভয় বীর যোদ্ধা ছিলেন নায়ক ফারুক। চলচ্চিত্রের নানা সংগঠনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ছিলেন অগ্রভাগে। রাজনীতির ময়দানে যোগ দিয়ে হয়েছিলেন সংসদ সদস্য। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবেই ছিলেন আমৃত্যু।
দুঃখের কথা হচ্ছে রাজ্জাক ফারুকেরা চলে যাচ্ছেন অথচ তাদের সেই শূন্যস্থানে বসার মতো যোগ্যতা আর অন্য কেউ অর্জন করতে পারছে না। আমাদের সিনে ইন্ডাস্ট্রির করুণ দশাতো এখন দিনের আলোর মত স্পষ্ট। জঘন্য সব কাজকারবার করছে সবাই মিলে। সিনেমাকে ডুবিয়ে নিজেরাও ডুবে মরছে। সিনেমা হলগুলো বেঁচে থাকতো রাজ্জাক-ফারুকদের ওপর নির্ভর করে কিন্তু এখন সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অভিনেতাদের দর্শক টানার অক্ষমতার জন্য। নায়কের মৃত্যুতে শূন্যস্থান ফাঁকাই রয়ে যাচ্ছে। দুরবস্থা কেটে যাক। ফারুকরা বেঁচে থাকুক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।
এইচআর/জিকেএস