বাংলা চলচ্চিত্রে গ্রামীণ চরিত্রের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক মিয়াভাই নামে পরিচিত অভিনেতার নাম আকবর হোসেন পাঠান ফারুক। ১৯৭১ সালে এইচ আকবর পরিচালিত জলছবি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন মিয়া ভাই। চলচ্চিত্রের বাইরে তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী। সেই মিয়া ভাই সবাইকে কাঁদিয়ে আজ বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে মারা গেছেন। সিঙ্গাপুরে প্রায় ২ বছর চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি।
Advertisement
প্রারম্ভিক জীবন১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট ফারুক নামে পরিচিত আকবর হোসেন পাঠান দুলু জন্মগ্রহণ করেন মানিকগঞ্জে। তার বাবা আজগার হোসেন পাঠান। তার শৈশব-কৈশোর ও যৌবনকাল কেটেছে পুরান ঢাকায়। পাঁচ বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট।
অভিনয় ও প্রযোজনাফারুক ১৯৭১ সালে এইচ আকবর পরিচালিত জলছবি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রে আগমন করেন। তার বিপরীতে নায়িকা হিসেবে কবরী অভিনয় করেন। এরপরে তিনি ১৯৭৩ সালে খান আতাউর রহমান পরিচালিত আবার তোরা মানুষ হ, ১৯৭৪ সালে নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত আলোর মিছিল দুটি মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্রে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৭৫ সালে গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মিত সুজন সখী ও লাঠিয়াল দুটি ব্যবসাসফল ও আলোচিত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন এবং সে বছর লাঠিয়াল চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য সেরা পার্শ্ব চরিত্রে অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এরপরে ১৯৭৬ সালে মুক্তি পায় তার অভিনীত তিনটি ছায়াছবি সূর্যগ্রহণ, মাটির মায়া ও নয়নমনি। চলচ্চিত্র তিনটি বিভিন্ন বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। পরের বছর শহীদুল্লাহ কায়সার রচিত কালজয়ী উপন্যাস সারেং বৌ অবলম্বনে নির্মিত সারেং বৌ ও আমজাদ হোসেন পরিচালিত গোলাপী এখন ট্রেনে চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্র দুটি নারীকেন্দ্রিক হলেও তার অভিনয় সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে। ১৯৭৯ সালে তার অভিনীত নাগরদোলা, দিন যায় কথা থাকে, কথা দিলাম, মাটির পুতুল, সাহেব, ছোট মা, এতিম, ঘরজামাই চলচ্চিত্রগুলো ব্যবসাসফল হয়। ১৯৮০ সালে সখী তুমি কার ছায়াছবিতে শাবানার বিপরীতে শহুরে ধনী যুবকের চরিত্রে অভিনয় করে সমালোচকদের প্রশংসা লাভ করেন। ১৯৮৭ সালে মিয়া ভাই চলচ্চিত্রের সাফল্যের পর তিনি চলচ্চিত্রাঙ্গনে মিয়া ভাই হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
মিয়া ভাইয়ের নায়িকারাতখনকার সময়ে এমন সুদর্শন যুবক ও নিপুণ অভিনয় দেখে ফারুক খুব সহজেই প্রবেশ করেন বড় পর্দায়। নজর কাড়েন অন্যসব পরিচালকদের। কিংবদন্তি অভিনেত্রী কবরী তখন হিট। প্রথম চলচ্চিত্রে যখন অভিনয় করেন ঠিক তখনই অন্য নায়িকাদের সঙ্গেও নতুন নতুন চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেছিলেন। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তার। একে একে উপহার দিয়েছিলেন ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র। তার বিপরীতে অভিনয় করেন বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি সব অভিনেত্রী। তার মধ্যে রয়েছেন কবরী, ববিতা, সুচরিতা, রোজিনা, সূচন্দা, অঞ্জুঘোষ, অঞ্জনা, শাবানা, নিপা মোনালিসা, সুনেত্রাসহ আরো অনেক নায়িকারা। সত্তর ও আশির দশকের সব শীর্ষ নায়িকার বিপরীতে কাজ করলেও ববিতা-ফারুক জুটিই ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়।
Advertisement
রাজনীতিফারুক স্কুল জীবন থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি ছয় দফা আন্দোলনে যোগ দেন এবং এ সময়ে তার নামে প্রায় ৩৭টি মামলা দায়ের করা হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ফারুক ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিতব্য একাদশ বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনে ঢাকা-১৭ সংসদীয় আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেব নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
ব্যবসায়িক জীবনচলচ্চিত্রের বাইরে ফারুক একজন ব্যবসায়ী। অভিনয়ের পাশাপাশি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বর্তমানে গাজীপুরে অবস্থিত শিল্পপ্রতিষ্ঠান ফারুক নিটিং ডায়িং অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন দীর্ঘদিন।
ব্যক্তিগত জীবনফারুক ফারজানা পাঠানকে ভালোবেসে বিয়ে করেন। তাদের দুটি সন্তান রয়েছে। কন্যা ফারিহা তাবাসসুম পাঠান ও পুত্র রওশন হোসেন।
অসুস্থতা২০১২ সালের জুলাইয়ে নায়ক ফারুক এক মাস ধরে ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ফারুক দীর্ঘদিন ধরে কিডনিজনিত রোগে ভুগছিলেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য ২০১৩ সালের ৩০ আগস্ট সিঙ্গাপুরে যান ও সেখানকার মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালে ভর্তি হন। চিকিৎসা শেষে ২০১৪ সালের ৭ই জানুয়ারি তিনি দেশে ফিরে আসেন। ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট আবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভীষণ জ্বর নিয়ে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হন। ২০২১ সালের ১৫ মার্চ খিচুনি হওয়ার পরে তার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হয়। ১৮ মার্চ অবস্থার উন্নতি হলেও ২১ মার্চ আবার অচেতন হলে আইসিইউতে নেওয়া হয়। অসুস্থতার সঙ্গে দীর্ঘদিন লড়াই করে অবশেষে আজ তিনি পরপারে পাড়ি জমান।
Advertisement
জেএইচ/জেআইএম