মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ
Advertisement
তখন আমি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। বাবা-মায়ের কঠোর শাসনে ঘর থেকে বের হওয়ার সুযোগটুকুও পেতাম না। সমবয়সীদের দেখতাম, ওরা স্কুল পালায়, দিনভর মাঠে খেলে, চুরি করে অন্যের গাছের এটা-ওটা পেরে খায়, পুকুরের পানিতে গোসল করতে করতে বেলা কাটিয়ে দেয়। ওদের স্বাধীনতা আর আনন্দ দেখে আমার খুব আফসোস হতো। সে সময়টাতে ক্লাস ফাঁকি দিতে মনে চাইতো। কিন্তু আমার সেই ভাগ্য ছিল না। বাবার মাদ্রাসায় পড়তাম। সকালে তাঁর হাত ধরে ক্লাসে যেতাম, বিকেলে আবার তাঁর হাত ধরেই বাড়ি ফিরতাম।
একদিন সকালে ফুপাতো ভাই মিরাজ আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এলো। আমরা সমবয়সী ছিলাম। মিরাজকে পেয়ে সেদিন ক্লাসে না গিয়ে খেলায় মেতে উঠলাম। আমাদের পাশের বাড়ির আবুলদের একটি ডেউয়া (গ্রাম্য ফল) গাছ ছিল। গাছটিতে প্রচুর ডেউয়া ধরেছে। একদিন আব্বুর কাছে ডেউয়া কিনে দেওয়ার বায়না ধরেছিলাম। আব্বু গাছের মালিক আবুলকে বলে দিয়েছিলেন, আমাদের যেন কিছু ডেউয়া দেয়।
আরও পড়ুন: রত্নগর্ভা মণিপুরী মা মঞ্জুশী সিনহা
Advertisement
আবুল আমাকে গাছ থেকে পেরে নিতে বলেছিল। আমি গাছে উঠতে পারি না; কিন্তু মিরাজ গাছে উঠতে জানে। সেদিন মিরাজকে পেয়ে নিয়ে গেলাম আবুলদের ডেউয়া গাছের নিচে। আমাকে নিচে রেখে মিরাজ গাছের মাথায় উঠে পড়লো। গাছ থেকে অনেকগুলো আধাকাঁচা ও পাকা ডেউয়া পেরে আমার নতুন লুঙ্গিতে করে নিয়ে এলাম। বাসার পাশের পরিত্যক্ত একটি কাঠের বাক্সে লুকিয়ে রাখলাম। যাতে পাকার পরে খেতে পারি।
সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। ডেউয়া লুকিয়ে রেখে মিরাজ আর আমি গোসল করতে যাচ্ছি। হঠাৎ পেছন থেকে আম্মুর ডাক পড়লো। কাছে যেতেই আম্মু আমাকে শক্ত করে ধরে ফেললেন। আমাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গেলেন কাঠের সেই বাক্সের সামনে। যেখানে আমরা ডেউয়া লুকিয়ে রেখেছি। এতক্ষণে আমার বুঝতে বাকি রইলো না, কী ঘটতে চলছে। মিরাজ দূর থেকে আমার করুণ অবস্থা দেখছিল।
আরও পড়ুন: মাকে যে গ্যাজেট উপহার দেবেন
আম্মু আমাকে কাঠের বাক্সের কাছে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এতগুলো ডেউয়া কোথায় পেলাম? আমি বললাম, ‘আব্বু গাছের মালিক আবুলকে বলে দিয়েছেন। আবুল আমাকে গাছ থেকে পেরে আনতে বলেছেন।’ আম্মুকে কোনোভাবেই একথা বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। আম্মুর হাতের কাছে একটা বাঁশের কঞ্চি ছিল, সেটি দিয়ে ইচ্ছেমতো পেটানো শুরু করলেন। পেটাতে পেটাতে খেয়াল করলেন, আমার নতুন লুঙ্গিতে ডেউয়ার কস লেগে আছে। এবার শাস্তির মাত্রা আরও বেড়ে গেলো। মিরাজ দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অসহায়ের মতো এই দৃশ্য দেখছিলো আর আমার চিৎকার শুনছিলো। আমাকে দেওয়া শাস্তি দেখে বেচারা ভয় পেয়ে বেড়ানো বাদ দিয়ে পালিয়ে বাড়ি চলে যায়।
Advertisement
সেদিনের পিটুনির কথা আজও মনে পড়ে। সেই শাস্তির পর থেকে আর কখনোই অন্যের জিনিস ধরার সাহস হয়নি। এখন বয়স ২৫ হয়েছে; কিন্তু আজও নিজেদের বাড়ির যৌথ কোনো জিনিস ধরতে ভয় পাই। এই আম্মু কিছু বললো বুঝি! আম্মুর কঠিন শাসন পরিচিতদের কাছে অন্যদের চেয়ে আমাকে আলাদা করে চেনাতে সাহায্য করেছে। পরিচিতদের কাছে ভদ্র ছেলে হিসেবে আমি যেটুকু সম্মান, স্নেহ পাই—সবটুকু আমার আম্মুর কারণে।
আরও পড়ুন: মাকে যা উপহার দেবেন
সেদিনের শাস্তি আমার জীবনে পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। তখন মনে হয়েছিল, আমার আম্মু এত পাষাণ কেন? কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমার আম্মু যথার্থই করেছেন। সেদিন তিনি কিছু না বললে আমি হয়তো অন্যের জিনিস চুরি করার সাহস পেতাম! অপরাধীও হয়ে উঠতে পারতাম! মা দিবসে আমার আম্মুর প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। পৃথিবীর প্রত্যেকটি মা সুস্থ থাকুক। তাঁদের শাসনে, ভালোবাসায় বড় হয়ে উঠুক প্রতিটি সন্তান।
লেখক: মাস্টার্স ফলপ্রত্যাশী, বাংলা বিভাগ, সরকারি বিএম কলেজ, বরিশাল।
এসইউ/জেএমআই